রাতের অন্ধকারে আচমকা ঘুম ভেঙে যায় অনিমেষের। প্রতি রাতে একটা যন্ত্রণা নিয়ে উঠে পড়ে সে বিছানা থেকে। গলাটা কাঠ হয়ে গেছে। এক ঢোক জল খেয়ে চুপ করে বসে থাকে জানলার লোহার রডে থুতনি ঠেকিয়ে। কেন এমন হচ্ছে তার আজকাল সে বুঝতে পারে না কিছুতেই। একে কি নিদ্রাহীনতা বলে। নাকি অন্য কিছু জানে না সে। বুকের ভেতরের যন্ত্রটা মনে হয় লাফাতে লাফাতে বাইরে বেরিয়ে আসবে।
জানলার ঠাণ্ডা হিম শীতল লোহার রডে থুতনি ঠেকিয়ে চুপ করে বসে থাকে সে। তারপর লোহার রড ধরে চুমু খায় অনিমেষ। ঠিক যেভাবে আলগোছে জীবনের প্রথম শুকনো ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে চুমু খেতে গিয়ে বাধা দিয়েছিল পারমিতা তাকে। একধাক্কায় দূরে ঠেলে দিয়ে বলেছিল এই কি হচ্ছে কি ছাড়ো ছাড়ো বলছি। অনেক পিছিয়ে যায় অনিমেষ। জীবনের ঘড়িটা দ্রুত পেছনে ফিরে আসে ব্যাক গিয়ার মেরে।
নিকষ কালো অন্ধকারে পাশের বাড়ির লাল আলোক বাতি চুপ করে এক দৃষ্টিতে অনিমেষকে দেখে দুর থেকে। কি হলো রে বাবা লোকটার।পাগল হয়ে গেছে নাকি লোকটা। কে জানে হয়তো তাই।না হলে এই ভাবে রাতের অন্ধকারে আচমকা জানলা খুলে তাকে দেখছে কেন অমন করে। এই জন্য একটু অবাক হয়ে যায় লাল টুক টুকে আলোক বাতিটা। একটু যেনো লজ্জাও লাগে তার। মরণ দশা এই ভাবে কেউ লুকিয়ে দেখে। একটু লজ্জা সরম নাই মানুষটার। এক ধাক্কায় জীবনের অনেকটা বছর পিছিয়ে যায় অনিমেষ। এক ধাক্কায় 30 বচ্ছর আগের কথা মনে পড়ে যায় তার। কলেজের শুরুতে এই ভাবেই তো সে পারমিতাকে দেখতো হা করে।
ফর্সা মসৃন টুকটুকে লাল ঠোঁট আর লাল ব্লাউজ পরে যেদিন কলেজে এসেছিল কলেজের ফাংশনের দিনে।সেদিন তো সারারাত দু চোখের পাতা এক করতে পারে নি সে কিছুতেই। সারা রাত ওর কথা ভেবেই রাত কাবার হয়েছে তার। সকাল হতেই সাইকেল নিয়ে কলেজে এসে আবার শুরু তাকে খোঁজা এদিক ওদিক। কখন আসবে সে। কখনো রাস্তায় লাল কৃষ্ণচূড়া ফুল আর আকাশ দেখে মনে হয় ওই তো দূরে আসছে পারমিতা। কিন্তু না অন্য কেউ সামনে এলে বুঝতে পারে।
তারপর সত্যিই একদিন একদম কাছে ধরা দেয় তার পারমিতা। স্বপ্নেও ভাবেনি এরকম হতে পারে। হয়ে যায় আচমকা জীবনে কিছু ঘটনা ঘটে যায়। তার লাল ঠোঁট লাল ব্লাউজ ধরা দেয় একদম কাছ থেকে নিবিড় হয়ে। ওর শরীরের স্পর্শে সম্বিত ফিরে পায় অনিমেষ। সত্যি তাহলে কি স্বপ্ন সত্যি হলো তাহলে। দুটো বছর ঘুরতেই পারমিতা মিত্র উধাও হয়ে যায় একদিন আচমকাই।
আজ এতদিন পর রাতের অন্ধকারে আচমকা ঘুম ভেঙে খুলে গেছে মনের জানলা। লাল আলোক বাতিকে দেখে মনে হয় সেই লাল ঠোঁটের মাঝে কতদিন হাত বুলিয়ে বলা হয়নি আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। কিন্তু না সেই অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে পারমিতা অনেক দূরে চলে যায়। শুধু দু বছরের কিছু স্মৃতি রেখে। আজ এতদিন পরে রাতের অন্ধকারে আচমকা মনের অনুরণন।মনের দীঘিতে টল মল করে জল। শুধু এই লাল আলোক বাতি তার পারুর মত বিরাজ করে। আলোক বাতিও তো সারাজীবন থাকবে না। কটা দিন পর নিভে যাবে এই আলোক বাতি। অন্ধকার হয়ে যাবে গোটা আকাশ। আবারো অন্ধকার নেমে আসবে অনিমেষ রাতে ঘুম থেকে উঠে আর দেখতে পাবে না তার পারুকে। খুব যন্ত্রণা হয় তার। দুমড়ে মুচড়ে ওঠে বুকের ভেতরেটা।তাহলে কি রাতে ঘুম ভেঙে যায় তার লুকিয়ে পারুকে দেখবে বলে। তাই সে উঠে পড়ে ঘুম থেকে।
যদি একটু গভীর গোপন ভালোবাসার মত জানলার পাশে এসে দাঁড়ায় তার পারু। বলে কী ভাবো তুমি অমন করে। কি দেখো আমায় ওমন হা করে। আমার থেকে ঢের বেশি সুন্দরী আছে বুঝলে অনি। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে সাদা বকের মত বলে চলো ওঠো বাড়ি চলো আবার কাল দেখা হবে। ধীর পায়ে আল গোছে দুজন হাঁটতে থাকে গঙ্গার পাড় ধরে ঘরে ফেরে।ঠিক যেভাবে সাদা বক ঘরে ফেরে দিনের শেষে।সত্যিই অনিমেষ আবারও কেঁদে ফেলে।
পারু কি অনির জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমে। স্মৃতি মেদুরতার ভারে কি সে তার ভালোবাসা কে ভুলে গেছে। এত দিন পর কেন এমন হল কে জানে। সব দোষ ওই লাল আলোক বাতির। কে বলেছিল ওকে অমন করে রাতের নিস্তব্ধ অন্ধকারে তার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে থাকতে। কেউ তো বলেনি এমন করতে। তাহলে তো তাকে রাত দুপুরে ঘুম থেকে ঊঠে এই ভাবে রাতের অন্ধকারে বসে থাকতে হতো না। আর কাউকে বলতে হতো না পারু অনির জীবন থেকে তুমি কেনো হারিয়ে গেলে বলতে পারো। সেদিন ত আমি অনেক করে তোমায় ভালবাসি ভালবাসি বলে চিৎকার করেছি কেনো সেদিন ঘরের জানলাটা দুম করে বন্ধ করে দিয়েছিলে তুমি। সেটা তুমি নিজেই জানো। তাহলে কি দরকার ছিল আর এই রাতের অন্ধকারে আচমকা জানলার পাশে এসে দাঁড়ালে কেন। কেন আবার আমায় এতোদিন পর কাঁদাতে এলে পারু বুঝতে পারলাম না। এটার কি খুব দরকার ছিল।
দূরে লাল আলোক বাতি চুপ করে, স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একদম মাথা নিচু করে। দুর থেকে অনিমেষ বুঝতে পারে টপ টপ করে তার পারুর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। কিছু বলতে চাইলেও পারছে না সে বলতে। শুধু দু জন দুজন কে রাতের অন্ধকারে আবছা আলোয় একে অপরকে আশ্লেষে জড়িয়ে ধরতে চাইছে আবারও ঠিক আগের মতো। কিন্তু না অনেক সময় গড়িয়ে গেছে, অনেক আলোক বর্ষ দূরে চলে যাচ্ছে তার পারু ধীরে ধীরে। অনিমেষ হাত নাড়ছে আর বিড় বিড় করে বলছে যেওনা তুমি আমায় ছেড়ে। কিন্তু না গোপনে চোখের জল মুছে তার সুন্দরী পারু আবার দূরে হারিয়ে যাচ্ছে। অনিমেষ হাত বাড়িয়ে ধরতে চাইলেও পারছে না। জানলার গরাদে আটকে যাচ্ছে তার সারা শরীর, আটকে যাচ্ছে তার হাত। কোনও ভাবেই সে তার ভালোবাসার হারিয়ে যাওয়া পারুকে ফিরে পেয়েও আবার হারিয়ে ফেলছে যে।
হাউ হাউ করে ডুকরে কেঁদে ওঠে অনিমেষ জানলার গারদ ধরে। ঠান্ডা লোহার রড ভিজে যায় নোনতা জলের স্বাদে। বুকের ভেতরের যন্ত্রটা লাফাতে লাফাতে যেন শরীর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে তার এক লহমায়। প্রাণপণে বুকে হাত দিয়ে অনিমেষ বলে যাও তুমি। সেদিনও তোমায় আমি আটকাতে পারিনি, আজও আমি তোমায় ভালোবাসি কিন্তু আটকাবো না কিছুতেই। শুধু একটা কথা সামনের বছর বেঁচে থাকলে একবার এই ভাবে রাতের অন্ধকারে আচমকা জানলার পাশে এসে ফিশ ফিশ করে আমায় ডেকে ঘুম থেকে তুলে দিও। আর কাউকে বলো না তুমি একটু কাছে এসে আমার পাশে বোস। দুজন দুজনকে অনুভব করবো সারা রাত ধরে। তার পর আমি কথা দিলাম তোমায় আটকাবো না ভোর হবার আগে তোমায় ছেড়ে দেবো তুমি ফিরে যেও।
নিকষ কালো অন্ধকার আচমকা ফিকে হতে শুরু করে। সেই অন্ধকার পথ ধরে এগিয়ে চলে অনির পারু ধীর গতিতে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অনি। এত দিন পর কি সুন্দর রূপ ধরে রেখেছে তার ছোট্ট পারু। না ভেবেছিল যাবার সময় ঘাড় ঘুরিয়ে সাদা বকের মত একবার দেখবে পারু তাকে। না দেখে না সে তাকে, একটা চাপা অভিমান নিয়ে ফিরে যায় আর ভাবে সেদিন তুমি আমাকে জোর করে আটকাতে পারো নি আজও পারলে না অনি। কোন ভরসায় কিসের জন্যে আমিও যে যাই তোমার কাছে জানি না অনি। কিন্তু কথা দিলাম তোমায় এই ভালোবাসার টানে আমি তোমার কাছে আবার আসবো হারিয়ে যাবো না। বিশ্বাস করো আমার যন্ত্রণা, আমার কষ্ট যে তুমি ছাড়া আর কেউ বোঝে না। তাই আমি তোমায় ভালোবাসি বলে রাতের অন্ধকারে লাল আলোক বাতির রূপ ধরে তোমার কাছে এসেছি। এটাই বা কম কি দুজনের জীবনে। এই পাওয়াকে সম্বল করে না হয় আমরা দুজন বুড়ো বুড়ি বাকি জীবন কাটিয়ে দেব। দেখবে ঠিক পারবো আমরা।
অনি পারুর কথা শুনে কিছু বলতে পারে না। শুধু একটাই কথা ভাবে যাবার সময় চোখের জলে পারুর যাবার রাস্তাকে পিছল করে দেবে না সে। অজান্তে চোখের জল মুছে ফেলে চুপ করে বসে থাকে অনিমেষ জানলা ধরে। ঘরের কোণে টিকটিকিটা টিক টিক করে জানান দেয় এই তো তুমি আসল কথা বুঝেছো এত দিনে। আসলে মানুষ বোধ হয় অনেক কিছু বুঝেও বুঝতে চায় না। হারাতে চায় না। কিন্তু উপায় নেই তাই হারাতে হয় আর এই রাতের অন্ধকারে হারানো স্মৃতিকে আগলে রাখতে হয় সারা জীবন ধরে। একটু উত্তাপ পাবার আশায় বসে থাকতে হয় অনিকে।আবার এক বছরের প্রতীক্ষা নিয়ে।
আলোকবাতি - অভিজিৎ বসু।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন