সাদা জীবনের কালো কথায় আজ এমন একজন রাজনীতির মানুষের কথা মনে পড়ে গেলো যাকে অন্তত আমি কোনো দিন ভুলতে পারবো না। আমার পঁয়ত্রিশ বছরের সাদা কালো সাংবাদিকতার জীবনে এমন খোলামেলা, বন্ধু বৎসল, পরোপকারী, হৃদয়বান রাজনৈতিক নেতা খুব কম দেখেছি বলেই মনে হয় আমার। তিনি হলেন প্রয়াত তৃণমূলের সাংসদ আকবর আলি খন্দকার। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ সহযোগী একসময়ের।
সেটা এই লোকসভা ভোটের সময় এলেই তাঁর কথা খুব বেশি করে মনে পড়ে আমার। আজ কালকার সব রাজনীতির দৌড় করা রং মাখা, সং সাজা, আর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে মুখ ঝামটা দেওয়া নেতা নেত্রীদের মাঝে আকবরদা বোধহয় একদমই বেমানান ছিলেন। তাই আজ তিনি এই রাজনীতির ময়দানে নেই ভালই হয়েছে বোধহয় কিছুটা। না হলে এই সব শহুরে দাম্ভিক, আত্মভরিতা পূর্ণ মানুষের মাঝে গ্রামের সেই খানাকুলের বড়ো ভাই কিছুটা হলেও সিঁটিয়ে থাকতেন বোধহয় অন্যদের থেকে। ভালই হয়েছে এই সব মানুষের ভীড়ে আকবরদা আজ নেই। মন খারাপ হয় খুব তবু মনে হয় আমার যা হয়েছে ভালো হয়েছে। না হলে বোধহয় কষ্ট পেতেন তিনি এসব কাণ্ড কারখানা দেখে।
তাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সর্বদা তাঁর ছায়া সঙ্গী সেই বড় ভাইকেই চন্ডিতলা বিধানসভায় বাজি রেখেছিলেন 1996 সালের বিধানসভা নির্বাচনে। তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সিপিএমের দাপুটে নেতা মলিন ঘোষকে হারিয়ে দিয়ে একদানেই বাজিমাত করলেন আকবর আলী খন্দকার। ঠিক যেনো ম্যাজিক ছিল একটা সেই জয়লাভ। আসলে গ্রামের চাষীর ছেলে আকবর দাকে কিছুটা হলেও আন্ডার এস্টিমেট করেছিল গ্রামবাংলার দাপুটে সিপিএমের সেই সব লাল পার্টির নেতারা। আর তার ফল দিতে হলো সেই সময় তাদের চন্ডীতলা বিধানসভায় হেরে গিয়ে।
যে সময় সিপিএমের দাপটে নাজেহাল গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষ। লালে লাল হুগলী জেলার দুর্ভেদ্য দুর্গ সেই লাল মাটির রাস্তায় সবুজ ঘাসের ওপর প্রথম হুগলী জেলায় জোড়া ফুল ফোটালেন আকবর আলি খন্দকার। আমাদের সবার বড় ভাই। সেটাই একটা টার্নিং পয়েন্ট বলা যায়।
যদিও রাজনীতির ময়দানে তাঁর আসা অনেক আগে থাকতেই। সেই ভদ্রেশ্বরে ভিখারী পাসোয়ান অন্তর্ধান রহস্যের কিনারা করতে গিয়ে আকবর দা আর মমতার কাছে আসা। তারপর একের পর এক ঘটনার সাথে জড়িয়ে যাওয়া। সিপিএমের অত্যাচারের খবর পেয়ে সেই মোটরসাইকেল নিয়ে জেলার একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে দৌড়ে যাওয়া গ্রামের তাজা ছেলে বড়ভাইয়ের। সঙ্গী আজকের উত্তরপাড়া পুরসভা পুরপ্রধান দিলীপ যাদব। যে ছায়াসঙ্গী হয়ে যে আকবর দার সাথে ঘুরে বেড়াতেন সেই দিলীপ দা।
আসলে এই দৌড়টাই ছিল আকবর দার রাজনীতির উত্থানের আসল রহস্য। যা সিপিএম বুঝতেই পারে নি একদম। ভেবেছিল গ্রামের ওই ছেলেটা ভয় পাবে। পিছিয়ে যাবে। হেরে যাবে। কিন্তু সেটা না হয়ে উল্টো হলো। আর তাই বিধানসভা থেকে সোজা শ্রীরামপুরের লোকসভা ভোটে দাঁড়িয়ে 1998 সালে সাংসদ হয়ে দিল্লী পা দিলেন সেই সবার বড়ভাই, আকবর আলি খোন্দকার। যা এককথায় স্বপ্ন ছিল তাঁর নিজের কাছেই।
যার কাছে এমপি হবার পরে শেওড়াফুলির অফিসে সকাল পাঁচটা থেকে লাইন পড়তো সাধারণ মানুষের। যারা গ্রাম গঞ্জ থেকে ছুটে আসতেন নানা দরকারে।আর হাসি মুখে আকবরদা সবার সাথে কথা বলে চেষ্টা করতেন সাহায্য করার। অবারিত দ্বার ছিল সেই সময় তার সেই ছোট্টো এমপির ঘরে । বাবুনি, অজয় প্রতাপ সিং, পিন্টু, সিং দা, জুই, এরা সব সামাল দিত এমপি র অফিস। আর সব কিছু হাসি মুখে সবাইকে চা, টিফিন, ভাত যোগান দিত আমাদের সবার মেজদি যে স্বাতী খোন্দকার। যিনি এখন চন্ডিতলার বিধায়ক। আকবর দার কেন্দ্র থেকেই জয়ী হয়েছেন তিনি এখন।
রাজনীতির উত্থানের সাথে সাথে যে ঘেরা টোপে বন্দী হয়ে যায় নেতারা তেমন খুব একটা অবস্থা দেখিনি আকবরদার ক্ষেত্রে অন্ততঃ। যদিও হুগলী জেলায় তপন দাশগুপ্ত আর আকবর আলী খোন্দকার এর লড়াই ছিল সুবিদিত। তবুও সেই লড়াই এমন পর্যায়ে চলে যায়নি যে খুনোখুনি হয়েছে গোষ্ঠী দ্বন্দ্বের কারণে। যা আজ সব সময় ঘটে নানা দিকে, নানা দলে। যার জন্যে দলের ওপর মহলের নেতারা বার বার সাবধানবাণী শোনান কিন্তু কে শোনে কার কথা।
যাক গে এসব কথা থাক। আসলে এমন গ্রামের চাষী পরিবার থেকে বিধানসভা, লোকসভায় পৌঁছে গিয়েও কেমন যেনো মাটির গন্ধ গায়ে মেখে আকবরদা সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়াতেন এদিক ওদিক, এই গ্রাম, সেই গ্রাম। মিটিং, মিছিল করে শ্রীরামপুরে পল্লীডাক কাগজের প্রবীরদার অফিসে এসে বসতেন সন্ধ্যা বেলায়। কাঠের বেঞ্চে বসে প্লাস্টিক চটি দুটো খুলে আমায় বলতেন এই মুড়ি নিয়ে আয় খাবো খুব খিদে পেয়েছে বলে আমায় টাকা দিতেন। সাথে বাতাসা, চানাচুর আর কোনো দিন মদনের ভেজিটেবল চপ আর উমা মিষ্টান্ন ভান্ডার এর ছানার মুড়কি খেতে খুব ভালোবাসতেন তিনি। সাংবাদিকদের সাথে এক সাথে বসে বিধায়ক, সাংসদ মুড়ি চিবোচ্ছেন তার পর প্লাস্টিকের জগ থেকে ঢক ঢক করে জল খেয়ে শুয়ে পড়তেন কাঠের বেঞ্চে এটা অবশ্যই আজকের রাজনীতিতে একটা বিরল দৃশ্য বলা যায়। এটাই বড় ইউএসপি ছিল আকবর দার।
তারপর শুরু হতো নানা গল্প। যে গল্পের মেঠো গন্ধে ভরপুর হয়ে উঠত সান্ধ্য আসর। সেই গল্প থেকেই তো আমরা জানতে পেরেছিলাম সেই গ্রামের সুকাই চাচার কথা। যে বৃদ্ধ চাচা চন্ডীতলায় গ্রামে বাড়ী বাড়ী ঘুরে চাল সংগ্রহ করে গ্রামের স্কুল তৈরি করছেন নিজের উদ্যোগে। যে চাচার খবর কাগজে, টিভিতে প্রচার হলো আকবর দার দৌলতেই। বিখ্যাত হয়ে গেলেন সেই শুকাই চাচা আর তার গ্রামের স্কুল। এটাই হলো আমার মত ছোটো সাংবাদিকের চোখে আকবর দা।
আসলে রাজনীতির কারবারি মানেই তো শুধু উপর মহলে বিচরণ করা নয়। জীবনের এমন হাজারো সুকাই চাচা, ভজা ,তরুণ পান, বিকাশ, সমীর দা, সবাই ছুটে আসতেন বিপদে আপদে আকবরদার ঘরে। কিন্তু সবাই জানে বড়ো ভাই গাল মন্দ করে দরজা বন্ধ করে দেবে না। দাঁত মুখ খিঁচিয়ে কোনো দিন ঘর থেকে বের করে দেবে না। যার কাছে গেলে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে থাকা যাবে দু দণ্ড। যে মানুষটা ফিরিয়ে দেবে না তাদের কোনো দিন। এটাই হলো আসল কথা। মমতার পাশে থেকে বা গ্রুমের মাটি কেটে উঠে আসা এই মানুষটা বোধহয় তাই নেতা হলেও কর্মীদের ভুলে যায়নি কোনো সময়। যার জন্য আজও বোধহয় অনেক বর্তমানের সব দাপুটে নেতারা ভাবেন, মনে করেন তাঁকে। যার হাত ধরে আজ তাদের রাজনৈতিক উত্থান।
তবে এত সব কথার মাঝে যে কথা গুলো না বললে শান্তি পাবো না আমি কোনো দিন। আমি ছোটো কাগজের একজন সাংবাদিক হলেও কোনো দিন দুর ছাই করেন নি তিনি। তাই বোধ হয় যেদিন আমার পায়ে ছেঁড়া হাওয়াই চটিতে দড়ি বাধা দেখে নিজে চটি কিনে দেবার কথা বলেন আমি খুব লজ্জা পেয়েছিলাম সেদিন। সবার আড়ালে নিয়ে গিয়ে বললো শোন আমি তোর দাদার মত লজ্জা কি রে। সেই লাল সবুজের হাওয়াই চটি পড়ে আমি কতদিন ঘুরেছি আজ মনে পড়ে গেলো সেই কথাটা। মার অসুখ হয়েছে শুনে গোপাল ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে দেবার কথাও কি ভোলা যাবে কোনো দিন। খবর নিতেন কিরে মাসীমা ভালো আছেন তো। আসলে জীবনের এই সব অভিজ্ঞতা ভোলা যায় না কিছুতেই। বর্তমান রাজ- নৈতিক পরিসরে এসব বোধ হয় একদম বেমানান কথা বলছি আমি।
ধীরে ধীরে আমি বড় চ্যানেলে কাজ পেলাম। আমার চাকরী হলো। আকবর দা শুনতে পেলো আমার বিয়ে হবে। দিল্লী থেকে সোজা আমার শ্রীরামপুরের নেতাজী সুভাষ রোডের শশুড় বাড়ীতে এসে হাজির রাত এগারোটায় ফ্লাইট ধরে। সেই পুলিশের সিকিউরিটি সঞ্জয় কে নিয়ে। গৌতম দা, দেবাঞ্জন দা, তরুণ দা, ফাল্গুনী দার সাথে দেখা হলো সেই রাতে আকবরদার। কত হৈ হুল্লোর হলো। তারপর বিয়ের পর দিল্লী যাবার আমন্ত্রণ জানানো হলো আমায়। সিং দাকে বলে টিকেটের ব্যবস্থা করা হলো রাজধানীতে। কিন্তু আমি সেটা প্রত্যাখ্যান করায় মনক্ষুন্ন হলেও কিছু বলেনি আমায় তিনি। এমপি হবার দৌলতে অনেকে দিল্লী গেছিলো সেই সময়। কিন্তু এই যে মিশে যাওয়া এটাই আসল কথা। যা আজকের দিনে দেখাই যায় না একদম।
কিন্তু সেই আকবরদা অসুস্থ হয়ে গেলেন। ভোটের প্রচারে বের হবেন তিনি। আমি আর মিন্টে আমার ক্যামেরাম্যান শেওড়াফুলির ছাতু গঞ্জের বাড়িতে গেছি। শরীর খুব খারাপ সেই সময়। ঘরের মেঝেতে বসে ভাত আর উচ্ছে সেদ্ধ খেতে বসেছেন আকবর দা। মেয়ে বড় কিছুটা। ছেলেটা একদম ছোটো। আমাদের দেখে মেজদিকে বললেন অভিজিৎ এসেছে ওদের ভাত দাও। খেতে দাও কিছু আগে। আমি বললাম না এখন খাবো না গো। তারপর বললেন কেনো খাবি না তোরা।খেয়েই যাবি তোরা বাড়ী থেকে। অনেক কষ্টে মিষ্টি খেয়ে ছাড়া পেলাম আমরা দুজন এটাই আমার আকবর দা। যে এই ভাবে মিশতে জানতো অতি সাধারণ দু পয়সার সাংবাদিকদের সাথে।
তারপর কোন পাঞ্জাবি পড়লে ভালো ছবি উঠবে বার বার দেখতে বলতেন একদম ছোট শিশুর মত যখন বেশ অসুস্থ হয়ে গেলেন। কিন্তু ভালো মানুষদের বোধহয় বড্ড তাড়াহুড়ো করে চলে যেতে হয় পৃথিবী ছেড়ে। সেটাই বোধ হয় বিধাতার বিধি লিখন। আমিও বুঝতে পারি নি যে সত্যিই সেই মাটির গন্ধ মাখা একজন মানুষ যাকে ঘিরে থাকে ঘাস, ফুল,কুঁড়ি, পাতা। যে বড়ভাইকে ঘিরে থাকে ছোটো ভাইয়ের দল ভীড় করে। তাদের সবাইকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেলো আমাদের আকবর দা। সবার বড় ভাই।
হাসপাতাল থেকে আনা হলো তাঁর দেহ। সেই শেওড়াফুলির ছাতুগঞ্জের বাজারে সেই পার্টি অফিসের পাশের মাঠে আকবর দা শুয়ে আছেন। দেখলাম দল মত নির্বিশেষে সকলের চোখে জল। আট থেকে আশি সবাই কাঁদছে। আমিও সেদিন কেমন ডুকরে কেঁদে উঠে অস্ফুটে বললাম ফিস ফিস করে তুমি চলে গেলে দাদা। যে কাঁধে হাত দিয়ে বলেছিলে লজ্জা কিসের আমি তোর বড় দাদার মত।
আজকের এই ভোটের বাজারে বড়ো বেশি করে মনে পড়ে গেলো তোমার কথা। তুমি ভালো থেকো
আকবর দা। যেখানেই থাকো তুমি ভালো থেকো। আরও অনেক কথা লেখার ইচ্ছা হলেও পারলাম না লিখতে আর। ভালো থেকো তুমি। ছোটো একজন সংবাদ কর্মী হয়ে আজকের দিনে তোমায় বড়ো মনে পরে গেল আমার এই ভোটের বাজারে। যে বাজারে তুমিও আজ নেই। আর আমিও আর সংবাদ কর্মী নেই। কিন্তু তোমার সেই অকৃত্রিম ভালোবাসা আজও ছড়িয়ে আছে আমার মধ্যে। তাই আজ কিছু কথা লিখে ফেললাম। ভালো থেকো তুমি আকবর দা।
আকবার দা ভালো থেকো - অভিজিৎ বসু।
বারই এপ্রিল, দু হাজার চব্বিশ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন