গ্রাম ভুতুরা। জেলা বীরভূম। লাঠি হাতে সত্তরোর্ধ এই বৃদ্ধকে আমি দেখেছিলাম অনেক দিন আগে। খাটো ধুতি, কাঁধে গামছা, গ্রামের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন একা। বলতে নেই বৃদ্ধকে আমি দেখে কিছু জিজ্ঞাসা করতেই সাহস পাইনি। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে একমনে নির্নিমেষ দৃষ্টি তার। জানিনা কি দেখছিলেন, কি ভাবছিলেন তিনি। কিন্তু তার হাতের মুঠোয় ধরে থাকা লাঠিকে দেখে কিছুটা হলেও থমকে যাই আমি। শক্ত,ঋজু শিরদাঁড়ার মতো দাড়িয়ে থাকা এই বৃদ্ধ মানুষটির চোখের সামনে কত স্মৃতি,কত অচেনা অজানা কথা যে লুকিয়ে আছে কে জানে। কিন্তু একটু সংকোচে তাকে জিজ্ঞাসা করতে পারিনি আমি।
সাদা জীবনে কালো কথা লেখা উচিত কি না জানিনা, কিন্তু সেই সব টুকরো টুকরো কালো কথা যা কষ্ট দেয় মানুষকে, সেই সব কথা না লিখলে লোকরা জানবে কি করে। একটু ভরসা করে এগিয়ে গেলাম বৃদ্ধের কাছে। বললাম আপনি এই গ্রামে থাকেন? ঘাড় নেড়ে সায় দিলেন তিনি। তুমি কোথা থেকে আসছো বাবা। কার বাড়ির লোক তুমি? বললাম কারুর বাড়ি আসিনি। গ্রাম ঘুরতে এসেছি আমি, আর কোনো কাজ নেই আমার। কিছুটা হলেও থমকে গেলেন বৃদ্ধ। কিছুটা অবিশ্বাস নিয়ে বৃদ্ধ তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। দূরে নদীর পাড়ে বাঁধের রাস্তা ধরে লাইন দিয়ে লরি নামছে নিচে, নদীর মাঝি খানে গোল হয়ে ধুলো উড়িয়ে। লরির ধুলো বৃদ্ধের চশমার কাঁচের ওপর ধূসর আস্তরণ ফেলছে। ধুলো মেখে বৃদ্ধ দাড়িয়ে আছেন একা নদীর পাড়ে। লরি গুলো বালি তুলে যে যার মত ফিরে যাচ্ছে নিজের গন্তব্যে। এই দৃশ্য দেখার জন্য তো এই গ্রামে আসা।
বালি তোলার জন্য বিখ্যাত মহম্মদ বাজার ব্লকের ভুতুরা, চাতরমা, জয়পুর আর মোলপুর গ্রাম। ময়ুরাক্ষ্মী নদীর ধারের এই গ্রাম থেকে দিনে দুপুরে বালির লরি নামছে আর উঠছে। আর সেই লরি ওঠা নামার হিসাব কষে কিছু রোজগার করে গ্রামের কিছু যুবকরা।আর সেটাই দেখতে এসে থামতে হলো অবশেষে এই বৃদ্ধকে দেখে। বৃদ্ধ হলেও কিছুটা বুঝতে পেরে তিনি বলে দিলেন এটাই গ্রামের বেকার ছেলেদের রোজগারের একমাত্র পথ। কি আর করবে ওরা। সারাদিন লরি গুলোর হিসাব কষে কিছু রোজগার তো হয় ওদের। এছাড়া আর উপায় কি টাকা কামানোর। তাই পালা করে দিনে রাতে লরির ধুলো খেয়ে পেটের ক্ষিধে মেটায় ওরা। সবাই সব জানে পঞ্চায়েত, পুলিশ থেকে শুরু করে ঘরের লোকরা। কিন্তু উপায় নেই যে কোনো ওদের।
আসলে একদিন এই নদীর হাল এমন ছিল না। নদীর পাড় ধরে নিচে মাঝ নদীতে যাওয়া যেত না। বর্ষা হলে বাঁধ উপচে পড়ে গ্রামে জল এসে ডুবিয়ে দিত তাদের মাটির ঘর। সে সব দেখেই বয়স বেড়েছে বুধি মান্ডির। কিন্তু সেই সব দিন বদলে গেলো চোখের সামনে। নদী কেটে তোলা হচ্ছে বালি, যা দিয়ে ব্যবসা হয়। সেই ব্যবসা করে রমরমিয়ে বড়ো বড়ো পাকা বাড়ি ওঠে, গ্রামের কিছু নেতার আর তাদের সহযোদ্ধাদের। বাকি লোকরা সবাই সেই অন্ধকার জীবন নিয়ে কাটিয়ে দেয় সারা জীবন বুধির মতোই। কোনো রকমে এরা বেঁচে থাকে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে। মাঝে মাঝেই ভোট এলে নেতারা বলে আর লরির ধুলো মেখে তোদের লরির হিসাব নেওয়ার কাজ করতে হবে না। গ্রামে নতুন কারখানা হবে, এবার সবাই কাজ পাবে। শহর থেকে বাবুরা আসবে কারখানা করতে , কাজ পাবে গ্রামের সবাই। তারা বিশ্বাস করে নেতাদের এই কথা সবাই ,সত্যিই বোধ হয় এইবার ভোল পাল্টে যাবে গ্রামের।
ধুলো মাখা রাস্তার দিকে তাকিয়ে বুধিও স্বপ্ন দেখে কাজ পাবে তার নাতিও। তার জীবন তো শেষ। নাতিটা কাজ পেলেই তার শান্তি।সেই স্বপ্নে বিভোর হয়ে যায় বুধি মান্ডিরা। কিন্তু তাদের স্বপ্ন ভেঙে যায় ভোট মিটলেই ।আবার যে কে সেই অবস্থা। ঝড় উড়িয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে লরি। আর সেই লরির লাল ধুলোয় ঢেকে যায় বুধির চশমার কাঁচ। শক্ত হাতে তাই বুধি খুঁজে বেড়ায় সেই সব লোকদের যারা মুখোশ পরে বলেছিল ফিরবে গ্রামের হাল, মিলবে কাজ। তাই সে গ্রামে অচেনা লোক দেখলেই তাকে অবিশ্বাস করে। জিজ্ঞাসা করে কি জন্য ,কি উদ্দেশ্যে আসা তার গ্রামে। আবারো কি ভাঁওতা দিতে আসা গ্রামের লোকদের এই অচেনা মানুষের। তাই সে শক্ত হাতে লাঠি নিয়ে রাস্তায় নদীর বাঁধের ওপর ঘুরে বেড়ায় একা একা। আর বিড় বিড় করে আপন মনে বলে আর মিথ্যা কথা বললে কাউকে ক্ষমা করব না আমি, ছাড়বো না কাউকে সে যেই হোক। যে কোনো মূল্যে তাকে শাস্তি দেবে সে নিজেই।
ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে বুধি আমার দিকে। শিরা ওঠা দুর্বল হাতে লাঠিকে শক্ত হাতে ধরে। আমার নিজের কেমন অসহায় লাগে। নিজেকে কেমন ছোটো মনে হয়। ভাবতে থাকি কেনো যে এই গ্রাম দেখতে এলাম কে জানে। একটা চরম সত্যর মুখোমুখি হয়ে নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয়। বুধির ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে আমার ভিতরটা কেমন ফালা ফালা হয়ে যায়। নিজের ভিতরে রক্ত চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়তে থাকে।
ধীরে ধীরে গ্রাম ছেড়ে চলে আসি আমি। চোখে পড়ে বুধি তখনও শক্ত হাতে লাঠি নিয়ে কাকে যেনো খুঁজছে সন্ধ্যা নামে গ্রামে, তবুও সে একা খুঁজে বেড়ায় কাকে কে জানে।
সূর্যাস্তের আলোয় আলোকিত হয়ে যায় বুধির চোখ মুখ। শক্ত হাতে লাঠি ধরে বুধি এগিয়ে যেতে থাকে। ধীরে ধীরে সে হারিয়ে যায়। দ্রুত আমি গ্রাম ছেড়ে চলে আসি, আমার আর সাহস হয় না পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখতে, লাঠি হাতে বুধি নদীর পাড়ে কোথায় আছে। এখনো দাঁড়িয়ে আছে কি না। সন্ধ্যার অস্তরাগ বুধির লাঠির মাথায় পিছলে পড়েছে। আমি দ্রুত পা চালাই। ওকে গ্রামের রাস্তায় ফেলে রেখে আমি ঘরে ফিরে আসি। বুধির ছায়া আমাকে যেন তাড়া করে।
ভূতুরার বুধি মান্ডি - অভিজিৎ বসু।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন