আন্তর্জাতিক চা দিবস-
সকালে ঘুম থেকে উঠেই এক কাপ চা না হলে আর চলে না। সে বেড টি হোক বা অন্য কোনোভাবে চা পান হোক। চা পান জীবনের সাথে একদম মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে বলতে পারেন। ঠিক যেনো চা বিনা জীবন যেনো বড়ই আলুনি লাগে আমাদের। দুটি পাতা একটি কুড়ির এই সবুজ চা বাগিচার জগৎ জোড়া ভরা সংসার। জগৎ জোড়া যার খ্যাতি।
বিশ্বজুড়ে দৈনিক ২ বিলিয়ন কাপ চা পান করেন মানুষ। ভাবা যায় প্রতিদিন এত মানুষ চা পান করেন। চায়ের জনপ্রিয়তার কারণে প্রতি বছর ২১ মে আন্তর্জাতিক চা দিবস পালন করা হয়। তাহলে আজকের এই দিন হলো চা দিবসের জন্য বিশেষ দিন উদযাপন করা।
চা বলতে সচরাচর সুগন্ধযুক্ত ও স্বাদবিশিষ্ট এক ধরনের উষ্ণ পানীয়কে বোঝায় যা চা পাতা জলে ফুটিয়ে বা গরম জলে ভিজিয়ে তৈরী করা হয়। চা গাছ থেকে চা পাতা পাওয়া যায়। চা গাছের বৈজ্ঞানিক নাম ক্যামেলিয়া সিনেনসিস। চা পাতা কার্যত চা গাছের পাতা, পর্ব ও মুকুলের একটি কৃষিজাত পণ্য যা বিভিন্ন উপায়ে প্রস্তুত করা হয়। সর্বোচ্চ চা রপ্তানিকারক দেশ হলো চীন।ইংরেজিতে চায়ের প্রতিশব্দ হলো টি (tea)। গ্রিকদেবী থিয়ার নামানুসারে এরূপ নামকরণ করা হয়েছিল। চীনে ‘টি’-এর উচ্চারণ ছিল ‘চি’। পরে সেটা হয়ে যায় ‘চা’। মানে চি থেকে চা।
আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ১০ম শতাব্দীতে চা বিশ্বের সর্বাধিক উপভোগ্য পানীয় হয়। এর একধরনের স্নিগ্ধ, প্রশান্তিদায়ক স্বাদ রয়েছে এবং অনেকেই এটি উপভোগ করে। প্রস্তুত করার প্রক্রিয়া অনুসারে চা-কে পাঁচটি প্রধান শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। যেমন - কালো চা, সবুজ চা, ইষ্টক চা, উলং বা ওলোং চা এবং প্যারাগুয়ে চা।
এছাড়াও, সাদা চা, হলুদ চা, পুয়ের চা-সহ আরো বিভিন্ন ধরনের চা রয়েছে। তবে সর্বাধিক পরিচিত ও ব্যবহৃত চা হল সাদা, সবুজ, উলং এবং কাল চা। প্রায় সবরকম চা-ই ক্যামেলিয়া সিনেনসিস থেকে তৈরি হলেও বিভিন্ন উপায়ে প্রস্তুতের কারণে এক এক ধরনের চা এক এক রকম স্বাদযুক্ত। পুয়ের চা অনেক ক্ষেত্রে ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
ক্যামেলিয়া সিনেনসিস বিহীন এক কাপ চা। এক্ষেত্রে চা তৈরীর জন্য অপরাজিতা ফুল ব্যবহার করা হয়েছে
কিছু কিছু চায়ে ক্যামেলিয়া সিনেনসিস থাকে না। ভেষজ চা হল একধরনের নিষিক্ত পাতা, ফুল, লতা ও উদ্ভিদের অন্যান্য অংশ যাতে কোন ক্যামেলিয়া সিনেনসিস নেই। লাল চা সাধারণত কাল চা (কোরিয়া, চীন ও জাপানে ব্যবহৃত হয়) অথবা দক্ষিণ আফ্রিকার রুইবস গাছ থেকে তৈরি হয় এবং এতেও কোন ক্যামেলিয়া সিনেনসিস নেই।
চা মৌসুমী অঞ্চলের পার্বত্য ও উচ্চভূমির ফসল। একপ্রকার চিরহরিৎ বৃক্ষের পাতা শুকিয়ে চা প্রস্তুত করা হয়। চীন দেশই চায়ের আদি জন্মভূমি। বর্তমানে এটি বিশ্বের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য পানীয়রূপে গণ্য করা হয়। ১৬৫০ খ্রিষ্টাব্দে চীনে বাণিজ্যিকভাবে চায়ের উৎপাদন শুরু হয়। আর ভারতবর্ষে এর চাষ শুরু হয় ১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দে। ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশরা সিলেটে সর্বপ্রথম চায়ের গাছ খুঁজে পায়। এরপর ১৮৫৭ সালে সিলেটের মালনীছড়ায় শুরু হয় বাণিজ্যিক চা-চাষ।
চা প্রধান ক্রান্তীয় মৌসুমী জলবায়ু অঞ্চলের ফসল হলেও উপ-ক্রান্তীয় জলবায়ু অঞ্চলেও এটি কিছু কিছু চাষ করা যায়। প্রথম অবস্থায় পাহাড়ের ঢালু জমি পরিষ্কার করা হয়। এর চারা পৃথক বীজতলায় তৈরী করা হয়। তারপর চা উষ্ণ ও আর্দ্র অধিক উচ্চতার জলবায়ু তে চাষ করা হয়।
চারাগুলো যখন ২০ সেন্টিমিটার দীর্ঘ হয়, তখন সেগুলোকে চা-বাগানে সারিবদ্ধভাবে রোপণ করা হয়। সাধারণতঃ দেড় মিটার পরপর চারাগুলোকে রোপণ করা হয়ে থাকে। এরপর গাছগুলোকে বৃদ্ধির জন্য যথামাত্রায় সার প্রয়োগ ও জল সেচের ব্যবস্থা করতে হয়। এভাবে দুই থেকে তিন বছর পরিচর্যার পর পাতা সংগ্রহের উপযোগী করে তোলা হয়। কিন্তু গাছগুলো পাঁচ বছর না হওয়া পর্যন্ত যথাযথভাবে পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারে না। একটি চা গাছ গড়পড়তা ৩০ থেকে ৪০ বছর পর্যন্ত উৎপাদনের উপযোগী থাকে। তারপর পুনরায় নতুন গাছ রোপণ করতে হয়।
প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় এমন পাহাড়িয়া বা উচ্চ ঢালু জমি চা চাষের জন্য বিশেষ উপযোগী। জল নিষ্কাশনের বন্দোবস্ত থাকলে উচ্চ সমতল ভূমিতেও চা চাষ করা সম্ভবপর হয়। হিউমাস সারযুক্ত এবং লৌহমিশ্রিত দো-আঁশ মাটি চা চাষের জন্য খুবই উপযোগী। উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ু চা উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন। চা চাষের জন্য ১৭৫ - ২৫০ সেন্টিমিটার বৃষ্টিপাত আবশ্যক। এজন্য মৌসুমী ও নিরক্ষীয় অঞ্চলের দেশগুলোয় চা চাষের উৎপাদন বেশি হয়ে থাকে।
পৃথিবীতে আসাম এবং চীনজাতীয় - এ দুই প্রকারের চা গাছ দেখতে পাওয়া যায়। তন্মধ্যে আসাম জাতীয় চা গাছ ভারত ও শ্রীলঙ্কায় অধিক চাষ করা হয়। এ ধরনের গাছ বেশ বড় এবং বহু পাতাযুক্ত হয়। বিধায়, এটি বাণিজ্যিকভিত্তিতে চাষ করার জন্যে বিশেষ উপযোগী। এ গাছ প্রায় ৬ মিটার বা ২০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। পাতার নাগাল পাওয়া এবং পাতা সংগ্রহের জন্য গাছগুলোকে ১.২ মিটার বা ৪ ফুটের অধিক বড় হতে দেয়া হয় না। ছেঁটে দেয়ার ফলে চা গাছগুলো ঘন ঝোঁপে পরিণত হয়।
অন্যদিকে চীনজাতীয় গাছ আকারে বেশ ছোট হয়। এতে পাতার সংখ্যাও অনেক কম থাকে। এ গাছ না ছাঁটলেও পাতা তোলার মতো উচ্চতাসম্পন্ন হয়ে থাকে।
চা গাছ রোপণ, আগাছা পরিষ্কারকরণ, সার প্রয়োগ করা, গাছ ছাঁটা, কচি পাতা চয়ন, চা-পাতা শুকানো, সেঁকা, চা-প্যাকিং ইত্যাদি বহুবিধ ধরনের কর্মকাণ্ডে দক্ষ-অদক্ষ প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন পড়ে।
পাতা তোলার কাজে দক্ষ মহিলা শ্রমিক নিয়োজিত থাকে। বিষয়টি বেশ ধৈর্য্যের বিধায় বাগান কর্তৃপক্ষ সাধারণত নারী শ্রমিকদেরকেই পাতা তোলার জন্য নিয়োগ দিয়ে থাকে। এছাড়াও কম ফলনের স্বার্থে চা বাগানে প্রচুর জৈব ও রাসায়নিক সারসহ প্রয়োজনীয় কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয়।
চা গাছ হতে পাতা সংগ্রহ করতে ব্যক্তিকে যথেষ্ট নৈপুণ্য ও দক্ষতা অর্জন করতে হয়। কারণ দু'টি পাতা ও একটি কুঁড়ি একসঙ্গে তুলতে না পারলে চায়ের উৎকর্ষ ও আমেজ অনেকাংশেই নষ্ট হয়ে যায়। চীন ও জাপানে বছরে গড়পড়তা তিনবার চা-পাতা সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু ভারত, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কায় খুব ঘন ঘন পাতা সংগ্রহ করা যায়। এদেশগুলোতে বছরে গড়ে ষোল থেকে বিশ বার পর্যন্ত চা পাতা সংগ্রহ করতে দেখা যায়।
চীনজাতীয় গাছের পাতা স্বাদ ও গন্ধের জন্য সুখ্যাত। কিন্তু আসামজাতীয় গাছের পাতা রঙের জন্য বিখ্যাত। এই দুই ধরনের চা-পাতার উন্নত সংমিশ্রণের উপরই এর গুণাগুন নির্ভর করে। স্বভাবতঃই চা মিশ্রণ একটি নিপুণতা ও অত্যন্ত কঠিন কাজ। তাই এটি অভিজ্ঞ ব্যক্তির দ্বারা সম্পাদনা করতে হয়। এরূপভাবে চা মিশ্রণে নৈপুণ্যের লাভের প্রেক্ষাপটে লিপটন, ব্রুকবণ্ড টাটা প্রভৃতি চা প্রস্তুতকারক কোম্পানী বিশ্ববাজার দখল ও খ্যাতি লাভ করেছে। উল্লেখ্য পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিংয়ের চা স্বাদে গন্ধে বিশ্বখ্যাত।সর্ববৃহৎ চা উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে - চীন, ভারত, কেনিয়া, শ্রীলঙ্কা এবং তুরস্ক অন্যতম।
যুক্তরাজ্যের লন্ডনভিত্তিক চা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান লন্ডন টি এক্সচেঞ্জ তাদের উৎপাদিত 'গোল্ডেন বেঙ্গল টি' নামের বিশেষ চা-য়ের মূল্য নির্ধারণ করেছে প্রতি কেজি ১৪ লাখ পাউন্ড, বাংলাদেশি টাকায় যার মূল্য প্রায় ১৬ কোটি টাকা। ২০২২ সালের মে মাস নাগাদ তারা এই চা বাজারে আনার ঘোষণা করে। সিলেটে এই চায়ের চাষ করা হচ্ছে। এই চা বাজারের বিশ্বের সবচেয়ে দামী চা।
আন্তর্জাতিক চা দিবস প্রতি বছর ২১ মে উদযাপিত হয়। ভারত বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, কেনিয়া, মালাউই, মালয়েশিয়া, উগান্ডা ও তানজানিয়ার মতো চা উৎপাদনকারী দেশসমূহ ২০০৫ সাল থেকে প্রতি বছর এই দিবসটি উদযাপন করে আসছে। পূর্বে ১৫ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক চা দিবস পালন করা হতো।
২০১৯ সালে, চা সংক্রান্ত আন্তঃসরকারি গোষ্ঠী ২১ মে আন্তর্জাতিক চা দিবস উদযাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। আন্তর্জাতিক চা দিবসের উদ্দেশ্য হলো চা-কর্মী ও উৎপাদকদের ওপর বৈশ্বিক বাণিজ্যের প্রভাব সরকার ও জনগণের সামনে তুলে ধরা এবং অর্থনৈতিক সমর্থন ও ন্যায্য বাণিজ্যের সংযোগ স্থাপন করা।
২০০৪ সালে বিশ্ব সামাজিক সম্মেলনের পর ২০০৫ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক চা দিবস উদযাপিত হয় ভারতের নতুন দিল্লিতে।পরবর্তীতে ২০০৬ ও ২০০৮ সালে দিবসটি উদ্যাপনের আয়োজন করে শ্রীলঙ্কা। আন্তর্জাতিক চা দিবস উদ্যাপন ও এর সাথে সম্পর্কিত বিশ্ব চা সম্মেলন যৌথভাবে বিভিন্ন শ্রমকল্যাণ সমিতি আয়োজন করে থাকে। ২০১৫ সালে ভারত সরকার খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মাধ্যমে দিবসটির উদ্যাপন আরো বিস্তৃত করার প্রস্তাব দেয়। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০২০ সাল থেকে ২১ মে দিবসটিকে আন্তর্জাতিক চা দিবস হিসেবে পালন করার কথা ঘোষণা করা হয়।
চা খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। চা যে কেবল মানসিক চাপ কমায় তাই নয় বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে চা পান রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। চা পান করলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়।
অন্যদিকে চায়ের মধ্য থাকে থিয়োফাইলিন নামে একটি রাসায়নিক উপাদান শরীরে ডিহাইড্রেশন এর কারণ হতে পারে। যা হজমের সমস্যার কারণ হতে পারে। এর ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেয়। ঘুমের সমস্যা হতে পারে। উদ্বেগ ও অস্থিরতা দেখা যায়।
তবে যাই উপকার হোক আর ক্ষতি হোক ঘুম জড়ানো চোখে বিছানায় ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ নিয়ে সকালটা শুরু হলে তার মজাই আলাদা কি বলেন আপনারা। তাই দু হাত তুলে বলি আন্তর্জাতিক চা দিবসের জয়।
আন্তর্জাতিক চা দিবস - অভিজিৎ বসু।
21মে, দু হাজার চব্বিশ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন