সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

কোয়েলের তীরে

রৌরকেল্লা শহরে ঘোরার সেই ছবি ফিরে এলো আমার ফেসবুকের দেওয়ালে এই বৃষ্টি ভেজা সন্ধ্যায়। আসলে সোমা ও রূপার ছোটবেলার জন্মস্থান এই পাহাড় ঘেরা ছোটো শহর রৌরকেল্লা। কোয়েল নদীর তীরে ঘুরে ছোটো থেকে বড় হওয়া দিদি আর বোনের। কত যে দুজনের দিদি আর বোনের মিষ্টি মধুর স্মৃতি রয়ে গেছে এই শহরে সেটা ওরাই জানে। ছড়ানো ছিটানো ওদের সংসার এর স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই শহরে। সেটা আমরা না জানলেও ওরা জানে দুজনেই। শৈশব যে বড়ো মিঠে তার স্বাদ কি ভোলা যায় কোনোদিন। 
তাই দিদি আর বোন নিজের সেই ফেলে আসা শহরে ঘুরে বেড়ালো তাদের গোটা পরিবার নিয়ে। তাদের ছেলে মেয়েকে নিয়ে, স্বামীকে নিয়ে। পুরোনো শহরে ঘুরে বেড়িয়ে ফিরে যাওয়া অতীত এর কাছে ওদের সামনে রেখে। সেই পাকদান্ডী পথ পেরিয়ে ভোর বেলায় মা আর মেয়ের চুপি চুপি পাহাড় অভিযান করা মন্দিরে গিয়ে হাঁফিয়ে সেই পূজো দেওয়া। আর সন্ধ্যা বেলায় সেই চেনা রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে পুরোনো দিনের স্মৃতির উত্তাপ অনুভব করা। যা আমাদের কাছে শুধু একটা টুরিস্ট স্পটে ঘোরা মাত্র সেটাই ওদের দুজনের কাছে অন্য এক অনুভূতির শিহরণ। 
সেই যে অটো ওলা সুশান্তকে আমার আজও মনে পড়ে যায়। সারাদিন আমাদের যে বড়ো যত্ন করে নিজের গাড়ি করে ঘুরিয়ে ছিল গোটা শহর। যত্ন করে সব জায়গা দেখিয়েছিল একদম চেনা গাইড এর মতো। সোমা আর রূপার সেই ছোটবেলা কাটানো বাবার হারানো সেই কোয়ার্টার খুঁজতে গিয়ে নাজেহাল হলেও সে হাল ছাড়েনি কোনো ভাবেই। আসলে শিকড়ের সন্ধানে মুখিয়ে থাকে সবাই। আর সেটা যদি শৈশবের শিকড় হয় তাহলে তার টান হয় আলাদা ধরনের। 
বহুদিন পরেও সুশান্ত কুমার একদিন আমায় ফোন করেছিল। তখন লকডাউন চলছে সারা দেশে। স্যার, চিনতে পারছেন আমায়। হিন্দিতে বললেও আমি চিনতে পারলাম তাকে, বললাম হ্যাঁ বলিয়ে। স্যার কোই ইনকাম নেই স্যার। কুছ রুপিয়া দেগা মেরে। ঘরে খাবার পয়সা নেই স্যার। না, সেই সময় আমিও কর্মহীন দিনযাপন করছি বোলপুরে কোনো ভাবে। ওকে হেল্প করতে পারিনি আমি সেই সময়। বহু মানুষকে ফোন করে খবর নিতে অভ্যস্ত আমি সুশান্তকে আজও আর ফোন করতে পারিনি কিছুতেই। কিছুটা সঙ্কোচ, লজ্জা, আর জড়তা নিয়ে। সব কিছু মিলিয়ে আজও সুশান্তকে ভুলতে পারিনি আমি। 

গাড়ি চালাতে চালাতে সেদিন ওর বাড়ির গল্প বলেছিল আমায় সুশান্ত। বাবা মারা যাবার পরে দাদা রৌরকেল্লা স্টিল প্ল্যান্টে ভালো পাকা চাকরি পেয়ে যায়। বাবার চাকরিটা পায় দাদা। দাদার এখন সাজানো গুছানো সংসার। ও এই টোটো চালিয়ে দিন গুজরান করে শুধু। মেয়েকে পড়িয়ে বড়ো করবে এই আশায় রাতদিন পরিশ্রম করে সে ঘুরে ঘুরে। মা থাকে তার কাছেই দাদার কাছে নয়। লকডাউন এর সময়ে কাজ না থাকায় বিপদে পরে ফোন করে ফেলে সে আমায়। হয়তো নিজের মনে করেই ফোনটা করেছিল সে আমায়। 

কিন্তু আমার সাদা জীবনের কালো কথায় সুশান্তর সেই হাসি মাখা সরল মুখ। কোয়েল নদীর তীরে দাঁড়িয়ে ওর আর আমার মেয়ের সেই পুরোনো ছবিটা বারবার দেখি আমি আজও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। আমার মনে হয় সত্যিই তো কত অচেনা জীবন পথের পথিক একজন আমাকে তার বন্ধু ভেবে সাহায্য চাইলো আচমকাই নির্দ্বিধায়। কিন্তু আমি ওকে সেই সময় অল্প সাহায্য করেও ওর পাশে দাঁড়াতে পারিনি। হয়তো আমার সেই অবস্থাও ছিল না সেই সময়। কিন্তু আমি আজ এতো দিন পরেও সেই ঘটনার জন্য অনুশোচনার আগুনে দগ্ধ হই আজও। নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয় আমার এত দিন পরেও। কেনো কে জানে।
তবু এই সোমা আর রূপার এই ছোটবেলা কাটানো সেই রৌরকেল্লার পাহাড় ঘেরা ছোট্ট শহর, সেই বেদব্যাস এর মন্দির, সেই মন্দিরের গুহা, সেই কোয়েল নদীর তীরে সূর্যাস্তের লাল আভা। যে আভায় আমরা স্নাত হয়েছি গোটা দুটো পরিবার একসাথে সবাই মিলে। যার স্মৃতি রোমন্থন করে এতদিন পরেও কেমন যেন ভালোলাগার আবেশে মন ভরে যায়। 
জীবনের হাজার সাদা কালো বিন্দুর মাঝে মাঝেই লুকিয়ে থাকে এমন সব জীবনের নানা রঙের নানা ধরনের উজ্জ্বল রঙিন সব জল ছবি। যাকে ভোলা যায় না কিছুতেই। এই বৃষ্টি ভেজা শ্রাবণের সন্ধ্যায় সেই ফিরে আসা ছবি আমায় আবার এতদিন পরেও নতুন করে স্নাত করলো। না, কোয়েলের সূর্যাস্তের লাল আভায় নয়। শ্রাবণের সন্ধ্যায় অবিরাম বর্ষণের ধারায় আবার আমি স্নাত হলাম নতুন করে এতদিন পরে। সুশান্ত ভালো থেকো তুমি। আর যদি পারো আমায় ক্ষমা করে দিও।আমায় তুমি ভুল বুঝো না।


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

অমৃত কুম্ভের সন্ধানে চন্দ্রাণী

কখনও কুম্ভ মেলায় হাজির। আবার কখনও রাজনৈতিক দলের ঝাণ্ডা কাঁধে দৃপ্ত ভঙ্গিতে এগিয়ে চলেছেন তিনি রাস্তা দিয়ে একমনে ধীর পায়ে। আবার কোনোও সময় গঙ্গাসাগর সঙ্গমে তো আবার কোনোও সময় হঠাৎ করেই শান্তিনিকেতনের পৌষ মেলার মাঠে কিম্বা সোনাঝুড়ির হাটে পৌঁছে গেছেন তিনি হাসি মুখে পরিবার নিয়ে। আর এইসবের মাঝে কেউ অসুস্থ হয়েছেন শুনে তাঁকে হাসপাতালে দেখতে গিয়ে হঠাৎ করেই অ্যাম্বুলেন্স করে সোজা অন্য দূরের উত্তরপাড়া হাসপাতালে চলে গেছেন তিনি বাড়ীর কাউকে কিছুই না জানিয়েই। একদম স্বতস্ফূর্ত ভাবেই অন্য কারুর বিপদে এই ভাবেই ঝাঁপিয়ে পড়া হাসি মুখেই। যা আমার মার অসুস্থ অবস্থায় করেছিলেন তিনি কাউকে কিছুই না জানিয়ে রিষড়ার হাসপাতাল থেকে সোজা উত্তরপাড়ার হাসপাতালে চলে গেলেন সেদিন। আবার কোনো সময় সাংবাদিকদের কোনও অনুষ্ঠানে হাসিমুখেই হাজির হয়েছেন তিনি সবার সাথে মিলেমিশে। আর সেই তাঁর সোজা গাড়ী করে ছেলে আর মেয়েকে নিয়ে রিষড়া রেলগেট পার হয়ে সোজা, একদম সোজা সটান অমৃত কুম্ভের সন্ধানে কুম্ভ মেলায় হাজির হলেন তিনি কোনোও কিছু না ভেবেই চিন্তা না করেই। এতো পাপ মোচন করতে বা পূণ্য সংগ্রহ করতে ...

আনন্দবাজারের শ্যামল দা

সেই সাদা বাড়ীর অনেক বিখ্যাত সাংবাদিকের মধ্যে একজন শুধু জেলখানার খবর লিখেই যিনি বিখ্যাত হয়ে গেলেন গোটা সাংবাদিক মহলে, বাংলা সংবাদ পত্রের জগতে। সেই জেল রিপোর্টার বলেই অভিহিত হতেন তিনি মহাকরণের বারান্দায়, অলিন্দে আর রাইটার্সের কাঠের সিঁড়িতে হাসিমুখে। যে কোনোও মন্ত্রীর ঘরে হাসিমুখে যাঁর প্রবেশ ছিল অবারিত দ্বার। যিনি প্রথম জীবনে আনন্দবাজার পত্রিকায় দক্ষিণ ২৪ পরগণার জেলার রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেছেন। পরে জেলা থেকে সোজা কলকাতায় প্রবেশ তাঁর।  সেই একদম ফিটফাট সুন্দর, সুদর্শন,সুপুরুষ, বিয়ে না করেও দিব্যি হাসি মুখে মাকে নিয়ে জীবন কাটিয়ে দিলেন ভাইপো আর সেই বর্ধমানের বড়শুল এর একান্নবর্তী পরিবারের সদস্যদের কাছে। আর শনিবার হলেই তাঁর সবাইকে থ্যাংক ইউ বলে কলকাতার সেই বিখ্যাত মেস এর জীবন ছেড়ে নিজের গ্রামের বাড়ী চলে যাওয়া তাঁর হাসি মুখে। বলতেন সবাইকে চলো সবাই মিলে গ্রামের বাড়িতে পুকুরের মাছ ধরে খাওয়া হবে বেশ আনন্দ হবে। আমার নিজের গ্রামের বাড়ীতে গেলে কোনোও অসুবিধা হবে না একদম।  আর নিজের শরীর ফিট রাখতে এই বয়সেও কেমন করে যে দুশো কপালভাতি করতেন তিনি কে জানে। একদম সবার যখ...

আমাদের সবার মিল্টনদা

“স্মৃতি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হবে। নতুন স্মৃতির পলি পড়বে। কোনও একদিন যক্ষের মতো কোনও এক নির্জন ঘরে সিন্দুকের ডালা খুলব। ক্যাঁচ করে শব্দ হবে। ভেতরে দেখব থরে থরে সাজানো আমার জীবনের মৃতঝরা মুহূর্ত। মাকড়সার ঝুলে ঢাকা, ধূসর। তখন আমি বৃদ্ধ; হাত কাঁপছে, পা কাঁপছে। চুল সাদা। চোখদুটো মৃত মাছের মতো। এই তো মানুষের জীবন, মানুষের নিয়তি। এই পথেই সকলকে চলতে হবে। বর্তমানের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতে না পারলে, অতীত বড় কষ্ট দেয়।” ― সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় , লোটাকম্বল হ্যাঁ, সত্যিই তো, অতীত বড়ো কষ্ট দেয় আমাদের এই রাত বিরেতে। দু চোখের পাতা এক হয় না কিছুতেই। রাত কেটে ভোর হয়, আলো ফোটে তবু সিন্দুকের ডালা খুলে বেরিয়ে আসে নানা স্মৃতি, নানা মুখ, নানা চরিত্র, নানা ঘটনা। হ্যাঁ, আজ আমার এই সাদা জীবনের কালো কথায় হুগলীর বিখ্যাত দাপুটে সাংবাদিক মিল্টন সেন এর কথা। ওর সেই হাসি খুশি মিষ্টি ভদ্র ব্যবহার, সব সময় মুখে ভালো কথা। আমার মত খারাপ বদনাম নেই ওর কোথাও। সবার সাথে নেতা, মন্ত্রী, পুলিশ অফিসার সবার সাথে ভালো সম্পর্ক রেখে এগিয়ে চলা মিল্টন এর বড়ো প্লাস পয়েন্ট।  সে যাক প্রথম ওর...

আইচ আর মাটির সংসার

আইচ আর মাটি। ফ ব মানে সেই বিখ্যাত কুচবিহার জেলার কমল গুহ আর মাটি মনে দেবমতী এই দুজনের বিখ্যাত মিডিয়ার জুটি। সেই সব সময় যে আইচ অফিস, বাড়ী নিয়ে নানা ভাবেই চাপে নাজেহাল হয়ে থাকে সব সময়। বর্তমানে কাগজে কাজ পেয়েও যে পরে চার কোনা বোকা বাক্স টিভির দুনিয়ায় ঢুকে পড়ল যে আইচ বলে ছেলেটি। যে রাজনীতির পাঠশালায় বেশ ভালই। সেই আমাদের এক সময়ের বিখ্যাত চ্যানেল এর পোদ্দার কোর্টের অফিসে সেই ২৪ ঘণ্টায় বিখ্যাত লোকজনের সাথে ওর কাজ করা। সব আকাশ থেকে নেমে আসা লোকজন আর স্বর্ণযুগের সেই বিখ্যাত সংসার। যে সংসার একদিন আবার ভেঙেও গেলো কেমন করে যেন। যে ভাঙা সংসারে ভাঙনের মুখে আমার কাজের সুযোগও ঘটে।  সেখানেই শুভ্রজিৎ আইচ আর দেবমতীর আলাপ, ঘর, মাটির সংসার পাতা আর নানা ভাবেই ওদের বেড়ে ওঠা একটা সুন্দর পরিবারকে নিজের মত করে গড়ে নিয়ে। কখনও এক মিডিয়ার অফিসে কাজ করে এক দফতর বা সেই ডেস্ক ডিপার্টমেন্ট থেকে অ্যাসাইন মেন্টের টেবিলে বদলি হয়ে চাকরি করা ওদের দুজনের একে অপরকে দূরে সরে গিয়ে। আবার সেখানেও জলের নিচে পা কাটা হাঙ্গরের দলবল ঘুরছে বলে এক চেনা অফিস ছেড়ে অন্য অফিসে চলে যাওয়া ওর ...

ওই খানে মা পুকুর পাড়ে

ওইখানে মা পুকুর-পাড়ে জিয়ল গাছের বেড়ার ধারে হোথায় হবে বনবাসী,           কেউ কোত্থাও নেই। ওইখানে ঝাউতলা জুড়ে বাঁধব তোমার ছোট্ট কুঁড়ে, শুকনো পাতা বিছিয়ে ঘরে           থাকব দুজনেই। বাঘ ভাল্লুক অনেক আছে- আসবে না কেউ তোমার কাছে, দিনরাত্তির কোমর বেঁধে           থাকব পাহারাতে। রাক্ষসেরা ঝোপে-ঝাড়ে মারবে উঁকি আড়ে আড়ে, দেখবে আমি দাঁড়িয়ে আছি           ধনুক নিয়ে হাতে। .......রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর টুপ টুপ বৃষ্টির দুপুরে এই কবিতার লাইন গুলো দেখে। মনে পড়ে গেলো মার কথা। বাইরে একটানা বৃষ্টির একটা অদ্ভুত আওয়াজ। কখনো কখনো বেশ জোরে, কোনো সময় একটু কম। মাথার মধ্যে কেমন ঝিম ঝিম করছে এই বৃষ্টির টানা আওয়াজ শুনে।  একটানা আওয়াজে কেমন যেন একটা অস্বস্তি ভাব। গাছের পাতাগুলো বৃষ্টির জলে ভিজে একদম চুপ চুপে হয়ে গেছে। পাতার ডগা থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল ঝরে পড়ছে নিচে।গাছের পাতাগুলোর অসময়ে স্নান করে ওদের আবার শরীর খারাপ না হয়।  জানলার ধারে সারাদিন ধরে যে পায়রা গুলো বসে থাকতো আর বক বকম করতো।...