সাদা জীবনের কালো কথায় আজ এক হারিয়ে যাওয়া নেতার কথা। ভোটের বাজারে সেই নেতার কদর ছিল অনেক। যার জন্যে আজকের শাসক দলের এত রমরমা অবস্থা। এর জন্য কিছুটা হলেও তাঁর অবদান আছে বলা যায়। কিন্তু ভোটের এত হৈ হুল্লোড়-এর মাঝে একা একা কেমন আছেন সেই বাংলা রাজনীতির অন্যতম কারিগর মুকুল রায়।
এই বাংলার রাজনীতির চানক্য কে আমার বেশ ভালই লাগত। সাংবাদিকতার সুবাদে এই মানুষটার কাছে যাবার সুযোগ হয়েছিলো আমারও। কি ক্ষমতা, কি দাপট নিয়ে রাজ্যের প্রতি গ্রাম, শহরে, পাড়ায়, মহল্লায় তাঁর নিজের লোক তৈরি করেছিলেন নিজের দক্ষতায় আর ক্ষুরধার বুদ্ধিতে। বর্তমান শাসক দলের সেকেন্ড ইন কম্যান্ড বলে কথা।
ক্ষমতার শীর্ষে বসে তিনি এই ভোটের বাজারে জম জমাট হয়ে থাকতো তাঁর ঘর, বাড়ী, অফিস সব ভীড়ে ভীড় থিক থিক করতো লোকজন। তাঁর আশপাশে ভেনো মাছির মত লোকের ভিড় উপচে পড়তো। তাঁর কাছে যাবার উপায় ছিল না। আজ সেই সেকেন্ড ইন কম্যান্ড কোথায় হারিয়ে গেছেন কে জানে। নিজের ঘরে অসুস্থ্ হয়ে বসে আছেন তিনি দীর্ঘদিন। হয়তো সব খবর পেয়েও চুপ করে বসে আছেন তিনি জানলার দিকে তাকিয়ে। কিছুই করার নেই তাঁর আজ।
আমার আজও মনে আছে সিঙ্গুরে ক্যাম্প করে জাতীয় সড়কের উপর দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের ওপর রাস্তা আটকে আন্দোলন চলছে। সিঙ্গুর জমি বাঁচানোর আন্দোলন।রাস্তা আটকে ক্যাম্প করে পাহাড়া দেবার সময় সবার প্রথম যে ক্যাম্প হয়েছিল সেটার পাহাড়ায় থাকতেন এই মুকুল রায়।
সারাদিন খবর করে রাতের বেলায় ঘরে ফেরার সময় রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞাসা করতেন কি রে খেয়ে যা তোরা সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি তো তোদের কারুর। রাস্তায় তখন খিচুড়ি খাওয়া শুরু হয়েছে। মমতা বন্দ্যো পাধ্যায় নিজের হাতে খাবার পরিবেশন করছেন সবাইকে। সারাদিন আন্দোলন কর্মসূচি সেরে একটু খাবার ব্যবস্থা করা আর কি।
আসলে মুকুল রায় একদম মাটির গন্ধ মাখা একজন মানুষ। যিনি হাতের মুঠোয় সব কিছুকে বেঁধে রাখতে পারতেন নিজের কারিশমায। নাম ধরে ধরে ছোটো, বড়ো, মেজো, সেজো সব নেতাকে চিনতেন তিনি। জানতেন কোন এলাকায় কাকে দিয়ে কোন কাজটা হবে। আর কাকে দিয়ে হবে না কাজ। সেই সাদা পাঞ্জাবি পরা চানক্য এই ভোটের বাজারে আর নেই। একদম উধাও হয়ে গেছেন তিনি। বলা যায় বেপাত্তা হয়ে গেছেন তিনি।
সে শরীর, মন যাই হোক এই ভাবে বসে যাওয়া কি কষ্টের বলুন তো। আশপাশে হুটারের আওয়াজ নেই। পুলিশের স্যালুট নেই। তাঁকে ঘিরে কোনো ভীড় উপচে পড়ছে না আর। তিনি একা একা বসে আছেন ঘরের চার দেয়ালের ভেতর। সত্যিই তো জীবনের এই সব শেষ হয়ে যাওয়া, শিকড় উপড়ে নিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা এটা যেনো কেমনতর। বেশ যন্ত্রণার, কষ্টের।
জেলায় যতবার এসেছেন তিনি রাজনৈতিক দলের খুনের ঘটনায় আমায় ফোনে বলতেন কোথায় আছিস রে তুই। চলে আয় আমি খানাকুল যাবো। দলের মধ্য একটা অসম প্রতিযোগিতা হতো এই সব খুন হওয়া সমর্থকদের বাড়ী গিয়ে কে আগে পাশে দাঁড়াবেন তা নিয়ে। আর সেই প্রতিযোগিতায় পার্থ চট্টোপাধ্যায় আর মুকুল রায় দুজনেই দৌড়ে সামিল হতেন কে আগে যাবেন তার প্রতিযোগিতা ছিল দেখার মত। আমরা সাংবাদিকরা সেটা নিয়ে কম মজা করিনি।
কিন্তু মুকুল রায় এর এই অভিজ্ঞতা, দলের ওপর নিরঙ্কুশ আধিপত্য বিস্তার, সব মিলিয়ে তিনি দলের সব কিছু কন্ট্রোল করতেন নিজের রিমোট কন্ট্রোলে। সে টিকিট বিলি করা হোক। দলের নির্বাচনে কোন স্ট্র্যাটেজি কাজে লাগানো হবে সেটা নিয়ে তার কথাই ছিল শেষ কথা। এই ভাবেই তিনি নিজের হাতে সব কিছু সামলে গেছেন।
আর আজ এই হৈ চৈ হুল্লোড়ের মাঝে একদম একা একা ঘরে বসে আছেন সেই রাজনীতির কিং মেকার মুকুল রায়। এটাই জীবনের আসল প্রাপ্তি। যে এক সময় হটাৎ করে ক্ষমতার মসনদে বসে ছড়ি ঘোরাচ্ছে সেই আজ কেমন একঘরে হয়ে অন্ধকারে তলিয়ে গেছেন একা একা চুপি চুপি। বাম রাজনীতির চাণক্য যদি হন অনিল বিশ্বাস। তাহলে বিরোধী রাজনীতির চাণক্য অবশ্যই মুকুল রায়।
জীবনের সাধারণ আম জনতার এই অভিজ্ঞতা নেই। কিন্তু উচ্চ শিখরে আরোহণ করা রাজনীতির ময়দানের এই সব কুশীলবদের সেটা আছে। জীবন তো এমনই। তৃণমূল কংগ্রেস ছেড়ে মুকুল রায় এর বিজেপিতে চলে যাওয়া। তার পর আবার তৃণমূলে ফিরে আসা। এটাও বোধহয় ভালো চোখে নেয়নি সাধারণ মানুষ।
বিজেপিও এই নেতাকে দলে পেয়েও কাজে লাগাতে পারে নি বা হয়তো চায় নি তারা এই চানক্য কে কাজে লাগাতে। যদি এই নেতা নিজের দক্ষতায় দিল্লির দরবারে হাজির হয়ে যায় নিজের ক্ষমতার জোরে। তাই তাঁকে আটকাতে নানা ছক কষা শুরু হয় যায় প্রথম থেকেই। কিছুটা হলেও পরে বোধ হয় এটা নিয়ে কিছুটা আফসোস তাঁর ছিল। পুরোনো দলে তৃণমূলে ফিরে এলেও আগের সেই জায়গা বিশ্বাস যোগ্যতা আর পাননি তিনি কোনো দিন।
সব মিলিয়ে বাংলার রাজনীতির চাণক্য আজ একদম একা হয়েই বেঁচে আছেন। যেখানে ভোটের বাদ্যি নেই। যেখানে হাজার মানুষের ভিড় নেই। হুটারের আওয়াজ নেই। সবুজ-গেরুয়া আবিরের কোনো হাতছানি নেই। শুধু দিন যাপন আছে। দিন রাত্রি আছে। আর একা একা ঘরে বসে পুরোনো দিনের স্মৃতি জড়িয়ে ধরে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা আছে। ভালো থাকবেন মুকুলদা আপনি। একা একাই ভালো থাকবেন আপনি, সব সময়।
মুকুলদা ভালো থাকবেন - অভিজিৎ বসু।
এগারই এপ্রিল, দু হাজার চব্বিশ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন