আসলে এই সাদা জীবনের কালো কথায় নানা গল্প নানা চরিত্র ভীড় করে আসে আমার এই দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনে। হাজার ভিড়ের মাঝে লুকিয়ে থাকে ছোটো বড়ো নানা ধরনের মনিমানিক্য। আবার সমুদ্রের মাঝখান থেকে সমুদ্র মন্থনে উঠে আসে অমৃতের বদলে মাঝে মাঝে গরল। যার স্বাদ আস্বাদন করে কখনও মন খারাপ হয়। আবার কোনো সময় মন ভালো হয়। তাই বলে কি আর ভোলা যায় সেই সব কথা ঘটনা যা আজও স্মৃতির পাতায় উত্তাপ ছড়িয়ে দেয় এই এত দিন পরেও। যার রসে আমি জারিত হই এই বুড়ো বয়সেও। এমন কিছু জীবনের পুরোনো কথা নিয়েই তো আমার এই লেখা। যা জীবনের নানা রঙে রঙিন হয়ে আছে আঁকাবাঁকা অক্ষরে এই আঁকিবুঁকি নামের ব্লগে।
আজ তেমন একজন রাজনৈতিক মানুষের কথা। যিনি হুগলি জেলার বহু পুরোনো কংগ্রেস ঘরানা থেকে পরে তৃণমূল ঘরানার নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান। হুগলি জেলায় যাকে একসময় আকবর আলি খোন্দকার এর মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখা হতো। সেই বার বার হেরে যাওয়া নেতা যখন অনেক কষ্টে ভোটের ময়দানে জয়লাভ করলো আমার বেশ ভালো লাগলো। বার বার জীবনের লড়াই, ভোটের লড়াইতে হারতে হারতে এই যে জিতে যাওয়া বেশ আনন্দ দিলো আমাদের মানে সাংবাদিকদেরও। কারণ জেলার এক নেতা ঘোড়ায় চড়বে আর অন্য নেতা হেরে মরবে এটা কেমন যেনো লাগতো আমার।
ধীরে ধীরে জয়লাভের পর তাঁর দাপট বেড়ে গেলো অনেক। সেটাই স্বাভাবিক নিয়ম রাজনীতির ময়দানে। আর নেতা মন্ত্রী হলে তো কথাই নেই। কিন্তু এমন আমার মনে হয়নি তার সেই প্রথম জীবনের সেই সিপিএমের বিরূদ্ধে লড়াই আর দৌড় দেখে। জেলা সদর শহরের সেই বার বার হুংকার দেওয়া নেতা ও তাঁর দলবল যে চুঁচুড়া শহরের নিয়ন আলোয় আলোকিত হতো সেটা বুঝতে কষ্ট হতো না সিপিএমের। আর তাই জেলা সদর শহরে এমন লড়াই করা নেতাকে পেয়ে কিছুটা সুবিধা ভোগ করতো বাম পার্টিও।
সে যাই হোক চুঁচুড়ার বড়বাজারের পার্টি অফিসে তখন হাজার মানুষের উপচে পড়া ভিড়। জুতোর ভীড়ে হারিয়ে যায় সাংবাদিকদের নিজের জুতোও। গ্রাম থেকে মার খেয়ে ছুটে আসা গরীব ঘরের মানুষদের কাছে একমাত্র মসিহা এই বার বার দল বদল করা এই ডাকাবুকো নেতা। জেলায় একদিকে রাশ আলগা হচ্ছে সিপিএমের ধীরে ধীরে । অন্য দিকে চুঁচুড়া, পাণ্ডুয়া, ধনেখালী, পোলবা, রাজহাট, ব্যান্ডেল , চন্দননগর, এই সব এলাকায় ছুটে বেড়াচ্ছেন হুগলি জেলার এই দাপুটে নেতা। যাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে আকবর আলী খোন্দকার এর বিরোধী পক্ষের একটা নকল ছায়া যুদ্ধ। যে যুদ্ধকে সামনে রেখে সংবাদ মাধ্যমে বার বার খবর হয়েছে। হুগলী জেলার এই দুজনের লড়াই তে কিন্তু ফায়দা তুলেছে সিপিএম।
সে যাই হোক যে গল্প বলার জন্য আজ এই লেখার চেষ্টা করা। যদিও সাংবাদিক বৎসল এই নেতার কাছে এসে কাউকেই খালি হাতে ফিরতে হয়নি কোনোদিন। হাসি মুখে তিনি নিজের সাধ্যমতো সাহায্য করতে পিছপা হতেন না। সে খবর আর খাবার যাই হোক। এমন ভালো মনের উদার বন্ধু ভাবাপন্ন নেতা মেলা দুষ্কর। সেই নেতার পোড়া কপাল খুলে গেলো একদিন হঠাৎ। বিধানসভার প্রবেশের ছাড়পত্র মিলে গেলো তার। নেতা থেকে বিধায়ক হলেন তিনি। দলে গুরুত্ব বাড়লো তাঁর। মন্ত্রী হলেন তিনি। নীল বাতির গাড়ি জুটলো। ফাইল আর ফুলে ভরে গেলো সেই বহু পুরোনো কংগ্রেসী আমলের সেই চুঁচুড়ার পার্টি অফিস।
সেই আমাদের চেনা দাদার অফিসে তখন উপচে পড়া ভিড়। উপচে পড়া চটির ভান্ডার। আমার বেশ ভালো লাগতো দেখে। এত দিন লড়াই করা একজন নেতাকে এই ভাবে তার রাজনৈতিক উত্থানের ময়দানে তাঁর চওড়া হাসি মাখা মুখ দেখে বেশ ভালো লাগতো সত্যিই বলছি। সাদা জামা আর পাঞ্জাবিতে বেশ একটা গর্বের ঝলকানি দেখতাম দুর থেকে আমিও। যদিও সাংবাদিকদের কাছে সুসম্পর্ক রাখা নেতা কোনো সময় সেই বদলে যাওয়া রূপ ধারণ করেননি কোনো দিন। সেটা অবশ্য করেও না কেউ রাজনীতির মাঠের লোকরা। তারা জানে সামনে আর ভিতরে এই দুই এর ফারাক রেখেই হাসি মাখা মুখে চলতে হবে তাদের।
সে যাই হোক জেলার মন্ত্রীর কাছেই তাই জীবনে প্রথম বার যার ভুল করে একটু চলে গেলাম নিজের একটা প্রয়োজনে। ভাবলাম কি আর আছে এত দিনের পরিচয় আমার সাথে। নিশ্চয়ই আল্লা আর ভগবান এর মত দরাজ এই নেতা সাহায্য করবেন আমায়। দরজা বন্ধ তো করে দেবেন না। মুখের ওপর বলে দেবেন না এসব করতে পারব না আমি। কিছুটা সঙ্কোচ আর কিছুটা নিজের দরকারে চলে গেলাম তার সেই ভীড়ে ঠাসা চুঁচুড়ার অফিসে। সেই সময় যদিও আমি একটি জনপ্রিয় টিভি চ্যানেলে কাজ করি।
তবু ভাবলাম আমি দেখি না সবাই তো সাহায্য নেয় নেতা মন্ত্রীদের কাছে কি আর হবে না হয় একটু জেলায় কথা হবে। হাসাহাসি করবে সবাই বলবে দেখ দেখ ঐ মালটাও বড়ো বড়ো কথা বলে মন্ত্রীর থেকে নিজের বাড়ির লোকের এই কাজের সুযোগ নিয়েছে চুপিসাড়ে। আসলে এটাই বোধহয় সাংবাদিক সাদা জীবনের সব থেকে বড়ো ভুল কাজ হয়েছিল আমার। আমার সাথে ছিল সেই সময় আরো এক আমার চুঁচুড়া শহরের বন্ধু এক সাংবাদিকও।
মন্ত্রীর ভীড় অফিসে তখন উপচে পড়া লোকজন। কোনরকমে পাশ কাটিয়ে ঠাণ্ডা ঘরে ঢুকলাম আমরা সাংবাদিক হবার সুবাদে। আমতা আমতা করে দিলাম একটা বায়োডাটা আর বললাম একটু যদি দেখে দাও তুমি তাহলে আমার একটু উপকার হয়। একটু বিপদে পরেই এসেছি আমি। মন্ত্রীর দু হাতের দশ আঙুলে তখন হাজার তারার ঝিকিমিকি হাসি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছে। আরে দাদা কি যে বলো তুমি এসেছো এটাই অনেক বড় ভাগ্য আমার। এই পাঁচু এই বায়োডাটা আমার নিজের ফাইল বন্দী করে রাখ। কলকাতা গিয়ে এটা করে দিতে হবে দাদার নিজের লোকের কাজ এটা। চিন্তা করো না তুমি। এই মিষ্টি দে। চা দে দাদাদের।
আর সেই সময় দরজা ঠেলে এক ব্যক্তির প্রবেশ। দাদা তারাপীঠ গেছিলাম মার কাছে পূজো দিয়ে এসেছি তোমার নামে। ফুল আর এই মার মুর্তি এনেছি তোমার মঙ্গল কামনায়। দে বলে সেই মা তারার মুর্তি নিয়ে নমস্কার করলেন মন্ত্রী। আর সেই মার মুর্তি তুলে দিলেন আমার হাতে। বললেন মাকে ঘরে নিয়ে যাও সব কষ্ট দুঃখ কেটে যাবে। মা সব কষ্ট দুর করবেন।
আমরা সেই মাকে বুকে নিয়ে চলে এলাম ঠাণ্ডা ঘর থেকে বেরিয়ে হাসি হাসি মুখে। ভাবলাম নিশ্চয়ই বন্দোবস্ত হবে একটা কিছু। মাকে এনে সিংহাসনে বসালাম। বললাম জয় মা তুমি নিজেই ঘরে এসেছো। নিজের ইচ্ছায় এসেছো, মঙ্গল করো মা সবার। শনি বার মার গলায় জবার মালা দিয়ে সেই কথাই বলতাম আমি। দেখতে দেখতে দিন গড়িয়ে গেল। বছর গড়িয়ে গেলো। চুঁচুড়া শহরের গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেলো। সেই মন্ত্রীর চেয়ার টেবিল বদলে গেলো ধীরে ধীরে।
আজ তিনি আর মন্ত্রী নেই নিজের সরকারে। ভীড় নেই তাঁর সেই অফিসে। খাঁ খাঁ করছে সেই বিখ্যাত চুঁচুড়া শহরের সেই অফিস। নেই নীল বাতির আলোয় আলোকিত সেই পথ ঘাট। যে মন্ত্রীর ভাই এর আলোয় আলোকিত হতো গোটা চুঁচুড়া শহর সেই দাপুটে তাজা ভাইও কেমন মিইয়ে গেছে শ্রীরামপুর থেকে উড়ে আসা চুঁচুড়াতে অন্য এক নেতা বিধায়ক হবার পরে।আর আমিও এখন সংবাদ মাধ্যমে কর্মরত নেই।
আসলে রাজনৈতিক জীবনের এই ওঠা নামা সব হলো গঙ্গার জলের মত। এই ঢেউ আসছে জোয়ার আসছে আবার একটু পরেই ভাটা পড়ে যায়, ভীড় কমে যায়। নদীর তীরে পড়ে থাকে এমন কিছু ঘটনা। যে ঘটনার ঘনঘটা আমায় জড়িয়ে ধরে এই ভোরবেলায়। মনে মনে ভাবি সত্যিই তো জীবনের এই ভুলটা না করলেই বোধ হয় সব চাইতে ভালো হতো।
মাঝে মাঝে ফোন করি আমি সেই নেতাকে আজও। সেই উদার গলায় আহবান জানান তিনি। বলেন দাদা ডায়রী পড়ে আছে তোমার নিয়ে যেও। পূজোর জামা কাপড় আর শাড়ি পরে অপেক্ষা করছে নিয়ে যেও তুমি। আমি ফোনের ওপর প্রান্ত থেকে হেসে বলি নিশ্চয়ই যাবো একদিন তুমি রেখে দাও সব কিছু। তার সেই মন্ত্রীত্ব নেই, রাজ্য নেই, রাজ্য পাটও আর নেই। কিন্তু সেই ফাইল আছে। সেই ফাইল বন্দী হাজার আবেদন নিবেদন আছে। আর তার ফোন ছেড়ে মনে মনে হাসি আমি। আর মনে মনে জয় মা তারা বলে মাকে কর জোড়ে দু হাতে নমস্কার করি। মা মিটি মিটি আমার দিকে তাকিয়ে হাসেন। আর বলেন এমন ভুল আর যেনো না হয় বাবা। সাধু সাবধান। মার সেই মূর্তির কাছে চুপ করে মাথা নিচু করে আমি দাঁড়িয়ে থাকি।
এক মন্ত্রী ও মা তারা মুর্তি - অভিজিৎ বসু।
উনিশে জুলাই, দু হাজার চব্বিশ।
চমৎকার।
উত্তরমুছুন