সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

আজ দশ তারিখ

সাদা জীবনের কালো কথায় আজ মাসের দশ তারিখ। মাসের দশ তারিখটা আমাদের বাড়িতে একটা হৈ হৈ ব্যাপার। আজ মাসের দশ তারিখ। আসলে এই দিনটায় দশ মার্চ আমি দীক্ষা নিয়েছিলাম সেই ছোটবেলায় আমার বারো বছর বয়সে। তারপর থেকেই প্রতি মাসের দশ তারিখ কেমন করে যেন জীবনের সবচেয়ে স্মরনীয় একটা দিন হয়ে গেলো আমাদের বাড়িতে। এই দশ তারিখে বাড়িতে সৎসঙ্গ অনুষ্ঠান হতো প্রতি মাসেই। 
কোন্নগর এর মাষ্টারমশাই গোপীবল্লভ সাহা যিনি আমাদের ঋত্বিক ছিলেন তিনি বলেছিলেন মাসে একদিন মাকে বলেছিলেন বাড়িতে সৎসঙ্গ অনুষ্ঠান দিতে। আর সেই থেকেই শুরু বাড়িতে এই সৎসঙ্গ। আর তার তোড়জোড় শুরু হয়ে যেতো মাসের পয়লা তারিখ থেকেই। কি চরম ব্যস্ততা বৃদ্ধি হতো মার। হাজার চিন্তা কি করে এই দিনটা ভাল ভাবে কাটবে সে নিয়ে। বর্ষা কালে চিন্তা একটাই জল জমলে বাড়িতে সৎসঙ্গ অনুষ্ঠানে লোক আসবে কি করে। কি প্রসাদ দেওয়া হবে সে নিয়েও কম চিন্তা ছিল না মার।
 আসলে ঠাকুর অন্ত প্রাণ একজন মানুষ যে সারা জীবন ঠাকুরের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস আর ভালবাসা নিয়ে বেঁচে রইলেন। সেটাকে আঁকড়ে ধরে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত লড়াই করলেন। আজ সেই ক্যালেন্ডারের পাতায় দশ তারিখ। বড়ো বড়ো অক্ষরে দেয়ালে জ্বল জ্বল করছে দশ জুলাই। দুর থেকে সেই তারিখটা দেখেই রাতে লিখতে বসলাম আমি। আসলে এই দশ তারিখ নিয়ে মার চিন্তা অনেক বেশি ছিল আমাদের সবার থেকে।
 এত মানুষের জন্য প্রসাদের ব্যবস্থা করা। কি করে সেই প্রসাদ কম টাকায় ভালো ভাবে দেওয়া যেতো সেটা কাউকে বুঝতে না দিয়ে তিনি করে ফেলতেন ম্যাজিক এর মত। আসলে এটাই ওনার ক্ষমতা ছিল। কত মানুষের ভালবাসা নিয়ে যে বেঁচে ছিলেন সেটাই এখন বুঝতে পারি আমি। সেই দশ তারিখে আজ বাড়িতে কোনো হৈ চৈ নেই, হুল্লোড় নেই, ব্যস্ততা নেই। সকাল থেকে রাত অবধি মার মত আর কারুর আমাদের কোনো চিন্তা ভাবনা নেই। 
যে যার মতো নিজের জীবন কাটিয়ে চলেছি আমরা বাবা ছেলে দুজনেই। যে যার মতো করে বেঁচে আছি আমরা একে অপরের থেকে দূরে থেকে। কিন্তু সেই দশ তারিখের সৎসঙ্গ অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে আমার সেই রিষড়ার বাড়িতে। সেই বাড়ীতে এই দিনে কত মানুষের সমাগম হতো। মা সাদা আর লাল পাড় এর শাড়ি পরে অপেক্ষা করতেন সব সাজিয়ে গুছিয়ে সন্ধ্যা বেলায়। সবাই আসতেন আমাদের বাড়িতে সন্ধ্যা বেলায়। শঙ্খ বাজত, উলু ধ্বনি হতো। কীর্তন হতো বাড়িতে। বাড়ীটা গম গম করতো খোল করতালের আওয়াজে। 
আর আজ সেই বাড়ীটা এই দিনে ঠিক খা খা করছে। কেউ নেই, আওয়াজ নেই, লোক সমাগম নেই, আর মাও নেই। সব মিলিয়ে ক্যালেন্ডারের পাতার দশ তারিখ আজ যেনো শুধুই একটা মাসের তারিখ মাত্র। যে তারিখ অন্য আর পাঁচটা দিনের মতই সাধারণ একটা দিন মাত্র। যে দিনের কোনো ব্যস্ততা নেই, হুড়ো তাড়া নেই, লোকের আনাগোনা নেই শুন্যতা আর নির্জন একটা দিন মাত্র। যে দিন অন্য আর পাঁচটা দিনের মতই সাদা মাটা একটা দিন মাত্র।
 এই দশ তারিখের দিনে রাতে অফিস ফেরত আমি মাকে ট্রেন থেকে ফোন করতাম। আর মা বাবাকে ঠাকুরের প্রসাদ দিয়ে স্টেশনে পাঠিয়ে দিত আমায় দেবার জন্য। কোনো সময় ভালো প্রসাদ হলে বেশি করে দিত যাতে রাতে সবাই পেট ভরে খেতে পারি আমরা সবাই। ভাদ্র মাসে তালের বড়া প্রসাদ হলে মাকে বলতাম বেশি দিও। এই ভাবেই কেটে যেতো আমার জীবনের দশ তারিখ। 
আজ সেই দশ তারিখে বাড়ী ফেরার পথে প্রসাদ নিয়ে যাস বলে মার ডাক নেই। বাড়িতে ঠাকুরের সিংহাসনে ধূপ দ্বীপ জ্বালা নেই।  কাঁসর, ঘন্টার আওয়াজ নেই। লোকের সমাগম নেই।খোল করতালের আওয়াজ নেই। মার বড়ো প্রিয় সেই বাড়ী আজ একদম একা একা ফাঁকা হয়ে দিন যাপন করে। একদম একা একা দশ তারিখ কাটিয়ে দেয় সে আনমনে একলা। শুধুই ভালোবাসার সেই মানুষের স্মৃতি রোমন্থন করে। যে সারাটা জীবন অবিচল আস্থা, বিশ্বাস আর ভক্তি নিয়ে ঠাকুরকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে রইলো। আর ঠাকুরকে ভালবেসে চলে গেল আমাদের সবাইকে ছেড়ে অমৃতলোকে। ভালো থেকো মা। আজ দশ জুলাই তাই তোমার কথা মনে পড়ে গেলো। 

আজ দশ তারিখ - অভিজিৎ বসু।
দশ জুলাই, দু হাজার চব্বিশ।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

অমৃত কুম্ভের সন্ধানে চন্দ্রাণী

কখনও কুম্ভ মেলায় হাজির। আবার কখনও রাজনৈতিক দলের ঝাণ্ডা কাঁধে দৃপ্ত ভঙ্গিতে এগিয়ে চলেছেন তিনি রাস্তা দিয়ে একমনে ধীর পায়ে। আবার কোনোও সময় গঙ্গাসাগর সঙ্গমে তো আবার কোনোও সময় হঠাৎ করেই শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলার মাঠে কিম্বা সোনাঝুড়ির হাটে পৌঁছে গেছেন তিনি হাসি মুখে পরিবার নিয়ে। আর এইসবের মাঝে কেউ অসুস্থ হয়েছেন শুনে তাঁকে হাসপাতালে দেখতে গিয়ে হঠাৎ করেই অ্যাম্বুলেন্স করে সোজা অন্য দূরের উত্তরপাড়া হাসপাতালে চলে গেছেন তিনি বাড়ীর কাউকে কিছুই না জানিয়েই। একদম স্বতস্ফূর্ত ভাবেই অন্য কারুর বিপদে এই ভাবেই ঝাঁপিয়ে পড়া হাসি মুখেই। যা আমার মার অসুস্থ অবস্থায় করেছিলেন তিনি কাউকে কিছুই না জানিয়ে রিষড়ার হাসপাতাল থেকে সোজা উত্তরপাড়ার হাসপাতালে চলে গেলেন সেদিন। আবার কোনো সময় সাংবাদিকদের কোনও অনুষ্ঠানে হাসিমুখেই হাজির হয়েছেন তিনি সবার সাথে মিলেমিশে। আর সেই তাঁর সোজা গাড়ী করে ছেলে আর মেয়েকে নিয়ে রিষড়া রেলগেট পার হয়ে সোজা, একদম সোজা সটান অমৃত কুম্ভের সন্ধানে কুম্ভ মেলায় হাজির হলেন তিনি কোনোও কিছু না ভেবেই চিন্তা না করেই। এতো পাপ মোচন করতে বা পূণ্য সংগ্রহ করতে ...

আনন্দবাজারের শ্যামল দা

সেই সাদা বাড়ীর অনেক বিখ্যাত সাংবাদিকের মধ্যে একজন শুধু জেলখানার খবর লিখেই যিনি বিখ্যাত হয়ে গেলেন গোটা সাংবাদিক মহলে, বাংলা সংবাদ পত্রের জগতে। সেই জেল রিপোর্টার বলেই অভিহিত হতেন তিনি মহাকরণের বারান্দায়, অলিন্দে আর রাইটার্সের কাঠের সিঁড়িতে হাসিমুখে। যে কোনোও মন্ত্রীর ঘরে হাসিমুখে যাঁর প্রবেশ ছিল অবারিত দ্বার। যিনি প্রথম জীবনে আনন্দবাজার পত্রিকায় দক্ষিণ ২৪ পরগণার জেলার রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেছেন। পরে জেলা থেকে সোজা কলকাতায় প্রবেশ তাঁর।  সেই একদম ফিটফাট সুন্দর, সুদর্শন,সুপুরুষ, বিয়ে না করেও দিব্যি হাসি মুখে মাকে নিয়ে জীবন কাটিয়ে দিলেন ভাইপো আর সেই বর্ধমানের বড়শুল এর একান্নবর্তী পরিবারের সদস্যদের কাছে। আর শনিবার হলেই তাঁর সবাইকে থ্যাংক ইউ বলে কলকাতার সেই বিখ্যাত মেস এর জীবন ছেড়ে নিজের গ্রামের বাড়ী চলে যাওয়া তাঁর হাসি মুখে। বলতেন সবাইকে চলো সবাই মিলে গ্রামের বাড়িতে পুকুরের মাছ ধরে খাওয়া হবে বেশ আনন্দ হবে। আমার নিজের গ্রামের বাড়ীতে গেলে কোনোও অসুবিধা হবে না একদম।  আর নিজের শরীর ফিট রাখতে এই বয়সেও কেমন করে যে দুশো কপালভাতি করতেন তিনি কে জানে। একদম সবার যখ...

আমাদের সবার মিল্টনদা

“স্মৃতি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হবে। নতুন স্মৃতির পলি পড়বে। কোনও একদিন যক্ষের মতো কোনও এক নির্জন ঘরে সিন্দুকের ডালা খুলব। ক্যাঁচ করে শব্দ হবে। ভেতরে দেখব থরে থরে সাজানো আমার জীবনের মৃতঝরা মুহূর্ত। মাকড়সার ঝুলে ঢাকা, ধূসর। তখন আমি বৃদ্ধ; হাত কাঁপছে, পা কাঁপছে। চুল সাদা। চোখদুটো মৃত মাছের মতো। এই তো মানুষের জীবন, মানুষের নিয়তি। এই পথেই সকলকে চলতে হবে। বর্তমানের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতে না পারলে, অতীত বড় কষ্ট দেয়।” ― সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় , লোটাকম্বল হ্যাঁ, সত্যিই তো, অতীত বড়ো কষ্ট দেয় আমাদের এই রাত বিরেতে। দু চোখের পাতা এক হয় না কিছুতেই। রাত কেটে ভোর হয়, আলো ফোটে তবু সিন্দুকের ডালা খুলে বেরিয়ে আসে নানা স্মৃতি, নানা মুখ, নানা চরিত্র, নানা ঘটনা। হ্যাঁ, আজ আমার এই সাদা জীবনের কালো কথায় হুগলীর বিখ্যাত দাপুটে সাংবাদিক মিল্টন সেন এর কথা। ওর সেই হাসি খুশি মিষ্টি ভদ্র ব্যবহার, সব সময় মুখে ভালো কথা। আমার মত খারাপ বদনাম নেই ওর কোথাও। সবার সাথে নেতা, মন্ত্রী, পুলিশ অফিসার সবার সাথে ভালো সম্পর্ক রেখে এগিয়ে চলা মিল্টন এর বড়ো প্লাস পয়েন্ট।  সে যাক প্রথম ওর...

আইচ আর মাটির সংসার

আইচ আর মাটি। ফ ব মানে সেই বিখ্যাত কুচবিহার জেলার কমল গুহ আর মাটি মনে দেবমতী এই দুজনের বিখ্যাত মিডিয়ার জুটি। সেই সব সময় যে আইচ অফিস, বাড়ী নিয়ে নানা ভাবেই চাপে নাজেহাল হয়ে থাকে সব সময়। বর্তমানে কাগজে কাজ পেয়েও যে পরে চার কোনা বোকা বাক্স টিভির দুনিয়ায় ঢুকে পড়ল যে আইচ বলে ছেলেটি। যে রাজনীতির পাঠশালায় বেশ ভালই। সেই আমাদের এক সময়ের বিখ্যাত চ্যানেল এর পোদ্দার কোর্টের অফিসে সেই ২৪ ঘণ্টায় বিখ্যাত লোকজনের সাথে ওর কাজ করা। সব আকাশ থেকে নেমে আসা লোকজন আর স্বর্ণযুগের সেই বিখ্যাত সংসার। যে সংসার একদিন আবার ভেঙেও গেলো কেমন করে যেন। যে ভাঙা সংসারে ভাঙনের মুখে আমার কাজের সুযোগও ঘটে।  সেখানেই শুভ্রজিৎ আইচ আর দেবমতীর আলাপ, ঘর, মাটির সংসার পাতা আর নানা ভাবেই ওদের বেড়ে ওঠা একটা সুন্দর পরিবারকে নিজের মত করে গড়ে নিয়ে। কখনও এক মিডিয়ার অফিসে কাজ করে এক দফতর বা সেই ডেস্ক ডিপার্টমেন্ট থেকে অ্যাসাইন মেন্টের টেবিলে বদলি হয়ে চাকরি করা ওদের দুজনের একে অপরকে দূরে সরে গিয়ে। আবার সেখানেও জলের নিচে পা কাটা হাঙ্গরের দলবল ঘুরছে বলে এক চেনা অফিস ছেড়ে অন্য অফিসে চলে যাওয়া ওর ...

ওই খানে মা পুকুর পাড়ে

ওইখানে মা পুকুর-পাড়ে জিয়ল গাছের বেড়ার ধারে হোথায় হবে বনবাসী,           কেউ কোত্থাও নেই। ওইখানে ঝাউতলা জুড়ে বাঁধব তোমার ছোট্ট কুঁড়ে, শুকনো পাতা বিছিয়ে ঘরে           থাকব দুজনেই। বাঘ ভাল্লুক অনেক আছে- আসবে না কেউ তোমার কাছে, দিনরাত্তির কোমর বেঁধে           থাকব পাহারাতে। রাক্ষসেরা ঝোপে-ঝাড়ে মারবে উঁকি আড়ে আড়ে, দেখবে আমি দাঁড়িয়ে আছি           ধনুক নিয়ে হাতে। .......রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর টুপ টুপ বৃষ্টির দুপুরে এই কবিতার লাইন গুলো দেখে। মনে পড়ে গেলো মার কথা। বাইরে একটানা বৃষ্টির একটা অদ্ভুত আওয়াজ। কখনো কখনো বেশ জোরে, কোনো সময় একটু কম। মাথার মধ্যে কেমন ঝিম ঝিম করছে এই বৃষ্টির টানা আওয়াজ শুনে।  একটানা আওয়াজে কেমন যেন একটা অস্বস্তি ভাব। গাছের পাতাগুলো বৃষ্টির জলে ভিজে একদম চুপ চুপে হয়ে গেছে। পাতার ডগা থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল ঝরে পড়ছে নিচে।গাছের পাতাগুলোর অসময়ে স্নান করে ওদের আবার শরীর খারাপ না হয়।  জানলার ধারে সারাদিন ধরে যে পায়রা গুলো বসে থাকতো আর বক বকম করতো।...