সাদা জীবনের কালো কথায় এমন একজনের কথা লিখবো আজ যার কথা অনেক আগেই লেখা উচিত ছিল আমার। ইটিভির কর্ণধার রামোজি রাও এর মৃত্যুর পর তাঁর স্মৃতির কথা লেখার সময় যার কথা আমার এক লাইন হলেও লেখা উচিত ছিল বলে আমি মনে করি। যা আমায় মনে করিয়ে দিলেন একজন প্রাক্তন ইটিভির সহকর্মী। তার কথা শুনে মনে হলো ঠিক তো চেয়ারম্যান স্যার কে হারিয়ে আমরা সবাই ইটিভির কর্মীরা মিলিত হলাম এক নিমেষে এক ছাতার তলায়। কিন্তু যার জন্য আমরা সবাই তাঁর কাছে এই ইটিভির কোম্পানি তে কাজ এর সুযোগ পাই তাঁর কথা উল্লেখ করা দরকার ছিল বোধ হয়। কিন্তু আমি লিখি নি বা হয়তো ভুলে গেছিলাম সেই মানুষটার কথা বলতে। সেই ব্যক্তির কথাই আজ বলবো কিছুটা। না হলে সেটা ঠিক কাজ হবে না কিছুতেই।
যে মানুষটার জন্য আমরা প্রায় সবাই এই ভাবে সব একসাথে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। কেউ পশ্চিমবাংলায় কাজ করেছি আবার কেউ কেউ হায়দরাবাদ এর সেই পাঁচিল ঘেরা রামোজি রাও এর সাম্রাজ্যে কাজ করেছি। কিন্তু বাংলা মিডিয়ার সেই ছোট্টো চারা গাছের যে বীজ রামোজি রাও বপন করেছিলেন সেই সময় আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে। এই মানুষটার হাত ধরেই লোক নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল সেই সময় বাংলায়। না, সেই মানুষটার কোনো ছবি নেই আমার সংগ্রহে। যার জন্যে আমরা অনেকেই এই ইটিভির একজন কর্মী হতে পেরেছিলাম। সেই মানুষটা হলেন অম্বরিশ দত্ত। যার জন্য বহু বেকার যুবক কাজের সুযোগ পেয়েছিল সেই সময়। বাংলায় বা বাংলার বাইরের রাজ্যে।
প্রথম অম্বরিশ দার নাম শুনে আমি দেখা করতে যাই তাঁর কলকাতার শান্তিনিকেতন বিল্ডিং এর আট তলার অফিসে। ইনাডু পত্রিকার কলকাতার অফিসে বেশ ভয়ে ভয়ে পা দিলাম আমি। খুব ব্যস্ত ছিলেন তিনি। সেই সময় এত মোবাইলের ঘন ঘন ব্যবহার ছিল না। ঘন ঘনও সিগারেট খাচ্ছিলেন তিনি। এদিক ওদিক দৌড়ে বেড়াচ্ছেন তিনি সেই ছোটো অফিসে। একটু ছোটো চেহারার। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। কলকাতার পট পরিবর্তন কাগজে তখন সবে মাত্র কাজ সুরু ঙ্করেছি আমি। জেলা রিপোর্টার থেকে কলকাতায় পা দিয়েছি সবে আমি। কাগজে নাম বের হতে শুরু করেছে।
সালটা 1998 সাল হবে বোধ হয়। দেখা হতেই বললেন কিরে সিভি নিয়ে এসেছিস তুই। আমি ভয়ে ভয়ে বললাম হ্যাঁ দাদা এনেছি। বাড়িতে কে কে আছে তোর। বললাম মা, বাবা আর আমি। বাবা কি করেন। আমি বললাম, বাবা কারখানায় কাজ করতেন সেটা বন্ধ হয়ে গেছে দাদা। শুনে একটু চুপ করে গেলেন কিছু সময়। তার পর পিঠে চাপড় মেরে বললেন যা, তোর চাকরি হয়ে যাবে কোনো চিন্তা নেই। বাড়ী চলে যা। ভালো করে কাজ করিস তুই। বলেই কোথায় চলে গেলেন ব্যস্ত হয়ে অম্বরিশ দা।
সেই প্রথম আলাপ তাঁর সাথে ইটিভির চাকরি পাবার আগে। পরে আশীষ দার ইন্টারভিউ বোর্ডে আমাকে ডাকা। তিন নম্বর চৌরঙ্গী স্কোয়ারে এস আর রামানুজন এর সামনে ইন্টারভিউ দেওয়া খুব ভয় নিয়ে। কারণ ইংরিজতে কথা বলতে না পারার ভয়। যা আজও আমায় তাড়া করে বেড়ায় এই ভয়টা। বর্তমানের তরুনকান্তি দাশের সাহায্য করা এসব ছিল অনেক পরের ধাপ আমার ইটিভির কাজ পাওয়ার ইতিহাস।
এই মানুষটার জন্য আমরা সবাই মিলে ইটিভির এই কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। যে মানুষটার স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে আজ বার বার তাই মনে হচ্ছে এই অম্বরিশ দা না থাকলে কি আর আমার সাংবাদিক হওয়া যেতো। বাংলা টিভি চ্যানেলে কাজ করতে পারতাম কোনো দিন। না, মনে হয়। অন্য যারা আজ এই রামোজি স্যার এর কাছে কাজ শিখেছেন তারা চেয়ারম্যান স্যার এর চলে যাওয়া নিয়ে শোক প্রকাশ করেছেন। আমিও করেছি শোকপ্রকাশ। কিন্তু যে মানুষটার দৌলতে আমরা সবাই এক হলাম, এক সুতোয় বাঁধা পড়লাম অল্প সময়ের মধ্যে সেই মানুষটার জন্য দু এক লাইন হলেও লিখে ফেললাম আমি আজ এই রাতের অন্ধকারে।
এরপর সবটাই তো ইতিহাস। ইটিভির চাকরি হলো আমার হুগলী জেলায়। কাজ শুরু করলাম। আরও অনেক মানুষ হায়দরাবাদ পৌঁছে গেলো অম্বরিশ দার কথা শুনে। খবরের জগতের সব দিকপাল লোকজন কাজে যোগ দিলেন এই রামোজি রাও স্যার এর স্বপ্নের ইটিভিতে। যার মূল কারিগর ছিলেন এই অম্বরিশ দত্ত।
আশীষ দা, শুভাশিস দা,পড়ে অনির্বাণ দা, মৃত্যুঞ্জয় দা, সিদ্ধার্থ দা, সিদ্ধান্ত, তপশ্রী দি, চার্লস নন্দী, ধ্রুব আরও কতজন যে কাজে যোগ দিলো সেই সময় সেটা আর বলার নয়। দৌড় শুরু হলো ইটিভি বাংলার। সেই ইটিভির রূপকার রামোজি রাও চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। আর অনেক আগেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন সেই অম্বরিশ দত্ত। যার জন্য আমার মত একজন মানুষের জীবনে রিপোর্টার হওয়া হলো টিভি তে।
অনেকেই জীবনের অনেক উচ্চ শিখরে পৌঁছে গেছেন তাঁর দেওয়া চাকরি পেয়ে, কাজ শিখে। চেয়ারম্যান স্যার এর সাথে নিশ্চয়ই এতদিন পর দেখা হবে অম্বরিশদার। ভয়ে ভয়ে হয়তো স্যারকে দেখেই আগের মত সিগারেট মুখ থেকে ফেলে দিয়ে পা দিয়ে চেপে ধোঁয়া নিভিয়ে ফেলে দ্রুত দরজা ঠেলে বলবেন স্যার আসবো আমি। চেয়ারম্যান স্যার হাসি মুখে প্রিয় অম্বরিশকে দেখে কাছে ডেকে নেবেন আবার হয়তো। যদি সত্যিই দেখা হয়ে যায় দুজনের। আপনারা দুজনেই ভালো থাকবেন। আমার প্রনাম নেবেন।
ইটিভি ও অম্বরিশ দা - অভিজিৎ বসু।
দশ জুন, দু হাজার চব্বিশ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন