ভীড় ট্রেনের কামরায় ওকে দেখে আমার গুপি বাঘার সেই পুরোনো ছবির গানটার কথা মনে পড়ল।
ভূতের রাজা দিলো বর।
জবর জবর তিন বর।
এক দুই তিন, এক দুই তিন।
সেই বিখ্যাত ঢোল কাঁধে ভুতের রাজার বর পেয়ে কি খুশি হয়েছিল গুপী আর বাঘা। দুজনেই ভূতের রাজার বর পেয়ে আনন্দে আত্মহারা তারা। খুশি মনে ঢোল পিটিয়ে চলেছে মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বাঘা এক মনে। চোখে মুখে আনন্দের শিহরণ। কি অদ্ভুত বাঘার হাতের জাদুতে সুরের মূর্ছনা ছড়িয়ে পড়ছে গোটা আকাশ বাতাস জুড়ে। সেটা শুনে গুপী গায়েন গান ধরে মনের আনন্দে।
ভুতের রাজা দিলো বর।
জবর জবর তিন বর।
এক দুই তিন, এক দুই তিন।
ভুতের রাজার বর পেয়েই তো তারা সেদিন ভুখা পেটে পেট পুরে নিজের উদর পূর্তি করেছিল। জুটেছিল মন্ডা, মিঠাই ,কালিয়া আর কোপ্তা। তারপর গুপি আর বাঘা সারাটা জীবন আরাম কেদারায় পা ঝুলিয়ে বসে বাকি জীবন সুখে কাটিয়েছিল। তার সাথে উপরি পাওনা জুটেছিল রাজকন্যাও দু জনের। সত্যিই বড়ো লাভবান হয়েছিল তারা দুজনই ভূতের রাজার বর পেয়ে।
কিন্তু ওর ভাগ্যে বোধ হয় সেই ভূতের রাজার বর জোটেনি নিশ্চয়ই। সেটা জুটলে হয়তো এই কষ্ট করে ওকে ঢোল পিটিয়ে, ভীড় ট্রেনে পেটের ক্ষিধে মেটাতে লোকের কাছে হাত পাততে হতো না। না হলে কি আর এই লোকাল ট্রেনের উপচে পড়া ভীড় ঠেলে ওকে ঢোলের তালে, ব্যালেন্সের খেলা দেখিয়ে লোককে খুশি করতে হয়। হাত পেতে বলতে হয়, বাবু দেখবেন একটু।
এই ছোটো বেলা থেকেই খুশি করার আসল খেলায় নামতে হয় ওকে। আসলে খুশি করার সুবাদে কিছু পাওয়ার আশা থাকে। জীবনের পরতে পরতে, বিভিন্ন ভবেই এই খুশি করার প্রক্রিয়া চলতে থাকে।অফিসের বসকে খুশি করা,স্কলের দিদিমনিকে ছাত্রীর খুশি করা, সংসারে বৌমার খুশি করা শ্বাশুড়িকে। রাজনৈতিক নেতাদের খুশি করা। এই ভাবেই চলে খুশি করার প্রক্রিয়া।সেই খুশি করেই ও মন ভেজানোর চেষ্টা করে। যা দিয়ে ওর ছোট্ট পেট ভরে কোনো রকমে। সেই আশাতেই ওর এই ছোট্ট ট্রেন সফর।ওর জীবনের সফরটা লম্বা,কিন্তু এই ট্রেন সফরটা খুব ছোট।
বিধান নগর স্টেশনে তখন অফিস ফেরত যাত্রীদের ভীড়। ভীড় ট্রেনে ঠেলে ঠুলে উঠে কোনো রকমে বসার সিট জোগাড় করার প্ল্যান করতে করতেই নাজেহাল অবস্থা যাত্রীদের। ট্রেনের কামরায় উঠেই এদিক ওদিক দৌড় দৌড়ি যাত্রীদের।
আর সেই সময় ওই ভূতের রাজার বর না পেয়ে ওই, ছোট্ট মেয়েটি। কি খুশি মনে অবলীলায় কোনো দৌড় প্রতিযোগিতায় নাম না লিখিয়ে ধীরে সুস্থে ট্রেনে ওঠে ওই মেয়েটি। যেনো কোনো তাড়া নেই ওর জীবনে আমাদের সবার মত।
পিঠের ঢোল আর হাতের লাঠিকে সামলে ধীরে সুস্থে ট্রেন ধরে সে। আমি ওর এই ধীর জীবনের এই ব্যালেন্সের খেলা দেখে সত্যিই বিস্মিত হয়ে যাই ট্রেনের সিটে বসে। কী নিশ্চিত ছোট্ট ট্রেন সফর ওর। আমিও যদি ওর মতই না লাফিয়ে,না ঝাঁপিয়ে একটা নিশ্চিত সিট পাওয়ার আশায়, না দৌড়ে এই জীবনটা কাটাব বলে ভাবতে পারতাম। কি ভালই না হতো মনে হয় তাহলে।
আসলে আমরা এসব ভাবি , কিন্তু পারি কই। যা ঐ ছোট্ট মেয়েটা পারে,অবলীলায় ছোট্ট রিং এর মধ্যে শরীর ঢুকিয়ে দিয়ে এক হাতে ঢোল বাজিয়ে যেতে অবিরাম গতিতে। ওর ঢোলের আওয়াজে আমার বুকের ভেতরটা যেনো দম দম করে কে যেনো হাতুড়ি পেটে। কী যেনো একটা অদ্ভুত অবস্থা হয় ভীড় ট্রেনে বসে থেকেও আমার। একটা অস্বস্তি ঘিরে ধরে আমায় চারিদিক থেকে।
বুঝতে পারি না কেনো, ওর ওই ছোটো হাতে লাঠি পেটার আওয়াজ খান খান করে দেয় আমার শরীর আর মনকে। ওর মাথার বিনুনী দুটো, ঢোলের আওয়াজের সাথে তাল মিলিয়ে দুলতে থাকে আমার চোখের সামনে। ঠিক ফনা ওঠা সাপের মতো দুলতে থাকে।
ওর কাজল কালো চোখে, আর মুখে তখন ট্রেনের জানলা দিয়ে বিকেলের পড়ন্ত শীতের মিঠে রোদ লুটোপুটি খাচ্ছে। কী সুন্দর লাগছে ওকে দেখে। ওর ঠোঁট জুড়ে অদ্ভুত সরল হাসির ছটা।
ওর কাজল কালো চোখ মেলে দীঘল চোখে আমার দিকে তাকান দেখে, আমার কেমন যেনো ভয় ভয় লাগে। ওর দিকে তাকিয়ে দেখার সাহস হয় না আমার। এক অদ্ভুত আওয়াজ গোটা ট্রেনের কামরায় ছড়িয়ে পড়ছে। ওর চোখের দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখার সাহস পাইনা আমি।ঝম ঝম করে ট্রেন ছুটে চলে দক্ষিণেশ্বর ব্রীজের উপর দিয়ে। ঘাড় ঘুরিয়ে মার মন্দিরের দিকে তাকিয়ে প্রনাম জানাই মাকে হাত জোড় করে।
কিন্তু ওই ছোটো মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দেখতে, কেমন ভয় পাই আমি। ভয়টা কিসের জন্যে, তা বুঝতে পারি না আমি কিছুতেই। কিন্তু সে অবলীলায় আমার কোল ঘেঁষে এসে দাঁড়ায়। কী নিষ্পাপ চাওনি দিয়ে আমার কাছ ঘেঁসে দাঁড়িয়ে থাকে সে। এক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে আমার ক্ষয়ে যাওয়া, হেরে যাওয়া মুখের দিকে। মনে হয় ও আমার সবটা দেখছে,অন্তর আর বাহির।
ওর গলায় ঝুলে থাকা গোল রিং টাকে আমি আলগোছে দেখি। ওর মুখের দিকে না তাকিয়ে। দেখি কি সুন্দর গোল বড়ো মাকড়ির মত গোল রিং টা ওর সরু গলায় ঝুলে আছে। ঠিক যেনো সাদা রাজহাঁস এর গলায় চলকে পড়ছে জলের ফোঁটা।
ওকে যেনো আরো সুন্দরী করে তুলেছে সেই গোল রিং। ছোটো ছোটো দাঁতের মিষ্টি হাসিতে উপচে পড়ছে ওর নিস্পাপ মুখ।কালো রঙের জামায় ওকে যেনো ঠিক ভূতের রাজার মতই লাগছে আমার। একদম চুপ করে আমার কাছ ঘেঁসে দাঁড়িয়ে আছে সে। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
নীরব দৃষ্টিতে যেনো বলছে আমায়,কি চাই তোমার বলো। আমার মত থাকতে চাও নাকি তুমি। না দৌড়ে, না কোনো প্রতিযোগিতায় সামিল হয়ে। বিন্দাস জীবন কাটাতে চাও তুমি। আমি চুপ করে বসে থাকি। ভাবি কি উত্তর দেব আমি ওর কথার।
ও ফিস ফিস করে বলে কেউ শুনতে পাবে না গো,বলো তুমি। কী চাও বলো আমায় চুপি চুপি। আমি ওর কথার কোনো উত্তর দিতে পারি না। চুপ করে বসে শুনি আমি। এই কথা তো কেউ বলেনি, আমায় কোনো দিন আগে। দৌড়তে পারছি না বলে ,বলেছে অনেকেই। বলেছে তুমি পারছো না তাল মিলিয়ে দৌড়তে সবার সাথে। তুমি ধীরে ধীরে বাতিল হয়ে যাচ্ছ সব জায়গায়। কিন্তু ওর মতো এই ভাবে, তো বলেনি এমন গভীর যত্নে, চুপি চুপি।
আমি কেমন যেন হয়ে যাই ওর কথা শুনে। তাহলে কি ও বুঝতে পেরেছে এই লোকটা দৌড়তে পারে না আর। বাতিল হয়ে গেছে। কিন্তু মাঠে নামার স্বপ্ন দেখে আজও এই বুড়ো বয়সে। ভাবে বেঁচে থাকার লড়াইতে আবার আগের মতই লাফাতে পারবে সে। বাঁচাতে পারবে পরিবারকে,পরিজনকে কিন্তু পারে না। আর তাই নিজের না পারাকে বুকের ভেতর লুকিয়ে রেখে ঘুরে বেড়ায় সে, চোরের মত দিনের আলোয় গোপনে লুকিয়ে লুকিয়ে একা একা নিঃসঙ্গ হয়ে।
তাই ও এত ভালোবেসে এমন কথা বললো আমায়। আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি। ওর চোখে মিটি মিটি দুষ্টুমির হাসি। বলে চলো, আমি নামবো তুমিও নামবে তো এই স্টেশনেই। ধীর পায়ে ট্রেন থেকে নামি দুজনেই।
ও ঘাড় ঘুরিয়ে আমায় দেখে এগিয়ে যায়। স্টেশনের একটা ফাঁকা সিটে বসে পড়ে সে। হাতে পাওয়া পয়সাগুলো গুনে ঝোলায় পুরে দেয়। আর বসে থাকে সে পরের ট্রেনের অপেক্ষায়। আমি ওকে স্টেশনে ফেলে এগিয়ে চলি নিজের গন্তব্যে।
ও বসে থাকে নিশ্চিন্তে, পরের ট্রেনের জন্য। সুয্যি মামা ডুবে যায় গাছের ফাঁকে আলতো ছোবল দিয়ে। উত্তুরে হাওয়া অনুভব করি আমি। ও নিশ্চিত হয়ে বসে থাকে পরের ট্রেনের জন্য। উত্তরের হাওয়াকে গায় মেখে একা আনন্দে বসে থাকে ফাঁকা স্টেশনে।
আমি আবার হারি ওর কাছে। ধীর পায়ে এগিয়ে চলি ওকে ফেলে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি আপন মনে খেলে চলেছে ও। জীবনের হিসেব নিকেশ এর খেলা নয়। পরের ট্রেনের অপেক্ষায় থাকার মাঝে একটু অন্য খেলা।
যে খেলায় মগ্ন হয়ে থাকতে পারলেও অন্তত আমায় এই ভাবে লুকিয়ে বাঁচতে হতো না সবার কাছে। ওর মতই বুক ফুলিয়ে বেঁচে থাকতে পারতাম আমিও নিশ্চিত হয়ে। কোনো ট্রেনের অপেক্ষায়।
ওর কাঁধে ঝোলা রঙিন ঢোলের আওয়াজে আমি ভরিয়ে দিতাম আমার শুন্যতায় ভরা জীবনটা। ঢোলের আওয়াজে ভরে উঠতো আমার ফাঁকা, নিঃস্ব, রিক্ত হয়ে যাওয়া জীবনটা।
ঢোল বাদক - অভিজিৎ বসু।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন