সাদা জীবনের কালো কথায় আজ একুশে জুলাই এর কথা। এই দিন তো বাংলার রাজনীতির ইতিহাসে একটা কালো দিন না ভালো দিন সেটা আজও বুঝে উঠতে পারিনি আমি। যে দিনের দগদগে স্মৃতি আজও জড়িয়ে আছে বাংলার রাজনীতির ময়দানে আনাচে কানাচেতে। লুকিয়ে আছে শহীদ পরিবারের গোপন কান্না আর করুণ আর্তি। হয়তো এত বছর পরেও সেই চোখের জল শুকিয়ে গেছে বহুকাল আগেই। তবু কেউই ভুলতে পারেন নি সেই দিনের স্মৃতি।
তবু সেই 1993 সালের সেই একুশে জুলাই এর রক্তমাখা দিনের কথা কি ভোলা যায়, ভুলতে পারা যায় কোনোদিন। যে দিন পুলিশের গুলিতে 13 জন শহীদ হলেন কলকাতার রাজপথে।রাস্তায় লুটিয়ে পড়লো তেরোটি তাজা প্রাণ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আন্দোলনের প্রথম মাইল স্টোন হলো এই একুশে জুলাই এর আন্দোলন। যে আন্দোলনের রাজনৈতিক ফসল হয়তো তিনি দ্রুত ঘরে তুলতে পারেননি কিন্তু অনেক দিন অপেক্ষা করে সেই ডিভিডেন্ড তিনি অনেক পরে পেয়েছিলেন ভালো ভাবেই।
যুব কংগ্রেসের ব্যানারে সমাবেশ করা হলো। দাবি একটাই ভোটারদের পরিচয়পত্রকে সামনে রেখে ভোট দেওয়ার একমাত্র প্রয়োজনীয় নথি করার দাবি তুললেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যাতে সিপিএমের বৈজ্ঞানিক রিগিংকে রুখে দেওয়া যায় যে কোনো ভাবে, আর তাহলেই তো কেল্লা ফতে। এই ঘটনার কিছুদিন আগেই 1992 সালে অক্টোবর মাসে মমতা বন্দ্যো- পাধ্যায় সেই সময় নরসীমা রাও সরকারের কেন্দ্রের ক্রীড়া ও যুব কল্যাণ মন্ত্রী। সেই সময় বামফ্রন্টের মৃত্যু ঘন্টা বাজিয়ে কমিউনিস্ট বিরোধিতাকে আবার পুনুরুজীবিত করেছিলেন বাংলার এই অগ্নিকন্যা।
ধীরে ধীরে এই ভাবেই 1992 সালের ডিসেম্বর মাসে সেই ফেলানী বসাককে নিয়ে তিনি মহাকরণে নিয়ে যান। শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী এই মহিলাকে জ্যোতি বসুর কাছে নিয়ে গিয়ে ধর্ষনের অভিযোগ করা হয়। কিন্তু সেই মহাকরণের অলিন্দে তাকে পুলিশ হেনস্থা করে বলে অভিযোগ ওঠে সেই সময়। আর এরপরেই তিনি ফের মহাকরণ অভিযানের ডাক দেন। অবাধ ও সুষ্ঠু ভোটের দাবি নিয়ে।
আর আজ এই সব দাবি শুনলে বিরোধীরা তো হেসে কুটোপুটি হয়ে বলেন সেকি এমন দাবিতে সরব ছিলেন তিনি এত দিন আগেও। বলবেন একি শুনি আমরা। যিনি বৈজ্ঞানিক কারচুপি আটকাতে কলকাতার রাজপথে নামলেন। গুলি চলল। বললেন মহাকরণ ঘেরাও করতে হবে। কিন্তু সেই সময়ের মুখ্যমন্ত্রী পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ জ্যোতি বসু বলে দিলেন কিছুতেই রাইটার্স বিল্ডিং ঘেরাও করা যাবে না। পুলিশকে কড়া নির্দেশ দিলেন তিনি। কিন্তু তারপর বাকিটা তো সব ইতিহাস। যে ইতিহাস আমাদের সবার জানা।
আজ সেই একুশে জুলাই এর সভার সব প্রস্তুতি সারা। হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা সেই বাংলার অগ্নিকন্যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই ছবি ছাপা দেখে মনে মনে হয়তো ভিড়ের মাঝেও আনমনা হয়ে যান বাংলার সেই অগ্নিকন্যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এত দিন পরেও। মুখ্যমন্ত্রী হয়ে নিরাপত্তার ঘেরা টোপে বন্দী হয়ে আলতো করে মঞ্চে বসে চায়ের কাপে ঠোঁট ঠেকান তিনি আনমনে।
এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখেন একি গ্ল্যামার বয় মদনের চেহারা এমন হয়ে গেছে কি করে। ও কি আর আগের মত আছে ডাকাবুকো। রং বেরঙর এর জামা পড়ে সেই ওহ লাভলি বলা মদন সত্যিই কেমন যেনো মিইয়ে গেছে। দূর থেকে দেখে কেমন যেনো একটু থমকে যান তিনিও। আর মদন মিত্র মঞ্চে বসে দিদিকে দেখে টেনশনে ঘন ঘন চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ে নিজের টেনশন মোকাবিলার চেষ্টা করে যায়। যাতে তার দিদি বুঝতে না পারে তার আগের শরীর মনের জোর আর নেই। আছে শুধু পুরোনো দিনের স্মৃতি আর কিছু কথা বলে দলের তাজা ছেলেদের চাঙ্গা করার ভোকাল টনিক। দিন বদলে গেছে যে অনেক।
আর ওই যে বক্সি দা যে কবে থেকে তার সাথে এই নানা লড়াই এর সাক্ষী দিনে দিনে সেও কেমন বুড়িয়ে গেছে যেনো। গলায় গলাবন্ধ পড়ে কেমন যেন ঝুঁকে পড়ছে সেও একটু একটু করে ধীরে ধীরে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেমন যেনো আবারো একটু থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন নিজেই। দুর থেকে নবীন প্রজন্মের উচ্ছাস ভরা ডাক দিদি দিদি আমরা এদিকে। আলতো করে হাত বাড়িয়ে দিলেন তিনি যে হাতে পুলিশের লাঠি পড়ে কম জোর হয়ে গেছিলো সেই হাতের পরশ পেয়ে কি খুশি ওই ব্যারিকেডের ওপারের ছেলেটার চোখে মুখে। হাঁটছিলেন আনমনে সেই ধর্মতলার রাস্তায় তিনি। যে রাস্তায় একদিন আজ থেকে বত্রিশ বছর আগে লাঠি,গুলি, ভাঙচুর কত কিছু হয়েছিল সেই রাস্তায় তাঁকে দেখতে আজ কত ভীড়। মনে মনে বেশ ভালই লাগে তাঁর এত দিন পরেও সেই পুরোনো দিনের কথা মনে পড়লে।
অগ্নি কন্যার যে ইমেজ নিয়ে সারা দেশে এখনো তিনি লড়াই করে চলেছেন বিজেপির বিরুদ্ধে সেই ইমেজ তাহলে এখনো কিছু বেঁচে আছে তার। হয়তো কিছু পুরোনো সঙ্গী তার পাশে আজ নেই। নেই আজকে পার্থ চট্টোপাধ্যায়। নেই বালু সেই প্রিয় জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। আরোও বেশ কিছু চেনা মুখ নেই আশপাশে। তাঁর সব সময় পাশে থাকা দলের সেকেন্ড ম্যান সেই মুকুল রায় যে অসুস্থ হয়ে ভর্তি আছেন হাসপাতালে সেও আজ নেই এই মঞ্চে।
সত্যিই কত লড়াই এর সঙ্গী সব ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে তাঁর। তবু একা হয়েও বিদ্যুৎ গতিতে বদলে যায় তার ভাবনা মুখের রেখা। মনে মনে ভাবেন তিনি না, কোনো ভাবেই হেরে গেলে হবে না তাঁর। যে আশা ভরসা নিয়ে দুর দূরান্ত থেকে দিদির পরশ পাথর এর ছোঁয়া পাবে বলে ছুটে এসেছে এই সব অনুগামীরা। যাদের দু চোখে স্বপ্ন। যারা জানে এই স্বপ্নের কারিগর সব করতে পারেন ম্যাজিক করে তাদের নতুন বার্তা দিয়ে ফের স্বপ্ন দেখাতে হবে একমাত্র তাঁকেই।
সেই টানেই তো তাদের ছুটে আসা। আর তিনিও প্রতি বছর এই দিন স্মৃতি চারণ করেন শহীদদের। দুর থেকে ওদের দেখে কেমন যেন আপ্লুত হয়ে যান এই বয়সেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এত দিন পর মনে পড়ে যায় তাঁর সেই মার খাওয়া পুরোনো দিনের কথা গুলো। সত্যিই তো জীবনের এই আন্দোলন, লাঠির ঘা, বিরোধিতা করে এত দূর দৌড়ে এগিয়ে আসা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হোয়ে যাওয়া। এই সব দেখে বেশ তৃপ্তি লাগে তাঁর।
চারিদিকে কত পুলিশ, নিরাপত্তার ঘেরা টোপ। এই সব কিছুকে দূরে ঠেলে দিয়ে একবারের জন্য ওই ভীড়ে হারিয়ে যেতে ইচ্ছা করে তাঁর আজও। বড়ো সাধ হয় সেই বিরোধী আন্দোলনের ঢেউ মাখা দিনগুলোকে আবার একবার কাছে ফিরে পেতে। কিন্তু সব কি আর ইচ্ছা পূরণ হয়। যা ভাবছেন সেই সব কি আর ভাবলেই করতে পারেন তিনি। আজ তিনি মুখ্যমন্ত্রী।
সরকারে থাকার যে অনেক জ্বালা এটা বোধ হয় কিছুটা হলেও বুঝতে পারছেন আজ তিনি মুখ্যমন্ত্রীর ওই চেয়ারে বসে। বিরোধিতা করার থেকে এই চেয়ারে বসা যে অনেক কঠিন কাজ সেটা টের পাচ্ছেন তিনি। সেটা বোধহয় কিছুটা হলেও বুঝতে পারছেন তিনি আজ এতদিন পরেও।
কিন্তু উপায় কি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কে যে হেরে গেলে চলবে না কিছুতেই। পরিস্থিতি যাই হোক যে কোনো ভাবেই পরিস্থিতির বদল করে নিজের অনুকূলে নিয়ে আসতে হবে যে কোনো মুল্যে। এটাই তো তার একমাত্র নিজের প্রতি আস্থা আর বিশ্বাস। যে আস্থা নিয়ে তিনি সব রাজনৈতিক যুদ্ধে জিতে গেছেন। আর সেই জাদুকর ম্যানড্রেক এর মত ম্যাজিক দেখিয়ে নিশ্চয়ই তিনি আবার নতুন বার্তা দেবেন। নতুন স্বপ্ন দেখাবেন আবার।
যে স্বপ্ন দেখে মনে মনে স্বপ্নের কারিগরকে দুর থেকে স্যালুট করবে, প্রণাম করবে আর দুর থেকে চিৎকার করে বলবে দিদি আমরা তোমার সাথে আছি। দিদি দুর থেকে ওদের দেখে মনে মনে হাসবেন। চোখের কোনে জল এসে যাবে তাঁরও। সাদা শাড়ির আঁচল দিয়ে চশমার কাঁচ মুছে আলতো করে হাত নাড়বেন তাদের দিকে তাকিয়ে। আর সেটা দেখে উদ্বেলিত জনতা বাঁধ ভেঙে তাঁর কাছে ছুটে আসবে। ধীরে ধীরে পুলিশের কর্ডন করে তাঁকে নিয়ে দূরে অনেক দূরে চলে যাবে।
একুশে জুলাই - অভিজিৎ বসু।
একুশে জুলাই, দু হাজার চব্বিশ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন