ওইমিয়াকন, পৃথিবীর সবচেয়ে ঠান্ডা গ্রাম।
ওইমিয়াকন রাশিয়ার একটি গ্রাম। ওইমিয়াকন হলো ইন্দিগির্কা নদী বরাবর রাশিয়ার ইয়াকুতিয়ার অয়মিয়ানস্কি জেলার অন্তর্গত একটি জনপদ , যা পৃথিবীর সবচেয়ে শীতল স্থায়ী জনবসতিগুলোর মধ্যে অন্যতম। এটি ওইমিয়াকন নদীর নামানুসারে নামকরণ করা হয়েছে। এই নদীটির নাম এভেন শব্দ খেইউম থেকে এসেছে যার অর্থ অহিমায়িত পানির চাক;যে জায়গায় মাছেরা শীতকালীন সময় কাটায়। তবে অন্য সূত্রানুযায়ী ইভেন শব্দ হিউয়াম এর অর্থ "হিমশীতল হ্রদ"।
এখানকার তাপমাত্রা সারা বছরই অত্যন্ত শীতল থাকে। সাইবেরিয়ার এই অংশটি প্রথম সন্ধানকারীদের মধ্যে সপ্তদশ শতাব্দীর সেমিয়ন দেজনেভ ও মিখাইল স্ট্রাডহিন এবং অষ্টাদশ শতাব্দীতে গ্যাভ্রিল সারিচেভ ছিলেন। এস্তোনীয় পরিব্রাজক মাত্তে মাতভেভিচ গেডেনস্ট্রোম (১৭৮০–১৮৪৫) ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ থেকে তাঁর নভোসিবিরস্ক দ্বীপপুঞ্জে ভ্রমণপথে ওমজাকনের বসতির কথা উল্লেখ করেন।
১৯২০ ও ১৯৩০-এর দশকে এটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ছিল যেখানে রাখাল ও ইরভিস শিকারিরা আশ্রয়গ্রহণ করতো । যাযাবরদের সাধারণ জীবন যাপন এবং স্থায়ীভাবে বসবাসের পরিবেশ দেয়ার জন্য সোভিয়েত সরকার একটি স্থায়ী বন্দোবস্ত তৈরি করে দেয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, আলাস্কা-সাইবেরিয়ান (ALSIB) বিমানপথের জন্য একটি বিমানাঙ্গন তৈরি করা হয়েছিল, যা মার্কিন খাজনাবিলি (Lend-Lease) বিমানটি পূর্ব ফ্রন্টে বহন করতে ব্যবহৃত হত। এজন্য তাঁরা গুলাগ নীতি অনুযায়ী যুদ্ধবন্দীদেরকে দাস ও শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করে যোগাযোগের জন্য একটি রাস্তা তৈরি করেন। হাড়ের রাস্তা - প্রচন্ড ঠাণ্ডায় নিহত যুদ্ধবন্দী-শ্রমিকদের এই রাস্তায়ই সমাহিত করা হতো।
গত কয়েক দশক ধরে ওইমিয়াকনের জনসংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাচ্ছে। এই অঞ্চলটি যখন একটি কেন্দ্রীয় শহর ছিল তখন এর সর্বোচ্চ জনসংখ্যা প্রায় ২,৫০০ জন ছিল। তবে এই সংখ্যাটি ২০১৮ সালে ৯০-এর চেয়ে নিচে চলে গেছে বলে জানা যায়। বর্তমানে এর জনসংখ্যা একশোর নিচে বলে জানা যায়।
কোনো বছর সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে তাপমাত্রা ০ °সে এর নিচে নেমে যায় এবং এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত হিমাঙ্কের নিচে থাকে। ওইমিয়াকনে কখনও কখনও জানুয়ারী, ফেব্রুয়ারি এবং ডিসেম্বরের গড় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা −৫০ °সে এর নিচে থাকে । কখনও কখনও গ্রীষ্মের মাসগুলোও বেশ ঠান্ডা হতে পারে তবে জুন এবং জুলাই এমন একমাত্র মাস যেখানে তাপমাত্রা কখনও −১০ °সে নিচে যায় নি। জানুয়ারি মাসে প্রতিদিনের তাপমাত্রা থাকে −৬০.০ °সে।
ওইমায়াকনে ২৫ অক্টোবর থেকে ১৭ ই মার্চ এর মধ্যে কখনই হিমাংকের উপরে তাপমাত্রা রেকর্ড করা যায়নি। যদিও ওইমিয়াকনে শীতকাল দীর্ঘ এবং অত্যধিক ঠান্ডা। ওইমিয়াকনে গড়ে ৮ মাসই থাকে শীতকাল। ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেখানকার স্থানীয়দের খাদ্যাভ্যাস মূলত মাংসভিত্তিক। হিমশীতল তাপমাত্রায় ফসলের জন্মানো সম্ভব হয় না বলে মাঝে মাঝে কাঁচা বা হিমায়িত খাওয়া হয়।
কিছু স্থানীয় খাদ্যের মধ্যে রয়েছে স্ট্রোগেনিনা, যা কাঁচা, দীর্ঘ-কাটা হিমায়িত মাছ; বল্গাহরিণের মাংস; কাঁচা ঘোড়ার হিমায়িত কলিজা এবং ম্যাকারণির সঙ্গে ঘোড়ার রক্তের হিমায়িত টুকরা। ওইমিয়াকনের ঐতিহ্যবাহী ঘোড়া। এটি ইয়াকুতি ঘোড়া হিসেবে পরিচিত। মাছ হিসেবে তারা স্যামন, হোয়াইট ফিশ খায়। মাছ-মাংস সংরক্ষণের জন্য তারা কোনো রেফ্রিজারেটর ব্যবহার করে না, বরং পানি থেকে তোলার সঙ্গে সঙ্গে মাছ হিমায়িত হয়ে যায় এই এলাকায়।
জানুয়ারিতে এই গ্রামের তাপমাত্রা -৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার আশেপাশে থাকে। আর সারা বছরে সবচেয়ে বড় দিন হয় তিন ঘন্টার কাছাকাছি। শুনে মনে হতে পারে এখানে মানুষ বসবাস করা অসম্ভব। এখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক একদমই নেই। প্রচন্ড শীতের কারণে কোনো শস্য ফলানো সম্ভব হয় না। সব থেকে কাছের কোনো শহরে যেতে সময় লাগে প্রায় দু দিন।
আসলে পৃথিবীর সব থেকে ঠাণ্ডা এই গ্রামের বাসিন্দা হতে কেমন লাগবে বলুন তো। একদম নতুন একটা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হবে। গরম গরম বলে চিৎকার করা মানুষজন এই ঠাণ্ডা হিমশীতল গ্রামে ঘুরে আসতে পারেন একবার। দেখবেন তখন আবার গরম খুঁজতে দৌড়ে নিজের জায়গায় ফিরে আসতে হবে আপনাকে।
ওইমিয়াকন - অভিজিৎ বসু।
দশ মে, দু হাজার চব্বিশ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন