গুরু পূর্ণিমা হলো একটি ঐতিহ্য, যা সমস্ত আধ্যাত্মিক এবং একাডেমিক গুরুদের জন্য উৎসর্গীকৃত একটি দিন। যারা কর্মযোগের উপর ভিত্তি করে বিকশিত বা আলোকিত মানুষ তৈরির মাধ্যমে তাদের জ্ঞান দান করে। এই বিশেষ দিনটি ভারত, নেপাল এবং ভুটানের হিন্দু, জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা একটি উৎসব হিসেবে পালন করে। এই উৎসব ঐতিহ্যগতভাবে একজনের নির্বাচিত আধ্যাত্মিক শিক্ষক বা নেতাদের সম্মান করার জন্য পালন করা হয়। এটি হিন্দু পঞ্জিকার আষাঢ় মাসে (জুন-জুলাই) পূর্ণিমা তিথিতে পালন করা হয়।
পরমেশ্বর শিবের দক্ষিণামূর্তি রূপকে “গুরুমূর্তি” বলা হয়। সপ্ত ঋষি ও ব্রহ্মা-বিষ্ণু সহ সমস্ত দেবতারা এই মাসের পূর্ণিমা তিথিতে মহাদেবের কাছে পরমজ্ঞান লাভ করেন আর তাই শিবকে আদিগুরু মানা হয়। তাই এটি গুরু পূর্ণিমা বলেই বিখ্যাত। আবার কেউ এটাকে ব্যাস পূর্ণিমা নামেও পরিচিত, কারণ এটি ঋষি বেদব্যাসের জন্মদিন চিহ্নিত করে, যিনি মহাভারত রচনা করেছিলেন এবং বেদ সংকলন করেছিলেন।
গুরু' শব্দটি 'গু' এবং 'রু' এই দুটি সংস্কৃত শব্দ দ্বারা গঠিত; 'গু' শব্দের অর্থ "অন্ধকার" / "অজ্ঞতা" এবং 'রু' শব্দের অর্থ "যা অন্ধকারকে দূরীভূত করে"। অর্থ্যাৎ, 'গুরু' শব্দটি দ্বারা এমন ব্যক্তিকে নির্দেশ করা হয় যিনি অন্ধকার দূরীভূত করেন। জীবনের অন্ধকার কাটিয়ে আলোর পথ দেখান। তিনি তো মানুষের জীবনের আসল গুরু।
যদিও সেই বিখ্যাত সিনেমার চরিত্রে আচার্য মশাই বলেছিলেন বয়স কমিয়ে দেবেন। সেই লোভে সিনেমার সেই গুপী আর বাঘা দামী দামী হিরা,মুক্ত জহরত চুরি করে এনে দিয়েছিলেন আচার্য মশাইকে। শরবত খেয়ে নেশার ঘোরে গুরু বলতে গিয়ে দু বার গরু, গরু, বলে ফেলেছিলেন আর তাতেই যত বিপত্তি বেঁধে যায়। রেগে যান আচার্য মশাই। কিন্তু নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য কিছু বলেন না সেই সময় তাদের।
হিন্দু সনাতন ধর্মের সম্প্রদায়, শৈব মতে এই তিথিতে শিব দক্ষিণামূর্তিরূপ ধারণ করে ব্রহ্মার চারজন মানসপুত্রকে বেদের গুহ্য পরম জ্ঞান প্রদান করেছিলেন। দক্ষিণামূর্তি সকলের আদি গুরু, তাই শৈব বিশ্বাস অনুযায়ী এই তিথিটি দেবাদিদেব শিবের প্রতি সমর্পিত। এছাড়া এই দিন 'মহাভারত' রচয়িতা মহির্ষি বেদব্যাস মুনি পরাশর ও মাতা সত্যবতীর ঘরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এজন্য এই দিনটিকে 'ব্যাস পূর্ণিমা'-ও বলা হয়।
বেদব্যাস তাঁর সময়ে বিদ্যমান সমস্ত বৈদিক স্তোত্র একত্রিত করে তাদের বৈশিষ্ট্য ও আচার-অনুষ্ঠানে ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে চার ভাগে বিভক্ত করে বৈদিক অধ্যয়নের জন্য ইয়োমান সেবা করেছিলেন। তারপর তিনি তাদের চারজন প্রধান শিষ্য - পাইলা, বৈশম্পায়ন, জৈমিনী এবং সুমন্তুকে শিক্ষা দেন। এই বিভাজন এবং সম্পাদনাই তাকে সম্মানিত করেছিল "ব্যাস" (ব্যাস = সম্পাদনা করা, ভাগ করা)। "তিনি পবিত্র বেদকে ঋক্, যজুঃ, সাম এবং অথর্ব নামে চারটি ভাগে বিভক্ত করেছেন। ইতিহাস ও পুরাণ হল পঞ্চম বেদ।"
বৌদ্ধধর্মের অনুগামীগণ এইদিন বুদ্ধ আরাধনায় নিজেদের নিমগ্ন করেন। কথিত আছে, বুদ্ধ নিরঞ্জনা নদীর তীরে বোধিবৃক্ষের নিচে ‘বুদ্ধত্ব’ বা জ্ঞান লাভ করার পাঁচ সপ্তাহ পরে বুদ্ধগয়া থেকে সারনাথে চলে যান। সেখানে তিনি তার পাঁচ পুরনো সঙ্গীকে প্রথম তার বাণী প্রদান করেন, কারণ তাঁর মনে হয়েছিল, ওই পাঁচজন তার ধর্মের বাণী সহজে বুঝতে এবং আত্মস্থ করতে পারবেন। ওই শিষ্যগণও বুদ্ধত্বপ্রাপ্ত হলেন।
বুদ্ধদেব তাঁর প্রথম এই পাঁচ শিষ্যকে বাণী দান করেছিলেন এক আষাঢ় পূর্ণিমার দিন। বৌদ্ধগণ অষ্টাঙ্গিক মার্গ পালন করেন। এই দিনে তারা ‘বিপাসনা’ পদ্ধতির মাধ্যমে সাধনা করেন গুরু নির্দেশিত পথে। সারনাথে যেতে গৌতম বুদ্ধকে গঙ্গানদী পেরিয়ে যেতে হয়েছিল। রাজা বিম্বিসার যখন একথা শুনলেন, তিনি সন্ন্যাসীদের জন্য নদী পারাপার করার অর্থ নেওয়া বন্ধ করে দিলেন।
জৈন ঐতিহ্য অনুসারে, এই দিনে চতুর্মার শুরুতে চার মাসের বর্ষাকালের পশ্চাদপসরণে, ভগবান মহাবীর, চব্বিশতম তীর্থঙ্কর, কৈবল্য প্রাপ্তির পর, ইন্দ্রভূতি গৌতমকে, পরে গৌতম স্বামী নামে পরিচিত, একজন গণধরা, তাঁর প্রথম শিষ্য, এইভাবে নিজেই একজন ট্রিনোক গুহ হয়ে ওঠেন, তাই এটি জৈন ধর্মে ট্রিনোক গুহ পূর্ণিমা হিসাবে পালন করা হয় এবং একজনের ট্রিনোক গুহ এবং শিক্ষকদের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়।
গুরুপূর্ণিমা পুজোর নিয়ম সেভাবে আলাদা করে কোনও নিয়ম নেই। তবে ভগবানকে নানা নিরামিষ ভোগ, যেমন লুচি-সুজি, খিচুড়ি-তরকারি-ভাজা, পায়েস, ক্ষীর, নানা রকমের মিষ্টি ইত্যাদি দিয়ে তাঁর পুজা করা হয়। আর দই, গঙ্গাজল, মধু ও শুকনো ফল-ফলাদি সহযোগে চরণামৃতও তৈরি করে অর্পণ করা হয়। পূর্ণিমা চলাকালীন নিরামিষ খাবার খেয়ে শুদ্ধ থাকা ভালো। অনেকে আবার এদিন বাড়িতে সত্যনারায়ণের সিন্নিও দেন। যে-কোনও শুভ কাজের জন্য এটি অত্যন্ত শুভ দিন।
নেপালে , ট্রিনোক গুহ পূর্ণিমা স্কুলে একটি বড় দিন। এই দিনটি নেপালিদের জন্য শিক্ষক দিবস ; বেশিরভাগ ছাত্র। শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষকদের সম্মান জানায় উপাদেয় খাবার, মালা এবং দেশীয় কাপড় দিয়ে তৈরি টপি নামক বিশেষ টুপি দিয়ে। শিক্ষকদের কঠোর পরিশ্রমের প্রশংসা করার জন্য ছাত্ররা প্রায়ই স্কুলে ধুমধাম করে। এটি শিক্ষক ছাত্র সম্পর্কের বন্ধন সুসংহত করার একটি দুর্দান্ত সুযোগ হিসাবে নেওয়া হয়।
ভারতীয় শিক্ষাবিদরা তাদের শিক্ষকদের ধন্যবাদ জানিয়ে এই দিনটি উদযাপন করেন। অনেক স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ঘটনা রয়েছে যেখানে শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষকদের ধন্যবাদ জানায় এবং অতীতের পণ্ডিতদের স্মরণ করে। প্রাক্তন ছাত্ররা তাদের শিক্ষকদের সাথে দেখা করে এবং কৃতজ্ঞতার হিসাবে উপহারও দেয়।
শিক্ষার্থীরা সে অনুযায়ী বিভিন্ন শিল্প-প্রতিযোগীতার আয়োজন করে। গুরু-শিষ্যের মধ্যে প্রধান ঐতিহ্য হল আশীর্বাদ (অর্থাৎ ছাত্র তার গুরুকে অভিবাদন জানায়) একটি কবিতা বা উক্তি পাঠ করে এবং গুরু একজন ব্যক্তির সাফল্য ও সুখের জন্য আশীর্বাদ করেন। সংক্ষেপে, গুরু পূর্ণিমা হল ভারতীয়দের শিক্ষক দিবস উদযাপনের একটি ঐতিহ্যবাহী উপায়।
আসলে জীবনের সব ক্ষেত্রে এই গুরুই পথ দেখান আমাদের। যে পথ পার হতে গিয়ে আমাদের মত সাধারণ মানুষকে অন্ধকারে পথ হাতড়াতে হয়। সেই অন্ধকার পথের মাঝে গুরুর আদেশ তাঁর বাণী মেনে চললে লাভ নিজের জীবনের। গুরুহীন জীবন গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। তাই গুরু পূর্ণিমার দিন আমার প্রিয় সেই সব গুরুজনদের প্রনাম জানাই। যাদের থেকে আমি অনেক শিক্ষা লাভ করেছি। ছোটো থেকে বড় হয়েছি। সেই সব গুরুদের প্রনাম জানাই আমি আজ এই গুরু পূর্ণিমার পুণ্য দিনে।
গুরু পূর্ণিমা অভিজিৎ বসু
বাইশে জুলাই, দু হাজার চব্বিশ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন