এই ভরা ভোটের বাজারে নিউজরুমে চরম উত্তেজনা। সারা দেশ জুড়ে উত্তেজনার পারদ বাড়ছে। কত দাপাদাপি খবর নিয়ে। খবরের কাটাছেঁড়া করা, পোস্টমর্টেম করা। এডিটোরিয়াল আলোচনা, সমালোচনা, এসবের মাঝে সেই মানুষটাই নেই। যিনি হারিয়ে গেছেন খবরের দুনিয়া থেকে অনেক দিন আগেই। চলে গেছেন দূরে অনেক দূরে। ভাবলেই মনটা কেমন বিধূর হয়ে যায়। অঞ্জন বন্দোপাধ্যায় নেই এটা ভাবতে মন চায় না।
আসলে বাংলা টেলিভিশন চ্যানেলে এমন একজন মানুষের সাথে কাজ করার সুযোগ আমার খুব কম হয়েছে। দুর থেকে ভয় পেয়ে কাটিয়ে দিয়েছি আমি। তবু যে কটা দিন কাজ করেছি তাতে এটা বুঝেছি একজন টেলিভিশন চ্যানেলের মেসি, রোনাল্ডো, ম্যারাদোনা, জিকো, প্লাতিনির সমাহার করলে যা দাঁড়ায় তেমন ছুরির মত ক্ষুরধার বুদ্ধিসম্পন্ন একজন নিউজম্যান হলেন অঞ্জন দা। যিনি অনায়াসে যে কোনো বলকে ড্রিবল করে দুরূহ কোন থেকে বলটিকে জালে জড়াতে জানেন অনায়াসে।
খবরের পরতে পরতে জড়িয়ে ধরে সাসপেন্স দিয়ে, ধাক্কা দিয়ে দর্শককে টেনে ধরে রাখতে পারেন বোকা বাক্সের কুঠুরিতে। যার টেকনিক তাঁর হাতে করায়ত্ত ছিল খুব সহজেই। আসলে এই ছবিটা দেখে মনে পড়ে গেল বহু পুরোনো কথা। এমন ভোটের বাজারে রাস্তায় নেমে পড়তেন তিনি। সবাইকে নিয়ে একসাথে হৈ হৈ করে কাজের সাগরে ডুবে যেতেন। টীম গেম খেলতে খেলতে সকলকে কেমন একাত্ম করে বোঝাতেন এই টিভি চ্যানেলের লড়াইটা সবার রুটি রুজির লড়াই। এই লড়াই কারুর একার লড়াই নয়। আর সেই লড়াইতে তাই জীবনের শেষ দিন, শেষ লগ্ন পর্যন্ত অবিচল কর্তব্য নিষ্ঠা নিয়ে লড়ে গেছেন তিনি।
বহুকাল আগের কথা। এমন এক ভোটের বাজারে জ্যোতি বসুর শেষ নির্বাচনী জনসভা কভার করতে জেলায় গেছেন অঞ্জন বন্দোপাধ্যায়। উত্তরপাড়া স্টেশনের পাশের মাঠে সভা করছেন জ্যোতি বসু। সালটা খুব সম্ভবত দু হাজার দু সাল হবে। আকাশ বাংলার হয়ে অঞ্জন দা গেছেন জ্যোতি বসুর সভা কভার করতে। সভা শেষ হতেই বাঁশের ব্যারিকেড টপকে একছুটে একদম জয়কৃষ্ণ ঘোষের সামনে চলে গেলেন অঞ্জন দা।
জ্যোতি বসুর একটা ছোট শেষ ইন্টারভিউ চাই। সেই সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন অঞ্জন দা। বহু বছর পর যখন আমি চব্বিশ ঘণ্টা চ্যানেলে কাজ করতে গেলাম তখন সেই পুরোনো কথা বলতেই কেমন শিশুর মত উচ্ছাসে বলতেন, তোর মনে আছে সেকথা এখনো। বল কেমন হয়েছিল সেই সময় জ্যোতি বসুর শেষ সাক্ষাৎকার।
সত্যিই তো একজন মানুষ যার খবরের ক্ষুধা দুর্নিবার। যে কোনো বয়সে ছুটে বেড়ান এই ভাবেই মাঠে ঘাটে, পথে প্রান্তরে, শুধু খবরের জন্য। যেমন খবরের প্রতি রিফ্লেকশন, তেমন ভালোবাসা। যা এই ভরা ভোটের বাজারে আমি এই মানুষটাকে মিস করি খুব। আমি মিস করি সেই ক্যামেরা,অ্যাকশন, লাইট বলা মাত্র আমি অঞ্জন বন্দোপাধ্যায় বলছি। সেই গলা, সেই আওয়াজ, সেই হাত তুলে সবাইকে কাছে নিয়ে বলা চল সবাই মিলে আমরা ফাটিয়ে দি আবার। সত্যিই সেই অসাধারণ ডাকটা বড়ই মিস করছি আমি।
আমি জানি হয়তো খুব কাছের গণ্ডির কোনো মানুষ ছিলাম না আমি কোনোদিন। তবু দূরের মানুষ হলেও মনে হলো যে এই ভোটের বাজারে তাঁর অনুপস্থিতি আমাকে কষ্ট দেয়। তাই তো এই ছবিটা ফেসবুকের দেয়ালে দেখতে পেয়ে এত গুলো কথা লিখে ফেললাম কেমন করে। মনে হলো আমার যে এই মানুষটা এই বাংলা মিডিয়াতে এই ভোটের বাজারে নেই। হারিয়ে গেছেন তিনি। চলে গেছেন দূরে অনেক দূরে। শুধু এটুকু বলব আপনি যেখানেই থাকুন ভালো থাকবেন দাদা।
বাংলা মিডিয়ার, বাংলা চ্যানেলের এই মৃতপ্রায় অবস্থায় এই একশো শতাংশ নিউজ ম্যান এর না থাকা আমায় পীড়া দেয়। এই নিউজ রুমের উত্তাপ থেকে আমিও অনেক দূরে সরে এসেছি আজ। তবু যে মানুষটার জন্য আজও মন কাঁদে সেই অঞ্জন দা ভোটের বাজারে নেই। এটাই আমায় কষ্ট দেয়। এটা ভাবলে কষ্ট আরও বাড়ে। তাই আবার বলি অঞ্জন দা ভালো থাকবেন আপনি।
ভালো থাকবেন অঞ্জন দা - অভিজিৎ বসু।
পনেরো মে, দু হাজার চব্বিশ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন