আজ আপনাদের বলবো বর্ধমানের জামালপুরের মহম্মদ নিজামুদ্দিন এর গল্প। আমার সাদা জীবনের কালো কথায় আমার আঁকিবুঁকি ব্লগের পাতায় আজ এই ঝড়ের রাতে সেই নিজামুদ্দিন এর হাসি মুখ, নামাজ পড়ে যিনি নিজের দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলতে পারেন, নেতাদের কথা বাদ দিন আমি আর আপনি তো এক। মানুষ আমরা, বন্ধু আমরা। কেউ কারুর শত্রু নয়। সত্যিই কি অসাধারন জীবন দর্শনের কথা কত সহজেই অবলীলায় বলে দিলেন তিনি হাসতে হাসতে। যা শুনে আমি সত্যিই অবাক হলাম এই ঝড়ের রাতে।
বিহারের সমস্তিপুর জেলা থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে যিনি চলে এসেছিলেন এই বাংলায় এক সময় এই বর্ধমানের জামালপুর এলাকায়। ব্রিটিশ আমলে যাঁর বাবা এক সময় দেশের হয়ে কাজ করেছেন বলে জানান তিনি আমায় কথায় কথায়। যিনি মনে করেন এই তাঁর সাথে আমার পাশে বসে গল্প করার সুযোগ করে দিলেন তাঁর প্রিয় আল্লাহ আকবর আর আমার মা কঙ্কালী ও মা তারা স্বয়ং নিজেই হয়তো।
আর তাই তো এই ঝড় জল এর রাতে তাঁর সাথে কথা বলার সুযোগ হলো আমার কলকাতার বিখ্যাত হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক ডাঃ সৌমাল্য চট্টোপাধ্যায় এর চেম্বারে বসে তাঁর সেই সুন্দর জামালপুরের গ্রামের বাড়িতে। এই বয়সে নিজেই সাইকেল চালিয়ে তাঁর চলে আসা ডাক্তারবাবুর কাছে চিকিৎসা করতে আর ওষুধ নিতে। নিজের ছেলেকে বলেন ব্যবসা করা ভালো। সৎ থেকে মানুষকে না ঠকিয়ে।
আর তাই বোধহয় তাঁর ছেলের সেই কাঠের ব্যবসা কাঠকল বেশ ভালই চলে এই জামালপুরের এলাকায়। সেখানে তাঁর হিন্দু প্রতিবেশীর বিয়ে আর নিজের জাতির প্রতিবেশীর নিকাহতে একসাথে পাত পেড়ে খেতে বসেন সবাই। মিলে মিশে আনন্দ করেন, তাঁরা মনে করেন এটাই তো আসল এই দেশের একদম চেনা একটা ছবি। যে ছবিটা দিনদিন কেমন যেনো উজ্জ্বল থেকে ধূসর হয়ে যাচ্ছে যেনো।
তাহলে এই যে সব এত হিন্দু হিন্দু আর মুসলমান মুসলমান বলে কথা বলা। এতো ধর্মের জিগিড় তুলে নিজেদের মধ্য হানাহানি আর বিভেদ সৃষ্টি করা। আমরা এই পক্ষের আর ওরা ওই পক্ষের লোক সেটা বলে নিজেদের মধ্য দূরত্ব বাড়িয়ে দেওয়া। আর নানা উপায়ে যে করেই হোক এই সবকিছুকে সঙ্গী করেই রাজনীতি করা।
দাড়িতে হাত বুলিয়ে হাসতে হাসতে বৃদ্ধ নিজামুদ্দিন এর সাফ জবাব ছেড়ে দিন না ঐসব রাজনীতির কারবারিদের কথা। কি সেই লাল পার্টির এক সময়ের দাপুটে সিপিএম। কী সেই ঘাসফুলের নবজোয়ারে ভেসে যাওয়া তৃণমূল বা হিন্দুত্বের ভূতকে ঘাড়ে নিয়ে ক্ষমতার স্বাদ পেতে এই বাংলায় নিঃশ্বাস ফেলছে যে রাজনৈতিক দল সেই বিজেপি। সত্যিই তো অসাধারন কথা বলে দিলেন এই আমার নিজাম চাচা।
ঝড় জলের রাতে যাঁর চেম্বারে বসে কথা হলো সেই ডাক্তার বাবু সৌমাল্য চট্টোপাধ্যায় বলেন, আমরা কর্মহীনতা নিয়ে ভাবি না। আমরা দেশের যুবসমাজ কী করবে আগামীদিনে তাঁদের কাজ কী হবে যা করে তাঁরা বাঁচার স্বপ্ন দেখতে শুরু করবে সেটা নিয়ে একটুও ভাবিনা। আমরা এই আমাদের দেশের শিশুদের ক্ষুধা নিয়ে ভাবিনা, আমরা ভাবি হিন্দু আর মুসলমান এর বিভেদ, হানাহানি, বন্দুকের নলের সামনে মাটিতে লুটিয়ে পড়া এইসব নিয়ে ভাবি। যে ভাবনা অনেক আগেই দেশের বড়ো বড় নেতারা আমাদের মজ্জায় ঢুকিয়ে দিয়েছেন একদম ইনজেকশন করে। যার প্রভাবে আমরা প্রভাবান্বিত হই স্বাধীনতার এতদিন পরেও এই ঝড় জলের রাতেও।
কিন্তু কালবৈশাখীর এই বৃষ্টির রাতে এক গ্রামের সাধারণ মানুষ যাঁর নাম শুধু মহম্মদ নিজামুদ্দিন। যিনি বলাই রায় বা বন্দোপাধ্যায় নয়। তিনি বিহার থেকে বাংলায় এসে হাসতে হাসতে নামাজ পাঠ করে বলতে পারেন, ওই সব গ্রামের নেতাদের কথা বাদ দিন। ওরা ওদের মতো করে চলুক আর জাত আর ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করুক মারামারি ও হানাহানি করুক। আমি আর আপনি এই যে পাশে বসে ছবি তুললাম, কত ঝড়ের রাতে গল্প করলাম, সুখ দুঃখের কথা বললাম। একে অপরের সাথে মনের কথা আর ঘরের কথা শেয়ার করলাম। এটাই বা কম কী। বাদ দিন না ওদের কথা।
মাথার ওপর রাতের নিকষ কালো আকাশে বিদ্যুতের ঝলকানি নিয়ে, ঝড়ের রাতে গাছের দোলা দেখতে দেখতে প্রবল ঝড়কে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম রাস্তায় আমি বর্ধমান থেকে বোলপুরের পথে। নিজাম চাচাকে হাসিমুখে বিদায় জানিয়ে। বৃষ্টি ভেজা এই ঝড় জলের রাতে নিজামউদ্দিন যেন আমার কাছে দেবদূতের মতই আবির্ভূত হলেন তিনি এদিন। এই অখণ্ড ভারতের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতই আমার কাছে ভাস্বর হয়ে বেঁচে থাকলেন এই বর্ধমানের জামালপুর এর মহম্মদ নিজামুদ্দিন।
যিনি অবলীলায় বলতে পারেন ওদের কথা বাদ দিন আমি আর আপনি তো এক। আমরা হলাম মানুষ। যাঁদের মধ্যে কোনো জাত আর ধর্ম নিয়ে রাজনীতি নেই, হানাহানি নেই, মারামারি নেই। আমরা শুধুই রক্ত মাংসের একটা মানুষ। যাঁদের মধ্যে আছে মান আর হুশ। আর আছে ভালোবাসা একে অপরকে জড়িয়ে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকা। যেটা হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। তাহলে আর এতো চিন্তা কিসের। সত্যিই অসাধারণ এই জীবন এর কথাকে বুকে নিয়ে ঘরে ফিরে এলাম আমি।
মহম্মদ নিজামুদ্দিন - এর গল্প - অভিজিৎ বসু।
সাতাশে এপ্রিল, দু হাজার পঁচিশ।
ছবি আভেরী বসুর মোবাইল ক্যামেরায় তোলা।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন