সাদা জীবনের কালো কথায় আজ এই বৃষ্টির মধ্যে এক প্রাক্তন পুলিশের বড় কর্তার ফোন। আচমকা মোবাইল স্ক্রীনে তাকিয়ে দেখলাম বিখ্যাত এই পুলিশ অফিসার এর নাম ভেসে উঠলো। এক সময় এই প্রাক্তন পুলিশ অফিসারকে কত ফোনে যে বিরক্ত করতাম আমি তার হিসেব নেই কোনো। আমায় কেনো যে হঠাৎ মনে পড়ল তাঁর এই ভাবতে ভাবতেই ফোনটা রিসিভ করলাম আমি। ওদিক থেকে সেই অতি চেনা গলা শুনতে পেলাম আমি, অভিজিৎ কেমন আছো তুমি। আমি বললাম স্যার ভালই আছি আমি। তোমার মেয়ের কি খবর। ওর পড়াশোনা হচ্ছে তো ঠিক করে। আমি বললাম হ্যাঁ পড়ছে ও। আর এক বছর পড়লে ওর গ্র্যাজুয়েশন হবে। তারপর যদি পারি আমি আর একটু পড়াবো ওকে। ফোনের ওদিক থেকে শুনতে পেলাম তিনি বললেন, হ্যাঁ ওর পড়া যেনো হয় তোমার মেয়ে খুব ভালো মেয়ে। দেখবে ঠিক ও ভালো কাজের সুযোগ পাবেই। যে বিষয় নিয়ে পড়ছে সেটা খুব ভালো সাবজেক্ট।
এই সব কথা বলতে বলতেই একটু বাংলা মিডিয়ার কাজের অবস্থা নিয়ে তিনি নিজেই কথা বললেন। প্রায় প্রতিদিন বাংলার এক নম্বর চ্যানেলে এই প্রাক্তন পুলিশ কর্তাকে টিভিতে দেখি আমরা সন্ধ্যা বেলায়। মিডিয়ার অনেক খবর তাঁর নখদর্পণে। তাই কে কোথায় কাজ করছে, কি ভাবে করছে কোন চ্যানেলের কি অবস্থা সেই সব কথা বেশ স্বচ্ছন্দে বলতে পারেন তিনি অনায়াসে। আমি বললাম হ্যাঁ আপনি ঠিক বলেছেন স্যার। পরে নিজেই বললেন যদি কোনো কাজের খবর তিনি পান তাহলে তিনি নিশ্চয়ই দেবেন আমায়। প্রায় ছয় মিনিটের এই ফোনে বেশ কিছু কথা হলো।
আসলে পরিচিত মানুষজন পরিজন আত্মীয় স্বজন কেউ যদি এই বুড়ো হয়ে যাওয়া, বাতিল হয়ে যাওয়া মানুষের সাথে একটু কথা বলেন,খবর নেন কি ভালো যে লাগে তার কে জানে। আসলে এই সব মানুষ গুলোর একসময় কত যে দাম ছিল,জীবনে তৎপরতা ছিল, দৌড় ছিল, গুরুত্ব ছিল। অন্যরকম একটা জীবন ছিল তাদের। জীবনের এই ওঠা নামা এই ভাবেই তো কেটে যেতো দিন থেকে রাত আবার রাত থেকে দিন। সত্যিই অসাধারন জীবনের এই সব দিনগুলোর কথা আমার মনে পড়ে গেলো ওই পুলিশ কর্তার ফোন পেয়ে।
কত দিন যে ওই এক নম্বর চ্যানেলের সন্ধ্যার ডিবেট শো এর গেস্ট ঠিক হয়ে যাবার পরেও তাঁকে বলেছি আমি একটু সময় করে দেখুন না যদি সুযোগ হয় আমাদের চব্বিশ ঘন্টা চ্যানেলে বসার। হাসি মুখে বলেছেন তিনি দেখছি আমি অভিজিৎ কি করা যায়। একেবারে ঠিক যেনো মোহনবাগান আর ইস্টবেঙ্গল এর খেলার মাঠে দড়ি টানাটানি প্লেয়ার কে নিয়ে। কোনোদিন আমি সেই খেলায় জিতেছি আবার কোনোদিন সেই খেলায় ড্র হয়েছে। আবার কোনো দিন হেরে গেছি। কিন্তু তবু আমাদের দুজনের এই সুন্দর সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায় নি এত দিনেও। এত গেলো এই কিছুদিন আগের কথা।
কিন্তু এমন বৃষ্টির মধ্যেও দুপুর বেলায় আমরা জনা কয়েক কলকাতার সব বিখ্যাত সাংবাদিকরা হাজির হতাম আলিপুর এর তাঁর অফিসে। ভবানী ভবনের সেই লম্বা বারান্দা পার হয়ে এই প্রাক্তন আই জির ঘরে তখন বেশ ভীড়। সেই সব ভীড় ঠেলে তাঁর ঘরে পৌঁছে যেতো আজকালের সব দিকপাল পুলিশ রিপোর্টার এর দল। সেই চিত্রদীপ চক্রবর্তী, সপ্তর্ষি সোম, সেই শিবাজী দে সরকার, সেই শুভ্র চট্টোপাধ্যায় যাকে আমরা লোহা বলেই জানি। এই সব বিখ্যাতদের মাঝে খুব ছোট রিপোর্টার হয়ে থাকতাম আমিও। সুন্দর ফুলকাটা সাদা কাপে গরম চা আসতো। গল্প করতে করতে সেই চা খাওয়াতেন তিনি আমাদের। কিন্তু যার জন্য সাংবাদিকদের যে খবর পেতে তাঁর ঘরে হানা দিত সেই সময় সাংবাদিকরা সেই খবর খুব কম মিলতো আমাদের।
তবু কথায় আছে সাংবাদিকদের কাজ হলো সোর্স কে মাঝে মাঝেই গরম রুটির মতো করে এদিক ওদিক করে একটু গরম করে নেওয়া। সেটা সোর্স খবর দিক বা না দিক। দরজায় দরজায় নক করা ছিল প্রধান কাজ সাংবাদিকের। সেই প্রাক্তন পুলিশ কর্তা তখন ভবানী ভবনে অবসর নেওয়ার আগে সিআইডির উঁচু পদে কর্মরত। কিন্তু এত গেলো এই কিছু দিন আগের কথা। যখন এমন অবারিত ভাবেই ঘোরা যেতো এদিক ওদিক ভবানী ভবনে। আজ তো শুনি সেই সব ঘোরা ঘুরি বন্ধ প্রায় নানা নিয়মের বেড়া জালে। সত্যিই তো গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভের এই সব পাহারাদারদের পায়েও যেনো বেড়ি পড়ে গেছে এই হাল মা মাটি সরকারের আমলে। কই এতো সমালোচনা হওয়া সেই চৌত্রিশ বছরের বাম আমলে এমন কিন্তু দেখিনি আমি। যতই সেই লাল টুকটুকে আমল নিয়ে সমালোচনা করা হোক।
কিন্তু সেই যে কবে তিনি কতদিন আগে তিনি বারাকপুরের মহকুমায় এডিশনাল পুলিশের পদে কাজ করতেন। সেই যে কবে কতদিন আগের সেই সব কথা আমি ফোন করতাম ওনাকে সেই হাত দিয়ে ঘোরানো ল্যান্ড ফোনে। তিনি ওপর প্রান্ত থেকে খবর হলে বলতেন আর না হলে গল্প করতেন হাসি মুখে। একজন সাংবাদিকের এই সব পুরোনো জেলার দাপুটে পুলিশ অফিসার এর সাথে যদি আলাপ হয়ে যায় সেই সব সোর্স সারা জীবন ভালো খবর দেয় আর ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। আর পরে সেই সোর্স যদি কলকাতায় উচ্চ পদে কাজ করেন তাহলে তো কোনো কথাই নেই।
বিভিন্ন জেলা ঘুরে ঘুরে কলকাতায় ভালো কাজের জায়গায় কাজ করতেন তিনি। এই সব নানা কথা আজ মনে পড়ে গেলো আমার এই তাঁর একটা ফোন পেয়ে। যাদের সাথে ঘুরতাম সেই সময় সেই সব দিকপাল সাংবাদিকদের সাথে তাদের সাথে আর কথাই হয় না একদম আমার প্রায়। আমার কোনো খবরও নেয় না তারা। আর নেবেই বা কেনো। আমি পিছিয়ে পড়লেও তারা তো আর আমার মত জীবনে পিছিয়ে পড়েন নি। তারা সব এগিয়ে যাওয়া দাপুটে পুলিশ রিপোর্টার বলে কথা।
কত পুরোনো দিনের ভালো নানা স্মৃতি মনে পড়ল। এমন এক বৃষ্টির দিনে যখন কারুর ফোন ধরছেন না সেই পুলিশ কর্তা। সন্ধ্যার সময় আলোচনার জন্য গেস্ট ঠিক করার সময়। সেই বিপদেও তো আমার ফোন হাসি মুখে ধরে কোনো দিন বলেছেন অভিজিৎ একটু আগে আমি ফাঁকা ছিলাম। এই মাত্র এবিপির তীর্থ আমায় বলে দিলো কনফার্ম করে দিলাম। কিছু মনে করো না ভাই তুমি। না, আমি কিছুই মনে করতাম না। শুধু মনে মনে ভাবতাম যাক আমার ফোনটা তো ধরেন উনি। এটাই বা কম সৌভাগ্য কি আমার। কলকাতার বহু মাতব্বর দের ফোন তিনি না ধরলেও সেই সময় আমি হিরো ছিলাম আমায় নিরাশ করেন নি তিনি কোনোদিন।
সেই বিখ্যাত দাপুটে পুলিশ অফিসার পঙ্কজ দত্তর একটা ফোন পেয়ে এত কিছু কথা মনে পড়ে গেলো আমার। এই সব পুরোনো কিছু মানুষ এখনো আমার খবর নেন। আমায় ভালোবাসেন আজও। মেয়ের পড়া হচ্ছে কি না খবর নেয়। ওর পড়া যেনো চলে সেই কথা বলেন। একজন সাংবাদিকের জীবনে এর থেকে বেশী পাওয়া আর কি হতে পারে বলুন তো। আমি সফল সাংবাদিক হতে পারিনি। কিন্তু একদম বিফল মানুষও তো হইনি আমি এই দীর্ঘ আমার পঁয়ত্রিশ বছরের সাংবাদিকতায়।
তাই বৃষ্টির ছোঁয়া পেয়ে দুপুরে পঙ্কজ দত্তর একটা ফোন আমায় এত গুলো কথা লিখতে সাহায্য করলো এতদিন পরে। যে সব দাপুটে পুলিশ রিপোর্টারদের সাথে ঘুরতাম আমি সেই ভবানী ভবনের লম্বা বারান্দায় রিসেপশনে স্লিপ লিখে অপেক্ষা করতাম কখন ডাক পড়বে আমাদের। আজ আচমকাই সেই মানুষটার একটা ফোন পেয়ে বড়ো ভালো লাগলো আমার। বিশ্বাস করুন স্যার আপনি আপনার সেই পরিচিত গলার ডাক শুনে অভিজিৎ কেমন আছো তুমি শুনে খুব ভালো লাগলো আজ। ভালো থাকবেন স্যার। সুস্থ থাকবেন আপনি। আর এমন করে সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলে সন্ধ্যার টিভির শোকে মাতিয়ে রাখবেন। একজন সংবাদ মাধ্যমের কর্মী হিসেবে এটাই চাই আমি। আর যদি কোনোদিন আবার মিডিয়াতে কাজ করি সেদিন আমি আবার আপনাকে ফোন করলে ধরবেন। হাসি মুখে বলবেন অভিজিৎ আজ তো আর সময় হবে না আমি বুক হয়ে গেছি ভাই। আর সুযোগ থাকলে আমার চ্যানেলে বসবেন আবার নিশ্চয়ই। এই আশা রাখি। আপনি ভালো থাকবেন স্যার।
এক প্রাক্তন পুলিশ কর্তার ফোন - অভিজিৎ বসু।
দোসরা অগাষ্ট, দুহাজার চব্বিশ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন