আজ সাদা জীবনের কালো কথায় আজ ডুমুর এর কথা। কথায় আছে ডুমুরের ফুলের দেখা পাওয়া ভার। সত্যিই তো ডুমুর ফুল আর কোথায় পাবো বলুন। নিজেই এখন ডুমুর ফুল হয়ে ঘুরে বেড়াই এদিক থেকে ওদিক। কিন্তু বোলপুরের এই অতি প্রাচীন স্টেশনের কাছের হাটতলার বাজারে ডুমুর নিয়ে বসে থাকা এক মহিলাকে দেখে মনে পড়ে গেলো অনেক পুরোনো কথা।
আমার মা কে বাজারে ডুমুর দেখলেই ফোন করতাম মা, ডুমুর পেয়েছি। কিনে নিচ্ছি, তোমায় দেবো। মা বলতেন, হ্যাঁ নিয়ে নে। তারপর বাবা এসে সেই ডুমুর নিয়ে যেতেন। মা রান্না করে পাঠিয়ে দিতেন আমায় সেই ডুমুর এর তরকারি। ডুমুর এর তরকারি আর গরম ভাত এর স্বাদ আলাদা। আজ মা নেই। মার হাতের ডুমুরের স্বাদ আস্বাদন আর করতে পারবো না কোনো দিনই। তবু পুরোনো আমলের সেই সব এদিক ওদিক ঝোপ ঝাড় থেকে তুলে আনা গাছের পাতা, ফল, ফুল রান্না করে মা দিতেন যার স্বাদ ছিল অনবদ্য। সেই স্বাদ আর পাবো কই এখন। যাক এত গেলো ডুমুরের অতীত দিনের সুখ স্মৃতির কথা।
বাড়ির পাশেই একটা ডুমুর গাছ ছিল মনে আছে পুকুর পাড়ে। ছোটো বেলায় ডুমুর গাছ থেকে উঠে কত যে ডুমুর পেড়ে মাকে এনে দিয়েছি। গাছে উঠে কালো পিঁপড়ের কামড় খেয়েছি অনেক। তবু মাকে খুশী করতে সেই সব গায়ে মাখিনি কোনো দিন। মাসের শেষে ঘরে বাজারের সবজি কেনার টাকা না থাকলে মা তো ডুমুর, কচু শাক, লতি, এসব দিয়েই সংসার চালাতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। আমরাও জানতাম যে এই ভাবে পেট ভরে যেত আমাদের। হাসি মুখে দিন কাটতো সেই সব কষ্টের দিন গুলো। কিন্তু জীবনে আনন্দ কম ছিল না সেই সময়। আজ তো হেঁসেলে ডুমুর এর দেখা পাওয়াই ভার। তার সামনে এখন নো এন্ট্রি বোর্ড।
ডুমুর (বৈজ্ঞানিক নাম: Ficus) মোরাসিয়া গোত্রভূক্ত ৮৫০টিরও অধিক কাঠজাতীয় গাছের প্রজাতিবিশেষ। এ প্রজাতির গাছ, গুল্ম, লতা ইত্যাদি সম্মিলিতভাবে ডুমুর গাছ বা ডুমুর নামে পরিচিত। ডুমুর নরম ও মিষ্টিজাতীয় ফল। ফলের আবরণ ভাগ খুবই পাতলা এবং এর অভ্যন্তরে অনেক ছোট ছোট বীজ রয়েছে। এর ফল শুকনো ও পাকা অবস্থায় খাওয়া যায়। উষ্ণ জলবায়ু অঞ্চলে এ প্রজাতির গাছ জন্মে। কখনো কখনো চাটনি হিসেবে এর ব্যবহার হয়ে থাকে। এছাড়া স্ন্যাকজাতীয় খাবারেও ডুমুরের প্রয়োগ হয়ে থাকে।
ডুমুর কয়েকটি প্রজাতির হয়। বাংলাদেশে সচরাচর যে ডুমুর পাওয়া যায় (Ficus hispida) তার ফল ছোট এবং খাওয়ার অনুপযুক্ত। এর আরেক নাম 'কাকডুমুর'। এই গাছ অযত্নে-অবহেলায় এখানে সেখানে ব্যাপক সংখ্যায় গজিয়ে ওঠে। গাছ তুলনা মূলকভাবে ছোট। এটি এশিয়ার অনেক অঞ্চলে এবং অস্ট্রেলিয়ায় পাওয়া যায়। পাখিরাই প্রধানত এই ডুমুর খেয়ে থাকে এবং পাখির বিষ্ঠার মাধ্যমে বীজের বিস্তার হয়ে থাকে। অনেক এলাকায় এই ডুমুর দিয়ে তরকারি রান্না করে খাওয়া হয়। এই ডুমুরের পাতা শিরিষ কাগজের মত খসখসে। এর ফল কান্ডের গায়ে থোকায় থোকায় জন্মে।
মধ্যপ্রাচ্যে যে ডুমুর (আঞ্জির) পাওয়া যায় (Ficus carica) তার ফল বড় আকারের; এটি জনপ্রিয় ফল হিসেবে খাওয়া হয়। বাণিজ্যিকভাবে এর চাষ হয়ে থাকে আফগানিস্তান থেকে পর্তুগাল পর্যন্ত। এর আরবি নাম 'ত্বীন'; হিন্দি, উর্দু, ফার্সি ও মারাঠি ভাষায় একে 'আঞ্জির' বলা হয়। এই গাছ ৬ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। এর আদি নিবাস মধ্যপ্রাচ্য।
জগডুমুর বা যজ্ঞডুমুর নামে আরেক প্রজাতির ডুমুর রয়েছে, যার বৈজ্ঞনিক নাম Ficus racemosa. মূলত এই প্রকার ডুমুর তরকারি করে খাওয়া হয়। এছাড়া অশ্বত্থ বা পিপল নামে আরেকটি ডুমুর জাতীয় গাছ আছে, যার বৈজ্ঞানিক নাম Ficus religiosa। এটি বটগোত্রীয় বৃক্ষ, এর পাতার অগ্রভাগ সূচাল।
উপরিউক্ত প্রজাতি ছাড়াও ডুমুরের আরো অনেক প্রজাতি রয়েছে।
ডুমুরের ধর্মীয় গুরুত্ব রয়েছে। ধর্মগ্রন্থ কুরআনে সূরা 'ত্বীন' এ বর্ণিত ডুমুর(আণ্জ্ঞির) গাছ। ধর্মগ্রন্থ কুরআনে 'ত্বীন' (আঞ্জির) নামে একটি অনুচ্ছেদ বা সূরা রয়েছে। সেখানে এই ফলকে আল্লাহর বিশেষ নিয়ামত বা অনুগ্রহরূপে ব্যক্ত করা হয়েছে। হিন্দুদের ক্ষেত্রে অশ্বত্থ একটি ধর্মীয় গাছ। বাইবেলে এই ফলের উল্লেখ আছে সেখানে বলা হয়েছে, ক্ষুধার্ত যীশু একটি ডুমুর (আঞ্জির) গাছ দেখলেন কিন্তু সেখানে কোনো ফল ছিল না, তাই তিনি গাছকে অভিশাপ দিলেন। বৌদ্ধ ধর্মেও এই গাছ পবিত্র হিসেবে গণ্য। গৌতম বুদ্ধ যে বোধিবৃক্ষতলে মোক্ষ লাভ করেন তা ছিল অশ্বত্থ গাছ, যা একটা ডুমুর জাতীয় গাছ (Ficus religiosa)।
যে কোনও শুকনো ফল নিঃসন্দেহে খনিজ পদার্থ এবং ভিটামিন সমৃদ্ধ খাদ্য। আনজির বা ডুমর সবচেয়ে জনপ্রিয় শুষ্ক ফল যার একাধিক উপকারিতা আছে। সুতরাং, এই ফল আপনার রোজকার খাদ্য সামগ্রীর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা আবশ্যক। আনজির বা ডুমুর একাধিক উপায়ে খাওয়া হয়ে থাকে।
প্রথমত, এটি সূর্যের তাপে শুকিয়ে। আপনি এই উপায়ে সারা বছর শুকনো ডুমুর সংরক্ষণ করতে পারেন। সমস্ত দেশের লোক ডুমুর ও দুধের শরবত খেতে ভালোবাসে। যার যার জন্য আপনাকে কিছু ডুমুর ভিজিয়ে রেখে তার সাথে দুধ যুক্ত করে শরবত বানাতে হয়। বিকল্পভাবে, আপনি এমনকি ডুমুর কেটে স্যালাড হিসেবে খেতে পারেন। ডুমুর খাওয়ার সবচেয়ে সুস্বাদু উপায় হল একে মিষ্টিরমধ্যে যোগ করে খাওয়া। আপনি ডুমুর দিয়ে বরফী এবং পায়েসের মত মিষ্টি তৈরি করতে পারেন।
এই ফলের অনেক উপকারিতা তার উল্লেখ করা হলো:
রক্তচাপ এবং বার্ধক্য নিয়ন্ত্রণে: ডুমুর পটাশিয়াম সমৃদ্ধ হওয়ার ফলে সোডিয়াম-এর প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ করে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। তারা পর্যাপ্ত লোহা, ইস্ট্রোজেন ইত্যাদি সরবরাহ করে বয়সের প্রভাব নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করতে পারে। এটি আপনার হরমোনগুলিকে পরীক্ষার মধ্যে রাখে এবং আপনার শক্তিকেও বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে। ডুমুর ত্বক এবং চুল এবং নখ ভালো রাখতে সাহায্য করে। ডুমুরের পেস্ট মুখের ওপর মাখলে তা ব্রণ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।
ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে: পর্যাপ্ত ও নিয়মিত পরিমাণ ডুমুর ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। ডুমুর ফাইবারে সমৃদ্ধ অতএব ভাজা খাবার থেকে দূরে থাকার এটি ভালো উপায়। হালকা টিফিনের জন্য আপনি ডুমুর কে বেছে নিতে পারেন। এটি একই সাথে আপনার পেটও ভরাবে এবং আপনার শরীরকে যথেষ্ট পুষ্টিগুণও প্রদান করবে।
হৃৎপিন্ডের জন্য উপযুক্ত পুষ্টিসম্পন্ন খাদ্য: ডুমুর রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইডের পরিমাণ হ্রাস করে। ট্রাইগ্লিসারাইড হৃদরোগের জন্য দায়ী কারণ তারা রক্তনালীর মধ্যে জমাট সৃষ্টি করে যার ফলে হার্ট অ্যাটাকের সৃষ্টি হয়।
ক্যানসারের সম্ভাবনা হ্রাস করে: ডুমুর অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট সমৃদ্ধ হওয়ায় র্যাডিকেল এবং ক্রনিক প্রদাহ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। র্যাডিকেল ক্যান্সার, হৃদরোগ, এবং ডায়াবেটিস সহ দীর্ঘস্থায়ী রোগের জন্য দায়ী। ডুমুরকে এই দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্য অবস্থার একটি প্রতিরোধক হিসাবে গণ্য করা হয়।
রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণ করে: ডুমুরগুলিতে উপস্থিত ক্লোরোজেনিক অ্যাসিড ডায়াবেটিক রক্তের শর্করার মাত্রা হ্রাসে সহায়তা করে। এছাড়াও ডুমুর মধ্যে প্রচুর পটাসিয়াম পাওয়া যায় যা রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
হাড়ের স্বাস্থ্যকে উন্নত করে: স্বাস্থ্যকর ও মজবুত হাড়ের জন্য প্রয়োজন হয়। ক্যালসিয়াম, এবং ডুমুর হলো এই ক্যালসিয়ামের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক উৎস। দুগ্ধজাত পণ্যগুলি ক্যালসিয়ামের উৎস হলেও, তা যথেষ্ট হয় না, এবং ডুমুর একটি ভাল বিকল্প হিসেবে গণ্য হতে পারে।
কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধক: ফাইবার সমৃদ্ধডুমুর অন্ত্রের গতিশীলতার জন্য ভাল এবং কোষ্ঠকাঠিন্য প্রতিরোধ করতে পারে। ফাইবার অন্ত্র আন্দোলনে সাহায্য করে।
প্রজনন ব্যবস্থাকে সচল রাখে: ডুমুর ম্যাগনেসিয়াম, দস্তা এবং ম্যাঙ্গানিজের মত খনিজগুলির সমৃদ্ধ হয় যা প্রাণবন্ততা ও উর্বরতা বজায় অবদান রাখে। ডুমুর দুধে ভিজিয়ে অথবা ওপরে বর্ণিত যে কোন উপায়ে খাওয়া যায়। সুতরাং, আপনি যদি গর্ভবতী হন বা একটি শিশুর পরিকল্পনা করেন, তবে আপনার ডায়েটে এই ফলটি অতিঅবশ্যই অন্তর্ভুক্ত করুন।
কিডনির পাথর প্রতিরোধ করে: কিছু ডুমুর জলে ফুটিয়ে নিন এবং সেই জলটি কিছুদিন ধরে পান করুন। এই জল কিডনিতে পাথর প্রতিরোধে সহায়তা করে।
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট
ডুমুর ফ্রি র্যাডিক্যালের বিরুদ্ধে শরীরে প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে কাজ করে। এটি পলিফেনল নামক অ্যান্টি অক্সিডেন্টে ভরপুর, যা আপনার শরীরের টিস্যু গুলোকে ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। সেইসঙ্গে ত্বককে উজ্জ্বল করে এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্যকে উন্নত করে।
ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণ করে রক্তে শর্করার মাত্রা ঠিক থাকা খুব জরুরি। এই ক্ষেত্রে ডুমুর সাহায্য করতে পারে। এতে এমন উপাদান রয়েছে যা রক্তে শর্করাকে নিয়ন্ত্রণ করতে এবং ইনসুলিন নিঃসরণ বাড়াতে সাহায্য করে। ডুমুর থেকে যোগ হওয়া ফাইবার রক্তে শর্করার ভালো ব্যবস্থাপনায় অবদান রাখে।
হাড় শক্তিশালী করে হাড়ের যত্নের ডুমুর বেশ কার্যকর। ডুমুর খেলে তা ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এবং ফসফরাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি সরবরাহ করে যা হাড়ের শক্তি বাড়ায়। ডুমুরের ক্যালসিয়াম উপাদান হাড়-সম্পর্কিত অসুস্থতা থেকে রক্ষা পেতে সাহায্য করে।
ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে আপনি যদি অতিরিক্ত ওজন ঝরাতে চান তবে ডুমুর একটি মূল্যবান সহযোগী হতে পারে। এর ফাইবার উপাদান স্বাস্থ্যকর পাচনতন্ত্র বজায় রাখে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। ডুমুর খেলে দীর্ঘ সময় পেট ভরিয়ে রাখে, যে কারণে ঘন ঘন খাবার খাওয়ার অভ্যাস কমে। এটি আপনার ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
ভেজানো ডুমুর ২-৩টি ডুমুর সারারাত পানিতে ভিজিয়ে রাখুন। সকালে সেই ডুমুর পানিসহ খেয়ে ফেলুন। এতে মিষ্টি স্বাদ পেতে চাইলে সামান্য মধু যোগ করতে পারেন। দৈনন্দিন খাবারের তালিকায় ডুমুর যোগ করুন। এতে শরীরের অনেকগুলো রোগবালাই নীরবে দূর হবে। সুস্থতা বজায় থাকবে শরীরে।
ঝোপঝাড়ে অযত্ন আর অবহেলায় বেড়ে ওঠা একটি ফলের নাম ডুমুর। ডুমুরের পাতা খসখসে হয়। ডুমুরের ফল নরম ও মিষ্টি হয়। কাঁচা বা শুকনা দুইভাবেই খাওয়া যায় এই ফল। ডুমুর প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থে পরিপূর্ণ যা স্বাস্থ্যের জন্য বিস্ময়কর ভাবে কাজ করে।
তাহলে ডুমুরের ফুলের সন্ধান না পেলেও ডুমুর এর সন্ধান পেলে তাকে যত্ন করে ঘরে নিয়ে আসুন। যত্ন করে রান্না করুন। আর সেই ডুমুর খান দেখবেন শরীর ভালো থাকবে, সুস্থ থাকবে। দেখতে ভালো নয় বলে নাক সিঁটকোবেন না এই ডুমুর ফলকে দেখে।
ডুমুর কথা - অভিজিৎ বসু।
সাতাশে জুন, দু হাজার চব্বিশ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন