ওরা পাশাপাশি সব এক হয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একদম স্থানুবত চেহারা নিয়ে। শীতের আমেজ গায়ে মেখে রোদ পোহাচ্ছে ওরা। একদম নিঝুম দুপুরে ওদের দেখে আমার ভারী হিংসে হয়। কী অনাবিল সুখের আনন্দকে বুকে চেপে ওরা এক জন ওপর জনের দিকে তাকিয়ে আছে। সেই তাকিয়ে থাকার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই কোথাও। নেই কোনো বৈরিতাও।
একদম নিশ্চিত হয়ে,একে অপরকে পাশে নিয়ে বেঁচে থাকা। বহুদিন ধরে, বহু বছর ধরে টিকে থাকা। কবে যে এই ভাবে সব একসাথে থাকা, ওদের শুরু হয়েছিল কে জানে। কে কোথা থেকে এসে জড়ো হয়েছিল তাও আজ আর মনে নেই ওদের।
শুধু এটুকু মনে আছে সন্ধ্যামালতীর পাশে কলকল্লোল এসে ঘর বেঁধে ছিল বহু বছর আগে। গুলঞ্চ - এর পাশে আপনমনে হাজির হয়েছে শ্রীমতী। আর একটু দূরে চুপ করে আশাবরী তাকিয়ে আছে কমলা রঙের রোদ্দুর এর দিকে। একটু লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে তাকে একটু লজ্জা সরম নিয়ে দেখা আর কী। যেনো প্রথম দেখা প্রেমের মতই।
প্রথম প্রথম তো খুব অস্বস্তি হতো দুজনের। ধীরে ধীরে সেটা অনেকটা কেটে গেছে এখন। এতো দিন পর পাশে থেকে,অনেক সহজ সরল হয়েছে ওদের দুজনের সম্পর্ক এখন। অবনপল্লীর চয়নিকার তো আজও মনে পড়ে যায় ক্ষিতীশ - এর কথা। হৈ হৈ করে এই তো সেদিন ওরা এসেছিল পাশাপাশি। দেখতে দেখতে কত গুলো বছর যে কেটে গেল ওদের। দুজনেই এখন আর সেই অল্পবয়সী যুবক যুবতী নেই।
বলতে গেলে তাদের জীবনের শেষ প্রান্তে এসে পড়েছে তারা সবাই। তবু তারা একে অপরকে জড়িয়ে, অনুভব করে, পাশাপাশি থেকে গেছে বছরের পর বছর এক সাথে।কোনো দিন ঝগড়া ঝাটি হয়নি ওদের। এভাবেই ওদের কেটে গেছে নিশ্চুপ, নিরবতার স্থির জীবন নিয়ে।
পূর্বপল্লীর, তবু মনে রেখো, আনমনা, বনফুল দাঁড়িয়ে আছে নিজের মতো করেই বছরের পর বছর ধরে। রতনপল্লীর কিঙ্কর,লতা পাতা, উপলরাও এই ভাবেই দাঁড়িয়ে আছে নিজের মতো করেই আপনমনে। তবে সব গুলোর মাঝে একদম বেমানান লাগে আমার ওই বেজগাঁ- কে।কেমন যেন বেমানান লাগে ওকে দেখে এসবের মাঝে। তবু ওর তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
একদম নিশ্চিত হয়ে ,সে নিজেই আপন ছন্দে দাঁড়িয়ে আছে নিজের মতো করেই, খুব বেপরোয়া হয়ে। সে যেনো সবার মাঝে নিজেকে বেমানান জেনেও, নীরবে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে মাথা তুলে। তাহলে হয়তো তাকেও সূর্যশিশির, শ্রী মতীরা, আর মোহররা চেপে ধরতো। তাদের দলে টানার চেষ্টা করতো তাকে জোর করে।
বরাবর সে একটু একাই থাকে। তাই অমন সুন্দর সুন্দর বাড়ী গুলোর নাম ফলকের মাঝে সে বেমানান জেনেও নীরবে নিভৃতে দাঁড়িয়ে আছে একটু দূরে সরে ওই বেজগাঁ নামের বাড়ীটা। একা একাই সংগোপনে ওদের সকলের সংসর্গ এড়িয়ে। এই ভাবেই সে কাটিয়ে দিতে চায় বাকি জীবনটা।
সত্যিই বলতে কি সাইকেল চালিয়ে যেতে যেতে বাড়ির সামনের গেটে কোনোটা ঝাপসা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নাম ফলক। আবার কোনো বাড়ির সামনে উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠেছে নাম ফলক। যা দেখে আমি সুখের আবেশে মুখ লুকিয়ে রাখি এই নিঝুম দুপুরে। সত্যিই তো কি সুন্দর নাম নিয়ে ওরা একে অপরের পাশে বেঁচে আছে, কত দিন ধরে।
ঘসা বিবর্ণ দেওয়ালে হেলান দিয়ে শুয়ে বসে ওরা দিব্যি কাটিয়ে দিচ্ছে বছরের পর বছর। কেউ তো জানতে চায় নি ওদের কাছে, ওরা সবাই ভালো আছে তো। নাকি শুধুই একটা নাম ফলক হয়ে দেওয়ালে লেখা হয়েই বেঁচে আছে ওরা। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষাকে সঙ্গী করে।
ওদের বাড়ির মালিকরাও কি ওদের যে পরম যত্নে, মমতায় একসময় এই নামকরণ করেছিল। তারাও কি সেই সব নাম ফলকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে একবার কেমন আছে তারা। তাদের ভালোবাসার ফলক গুলো চুপ করে কেমন করে বেঁচে আছে। যে ভালোবাসার ওম দিয়ে তাদের ভালো-বাসার দেওয়ালে একদিন তারা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য নামকরণ করেছিল। সেই ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকা ফলকগুলোকে, একদিনও কি কেউ গায় হাত বুলিয়ে আদর করেছে কোনো দিন। কে জানে তাই কিছুটা হয়তো অভিমান নিয়েই ওরা বেঁচে আছে চুপ করে বছরের পর বছর একসাথে।
কেউ ফাঁকা বাড়িতে নিঃস্ব রিক্ত হয়ে শুধুই ভালবাসার নাম ফলক কে বুকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছে ওরা। কেউ এক সময় যে বাড়িতে লোক গম গম করতো, সেই কম লোকের বাস করা বাড়িতে নাম ফলক আঁকড়ে বেঁচে আছে। শুধুই ভালোবাসার প্রতীক হয়ে। সাইকেলের প্যাডেলে পা দিয়ে আর জোর করে তাকে টানতে পারছিলাম না আমি।
দুর থেকে দেখলাম আমায় হাত ছানি দিয়ে ডাকছে ওই কমলা রঙের রোদ, নামের বাড়িটা। ধীরে ধীরে আমি সেদিকে এগিয়ে গেলাম। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম সেই কমলা রঙের রোদ লেখা নাম ফলকের দিকে। দু চোখের পাতা জুড়ে শুধুই কমলা রোদের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ছে আমার সারা শরীরে। সেই কমলা রোদের সোনালী উত্তাপে আমার সারা শরীরে আগুন ছড়িয়ে পড়ছে, আর আমি সেই কমলা রোদের সোনালী উত্তাপে দ্রবীভূত হচ্ছি ধীরে ধীরে। আমি আকন্ঠ পান করছি শীতের দুপুর রোদের উত্তাপকে।
ওই বাড়ির দেওয়ালে আমার দু চাকার বাহন কে হেলান দিয়ে রেখে দিলাম। সেও পরম আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেছে অজান্তেই।তারপর ভাবলাম গেটের দরজা খুলে একটু ভেতরে যাই আমি। আরো বেশি করে যদি উত্তাপ অনুভব করা যায় সেই আশায়। কিন্তু না, পারলাম না ভিতরে যেতে। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম গেটের সামনে আর এক মনে দেখতে থাকলাম ওই সুন্দর করে লেখা নাম ফলকটাকে। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। যে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল অমলকান্তি। বুড়ো বয়সে এসে যে রোদ্দুরের স্বাদ পেয়ে আমিও অভিভূত হলাম কিন্তু গেটের ভেতরে যেতে পারলাম না। গেট ধরে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম একা, একদম একা ওদের মতই স্থানুবৎ হয়ে।
নামফলক - অভিজিৎ বসু।
দারুণ।
উত্তরমুছুনবেশ ভাল লাগল।অন্য অনুভবের লেখা।
উত্তরমুছুন