সাদা জীবনের কালো কথায় আজ এক জেলার জেলা সভাধিপতির ভয় পেয়ে নিজের কাছে অস্ত্র রাখার লাইসেন্সের আবেদনের গল্প। বাম আমলে হুগলীর এই ডাকাবুকো জেলা সভাধিপতি ভয় পেয়ে নিজের কাছে অস্ত্র রাখার আবেদন খোদ জেলা শাসকের কাছে। হুগলীর সেই দাপুটে জেলা সভাধিপতি হলেন অসিত পাত্র।
হুগলি জেলার পুরশুড়ায় থাকতেন এই নেতা। হাসি খুশি এই সিপিএমের নেতার কিসের ভয় কে জানে। আচমকাই ভয়ের চোটে আর নিজের নিরাপত্তার জন্যে খোদ জেলা শাসকের কাছে তড়িঘড়ি করে আর্মস এর লাইসেন্স এর জন্য আবেদন করে বসলেন। সেই সময় হুগলি জেলার জেলাশাসক ছিলেন সুব্রত বিশ্বাস। সালটা 2004 সাল হবে বোধ হয়।
যাই হোক আমার কাছে এলো সেই খবর সোর্স মারফৎ। দ্রুত আর্মস লাইসেন্স যাতে তিনি মানে সভাধিপতি পান সেই ব্যবস্থা যেনো খোদ জেলাশাসক করেন। আর সেই আবেদন করেন জেলা সভাধিপতি জেলাশাসকের কাছে। যে আনোমোফোন জেলায় জেলায় শাসক দিতে পারেন। কিন্তু কারণ কি, সেটা তো জানা নেই।
কিন্তু সাদা গাড়ি করে সব সময় পুলিশ পাহারা নিয়ে ঘুরে বেড়ানো সিপিএম নেতার কেনো যে ভয় ধরলো মনে কে জানে। দলের কাউকে কি ভয় পেয়েছিলেন তিনি গোপনে সেটা জানিনা। এই খবর পেয়ে গুটি গুটি পায়ে আমি হাজির হলাম চুঁচুড়াতে জেলাশাসকের কাছে। এমন খবরের কথা জিজ্ঞাসা করতে তিনি সেটা স্বীকার করে নিলেন কোনো ভনিতা ছাড়াই।
কি কারণ এই আবেদনের সেটা জানা নেই তাঁর।কিন্তু আবেদন এর কথা জানা আছে তার। ক্যামেরায় সামনে বলে দিলেন সেই কথা ডিএম সুব্রত বিশ্বাস। আজ ভাবি কি সহজে এই সত্যিই কথা স্বীকার করার বুকের পাটা দেখিয়েছিলেন সেই জেলাশাসক সেই সময়ে। সেই লাল দুর্গে দাঁড়িয়ে লাল পার্টির এক জেলা সভাধিপতির বিরুদ্ধে। এসব ভাবলেও বেশ ভালো লাগে যে এমন দিন ছিল এই বাংলায় এই সাংবাদিকতায়।
আজ বোধহয় এটা কোনো মতেই সম্ভব নয়। যেখানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে খোদ মহাকরণে বা নবান্নে দাঁড়িয়ে কিছু বলতে গিয়ে হোঁচট খেতে হয় মুখ্য সচিব, ডিজি, স্বরাষ্ট্র সচিবকে বা পুলিশ কমিশনারকে। সেখানে এই রাজ্যে একজন জেলা- শাসক জেলা সভাধিপতির আর্মস লাইসেন্সের আবেদন নিয়ে বাইট দিচ্ছেন নিজের অফিসের চেম্বারে বসে। আর ঠিক তার ঢিল ছোঁড়া দুরত্বে নিজের অফিসে বসে আছেন জেলা সভাধিপতি অসিত পাত্র স্বয়ং।
এটা আজ আপনাদের এই জন্য বলছি এটা ভাবলেও একজন সংবাদ মাধ্যমের কর্মী হিসেবে আমার বেশ ভালো লাগে। একটা গর্ব হয় যে এই রাজ্যে এমন দিন ছিল তাহলে। যেখানে গনতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ কে কেউ ভয় দেখিয়ে ক্ষমতা দেখিয়ে চুপ রাখতে পারেনি। এমনকি একজন জেলাশাসক ও ভয় পেয়ে মুখ বন্ধ করে বসে থেকে মিডিয়াকে এভয়েড করে বলেন নি এই ব্যাপারে কিছু বলা যাবে না আজ। বলে নিজের ঘরে লাল বাতি জ্বেলে মিটিং করছি বলে ব্যস্ত হয়ে যাননি।
আজ এতদিন পরেও এই রাতের অন্ধকারে আচমকা এই কথা মনে পড়ে গেলো আমার। যে সময় সংবাদ মাধ্যমের কর্মীদের তাদের একটা খবরের উপস্থাপনা করতে গিয়ে দশ বার ভাবতে হয়। অফিসের অনুমতি নিতে হয়। এই খবর করা যাবে কি না জিজ্ঞাসা করতে হয় ঢোক গিলে। সেটা প্রচার করা যাবে কি না সেটা জেনে তারপর খবরে এগোতে হয়।
এরপর আমি সেই জেলা সভাধিপতি অসিত পাত্রর কাছে এই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনিও হাসি মুখে বলেন হ্যাঁ। এই কথা স্বীকার করে নিয়ে বলেন এটাও জেনে গেছে ইটিভির সাংবাদিক ভাই। এটা খুব মামুলি খবর ভাই। এর জন্য দৌড়ে আসার কি দরকার ছিল তোমার। সাদা জামা, সাদা প্যান্ট পরা সেই অসিত পাত্র কিন্তু দেখে নেবার হুমকি দেয়নি আমায়। সেদিন তিনি হাসি মুখে বিদায় জানান আমায় বাইট দেবার পরে।
এরপর এই খবর প্রচারিত হয় সেই দিন সন্ধ্যায় ইটিভির আমার বাংলায়। বেশ হৈ চৈ পড়ে যায় জেলায়। বিরোধী দল তৃণমূল ভোটের আগে অস্ত্র নিয়ে সভাধিপতি জেলায় সন্ত্রাস করবেন বলে প্রচার করে ফায়দা তুলতে চায়। জেলার রাজনীতি গরম হয়ে যায় শুধু এই আর্মস এর লাইসেন্স এর আবেদন করা নিয়ে। কিন্তু যাই হোক সেই সময় ওই দাপুটে সভাধিপতি কিন্তু সাংবাদিকদের দেখে নেবার হুমকি দেননি। এর পর যতবার জেলা পরিষদে দেখা হয়েছে ততবার তিনি হেসে সাদা সুন্দর কাপে চা খাবার আমন্ত্রণ জানিয়ে বলেছেন সত্যিই কি করে যে আপনি এই সব খবর পেয়ে যান কে জানে।
এর বহু পড়ে এই সিপিএমের নেতাই অসিত পাত্র ওষুধ কেনায় দুর্নীতি করে জেল যাত্রা হয় তাঁর। সিপিএম তাঁকে বহিষ্কার করে। সে গল্প অন্য একদিন। আর সেদিনের সেই জেলাশাসক সুব্রত বিশ্বাস এর সাথে মহাকরণে বহুবার দেখা হয়েছে আমার। কোনো সময় তিনি কৃষি সচিব হয়েছেন। আবার দফতর বদলে কোনো সময় কম গুরুত্বের দফতরে সচিব পদে কর্মরত। হেসে নিজের ঘরে আসতে বলেছেন তিনি। খবর নিয়েছেন কেমন আছি আমি।
কত যে এমন ঝলমলে স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই সাদা গ্রামের সাংবাদিকের বর্তমান রং হীন জীবনে। সে সব ভাবলেও কেমন অবাক লাগে আজ আমার। সত্যিই তো এমন দিন ছিল আমাদের। আমার সাদা জীবনের এক লাল পার্টির নেতার কালো কথার গল্প। যে অতীত দিনের গল্প আজ অনেকেই হয়তো জানেন না। তাই মনে হলো আপনাদের সকলকে একটু জানাই সেই কথা।
এক জেলা সভাধিপতির গল্প - অভিজিৎ বসু।
আঠারো জুলাই, দু হাজার চব্বিশ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন