ছোটো বেলায় দুলে দুলে চিৎকার করে পড়তাম একে চন্দ্র, দুয়ে পক্ষ। তিনে নেত্র। চারে চতুর্বেদ। পাঁচে পঞ্চ বাণ। ছয়ে ঋতু। সাতে সমুদ্র। আটে অষ্টবসু। আর নয়ে নবগ্রহ আর দশে দিক। এই যে নব গ্রহের কথা পড়তাম ছোটো বেলায় তখন কি আর বুঝতাম যে এই নটি গ্রহ জীবনের নানা উত্থান পতনের জন্য একমাত্র বল ভরসা মানুষের। তখন তো দুলে দুলে পড়ে গেছি তাদের কথাই আপনমনে। বড়ো হয়ে বুঝলাম এই নয়ে নবগ্রহ আসল চালিকা শক্তি মানুষের জীবনের। যার জন্য সব কিছু নির্ধারিত হয়।
এই নবগ্রহ হল হিন্দু জ্যোতিষশাস্ত্রের কিছু পরিচিত প্রতীক ৷ এই নয়টি প্রতীক যা , সৌরজগতের গ্রহসমূহের সাথে তুলনীয় ৷ যেমন :সূর্যদেব(সূর্য), চন্দ্রদেব(চন্দ্র), মঙ্গলদেব(মঙ্গল), বুধদেব(বুধ), বৃহস্পতি দেব (বৃহস্পতি গ্রহ), শুক্র দেব (শুক্র গ্রহ), এবং শনিদেব (শনি), আর রাহু ও কেতু ৷
যে নটি গ্রহের অবস্থানের হের ফেরে আমাদের জীবনের উত্থান পতন দায়ী বলে মনে করা হয়। কেউ বলেন আমার এখন শনির দশা চলছে। কেউ বলেন মঙ্গল ডাউন আছে এই সময়ে আমার। কেউ আবার বলেন আমার বৃহস্পতি তুঙ্গে এখন।আর কারুর মুখে শুনি রাহু কেতু ভালো অবস্থানে নেই। নানা গ্রহের অবস্থানের কারসাজিতে মানুষের জীবনের হাসি আর কান্না লুকিয়ে থাকে বলে মনে করা হয়। কিন্তু সত্যি কি এই সব গ্রহ নক্ষত্র আমাদের জীবনের ওঠা নামাকে কন্ট্রোল করে। না কি এগুলো সব মনগড়া একটা বিষয়।
জ্যোতিষশাস্ত্রে একটা খুব প্রচলিত কথা আছে সেটা হলো। ‘শনিবত্ রাহু’ ও ‘কুজবৎ কেতু’। রাহু ও কেতু অনেক বিষয়েই যথাক্রমে শনি ও মঙ্গলের মত বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে ও তদনুরূপ ফল প্রদান করে। সে যাই হোক আমার এই নবগ্রহ নিয়ে লিখতে গিয়ে মনে হলো যে সত্যিই তো এই নবগ্রহ কি জীবনের ঝড় ঝাপটা সামাল দেয়। না কি এদের কোনো প্রভাব নেই। সব নিজের কর্মফল আর প্রারব্ধ কর্ম ফলের ফল মাত্র।
ভালো কাজের জন্য ভালো ফল। আর খারাপ কাজের খারাপ ফল লাভ হবেই। সে এই জীবনেই হোক বা পর জন্ম বলে যদি কিছু থাকে সেই জন্মেই হোক। এটাই হলো নিয়ম জগতের। কেউ কেউ বলবেন না না এসব ঠিক কথা নয়। অনেকেই খারাপ কর্ম করে তো বেশ ভালই সুখে দিন যাপন করছেন। কই কিছুই খারাপ হয় না তাদের।
আপাতত ভালো দিন কাটলেও একসময় কালের নিয়মে খারাপ সময় আসবেই সুখের অনুভুতির পরে। এটাই হলো গ্রহের ঘূর্ণাবর্তের প্রভাব। শাস্ত্রের কথায় আছে, সুখানি চ দুখানি চ, চক্রানি পরিবর্তন্তে। সুখ আর দুঃখ চক্রের মতই ঘুরবে জীবনের রাস্তায়। সুখ এলে মনে হবে আমার দেবগুরু বৃহস্পতি তুঙ্গে আছেন। আর খুব খারাপ সময় গেলে মনে হবে শনি, রাহু, কেতু আমায় ঘিরে ধরে আছে। তাই এত ঘোর দুর্দিন।
সুর্য -
এখন এই নবগ্রহের অন্যতম গ্রহ সূর্য তার সাত অশ্বের রথে চড়ে এদিক ওদিক ঘরে বেড়ান। সূর্য (সংস্কৃত: सूर्य, Sūrya, "সর্বোচ্চ আলোক" নবগ্রহের মধ্যে যিনি প্রধান। তিনি ঋষি কশ্যপের পুত্র ৷ তার কেশ এবং বাহু স্বর্ণের ৷ তার রথ সাতটি ঘোড়া দ্বারা চালিত হয়। তার রথের সারথি হলো অরুণদেব। তার সম্মানার্থে সপ্তাহের একটি দিন হল রবিবার ৷ তার স্ত্রীর নাম সংঙ্গা ও ছায়া। তার অস্ত্র ভগবান বিষ্ণুর অস্ত্রের মতোই। শঙ্খ,চক্র,গদা ও পদ্ম। তার কয়েকটি নাম হলোঃ সূর্য, নারায়ণ, আদিত্য,রবি ইত্যাদি। সূর্যের সন্তানরা হলেন, কর্ণ,যম,যমুনা,শনি,ভদ্রা,তপতী,অশ্বিনী-কুমারদ্বয় প্রমুখ। এই সূর্য দেবতার পূজা করলে তাঁর আশীর্বাদ মেলে।
চন্দ্র-
চন্দ্র একজন দেবতা ৷ তিনি সুদর্শন, সুপুরূষ, দ্বি-বাহুযুক্ত ও তার এক হাতে অস্ত্র ও অন্য হাতে পদ্ম ৷ তিনি তার সাতটি হরিণের শ্বেত রথে চড়ে রাত্রে আকাশে উদিত হন ৷ তার সম্মানার্থে সপ্তাহের একটি দিন হল সোমবার ৷ তার গায়ের রং শ্বেতবর্ণ। তিনি মহাদেবের জটায় অর্ধচন্দ্র রুপে বিরাজমান। তিনি প্রজাপতি দক্ষের ২৭টি কন্যার জামাতা। এই চন্দ্রের আশীর্বাদ জীবনে সুখ শান্তি নিয়ে আসে।
মঙ্গল-
"মঙ্গল" হলেন ভূমির পুত্র ৷ তিনি যুদ্ধের দেবতা এবং অবিবাহিত ৷ তাকে পৃথিবী/ভূমি দেবীর পুত্র বলা হয়। তার দেহে বিজয় এবং গর্বের চিহ্ন বর্তমান, তার চতুর্বাহু ৷ তার সম্মানার্থে সপ্তাহের একটি দিন হল মঙ্গলবার। তার গায়ের রং লাল। তার বাহন মেষ।
বুধ-
বুধ হল একটি সংস্কৃত শব্দ যে শব্দের অর্থ হল গ্রহ। বুধ, হলেন একজন পৌরাণিক চরিত্র,এছাড়াও তিনি একজন দেবতাও। এছাড়াও তিনি আরও অনেক নামে পরিচিত যেমন সৌম্য যার অর্থ চন্দ্রের পুত্র, যার অপর নাম রোহিনেয়। যার অর্থ হলো রোহিণীর পুত্র এবং তার নামানুসারে সপ্তাহের একটি দিনের নাম বুধবার। বুধকে ভারতীয় গ্রন্থে একজন দেবতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রায়শই তাকে চন্দ্র এবং তারার(বৃহস্পতির পত্নী) পুত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এবং তিনি বিকল্পভাবে দেবী রোহিণী এবং চন্দ্রদেবের পুত্র হিসেবে বর্ণিত হন। তার চার হাত। তার পত্নী ইলা। শ্রীবুধের বাহন হলেন সিংহ। বুধ গ্রহের প্রভাব আছে জীবনে।
বৃহস্পতি/দেবগুরু-
বৃহস্পতি হলেন দেবগুরু। তাই বৃহস্পতি দেবতাদের সবার গুরু। তিনি অঙ্গীরা ঋষির পুত্র। তিনি মহাদেবের তপস্যা করেন। মহাদেব তার তপস্যায় তুষ্ট হয়ে তাকে দেবতাদের গুরু বা আচার্য পদে নিযুক্ত করেন। বৃহস্পতি চার হাত বিশিষ্ট। তার হাতে আছে দন্ড, পদ্ম ও জপমালা। তিনি হলুদ বর্ণের বস্ত্র পরিধান করেন। তার বাহন হস্তি। তার পত্নী তারা দেবী। তার সম্মানার্থে সপ্তাহের একটি দিন হল বৃহস্পতিবার। এই বৃহস্পতির প্রভাবে সংসারে জীবনে সুখ শান্তি সমৃদ্ধি বিরাজ করে।
শনি-
শনি নবগ্রহের একটি অন্যতম গ্রহ। শনি গ্রহকে গ্রহরাজ ও মহাগ্রহ বলা হয়ে থাকে। শনিদেব হিন্দুধর্ম মতে একজন দেবতা। জ্যোতিষীদের মতে শনির কুদৃষ্টি অশুভ ফল নিয়ে আসে জীবনে। তিনি খারাপের জন্য খারাপ ও ভালোর জন্য ভালো ফল বয়ে আনেন। সৌরজগতের শনি গ্রহ ও সপ্তাহের শনিবার দিনটি শনিদেবের নামে নামকরণ করা হয়। শনিদেব কে শনিশ্চর বা শনৈশ্চর নামেও ডাকা হয়। তার পত্নী ধামিনী। তার সন্তান মান্দী ও কূলিগ্না। তিনি সূর্যদেব ও ছায়ার পুত্র। তার চারটি হাত। তার হাতে আছে ধনুক,বাণ,ত্রিশুল ও গদা থাকে। তার গায়ের রং কালো। তিনি ধীর গতির তাই তিনি আস্তে চলেন। তার বাহন কাক বা শকুন। এই শনি দেবতার প্রভাবে নানা ধরনের ফল লাভ হয় মানব জীবনে।
শুক্র/দৈত্যগুরু-
শুক্র যে শব্দের অর্থ "নির্মল। এই দেবতা হলেন স্বচ্ছ, উজ্জ্বল, একজন প্রাচীন ঋষি ও দেবতা যিনি বৈদিক পুরাণ অনুসারে অসুর ও দৈত্যদের গুরু। তার সম্মানার্থে সপ্তাহের একটি দিন হল শুক্রবার। তিনি মহাদেবের তপস্যা করে মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যা প্রাপ্ত হন। এঁর বাহন হল সাদা ঘোড়া।
রাহু-
রাহু হিন্দু জ্যোতিষ অনুসারে,স্বরভানু নামে এক অসুরের কর্তিত মুন্ড। যে গ্রহণের সময় সূর্য বা চন্দ্রকে গ্রাস করে। জ্যোতিষশাস্ত্রে, একে নবগ্রহের মধ্যে একটি স্থান দেওয়া হয়েছে। দিবাভাগে রাহুকাল নামক মুহূর্তকে (২৪ মিনিট) অশুভ বলে গণ্য করা হয়। এর আবাস হলো পাতাললোকে। এর বাহন নীল বা কালো ঘোড়া। স্বরভানুর মুন্ডকে রাহু ও দেহকে কেতু নাম দেওয়া হয়েছে। ব্রহ্মাদেব রাহু ও কেতুকে গ্রহের স্থান দিয়েছেন। এর প্রভাব আছে মানব জীবনে বলে মনে করা হয়।
কেতু-
কেতু, পুরাণ অনুসারে, ইহা স্বরভানু নামক এক অসুরের মস্তকহীন দেহ। যা সমুদ্র মন্থনের সময় ভগবান বিষ্ণু আপন সুদর্শন চক্রের মাধ্যমে এর মুন্ড ছিন্ন করে দেন। বৈদিক জ্যোতিষশাস্ত্রে, একে নবগ্রহের মধ্যে একটি স্থান দেওয়া হয়েছে। কেতুর আবাস অসুরলোকে। কেতুর বাহন হলো চিল। কেতুর প্রভাব আছে জীবনে।
নবগ্রহ মন্দির-
নবগ্রহ মন্দির আসামের গুয়াহাটিতে অবস্থিত প্রাচীন মন্দির। যে মন্দিরে এই নবগ্রহের পূজো করা হয়। এই নবগ্রহ মন্দির আসামের গুয়াহাটী মহানগরের চিত্রাচল পাহাড় (নবগ্রহ পাহাড়)এ অবস্থিত এক প্রাচীন মন্দির। এখানে সূর্যকে ধরে ন'টা গ্রহের শিলাচিহ্ন আছে৷ এখানে থাকা বিভিন্ন গ্রহের শিলাচিহ্নগুলি হল- সূর্য, চন্দ্র, মঙ্গল, রাহু, শনি, কেতু, বৃহস্পতি, বুধ এবং শুক্র।
এই মন্দির অতি প্রাচীন এবং ঐতিহ্যসম্পন্ন৷ নবগ্রহ মন্দিরের সঙ্গে অনেক কিংবদন্তি এবং জনশ্রুতি জড়িত হয়ে আছে৷ এই মন্দির কবে কে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তার সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। এই মন্দিরের প্রাঙ্গণে থাকা এক শিলালিপি অনুসারে ১৭৫২ সালে আহোম স্বর্গদেউ রাজেশ্বর সিংহ মন্দিরটি নতুন করে নির্মাণ করিয়েছিলেন বলে জানা যায়৷ ১৮৯৭ সালের বিরাট ভূমিকম্পে এই মন্দিরটির বিস্তর ক্ষতি হয় এবং পরে ধর্মপ্রাণ রাজার সহযোগিতায় পুনর্নির্মাণ করা হয় এই মন্দিরের।
এই মন্দিরে দৈনিক নবগ্রহের পূজা-পাঠ হওয়ার সঙ্গে প্রতি বছর মাঘ-ফাগুনের সংক্রান্তিতে মহা সমারোহে তিনদিন ধরে মহাযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়৷ এই মন্দিরে কোনো বলি-বিধানের ব্যবস্থা নেই, যদিও ছাগল, হাঁস ইত্যাদি উৎসর্গ করার সাথে ব্যক্তিগত যাগ-যজ্ঞ হোম ইত্যাদি করা হয়।
এই নবগ্রহ হলো ৯টি গ্রহ। জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত দেবতাদের দল তাঁরা সবাই। যে দেবতারাই আমাদের জীবনের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে এদিক ওদিক করেন বলে অনেকেই মনে করেন। সেই ছোটো বেলায় নামতা বইয়ে পড়া নয়ে নবগ্রহ। যা তখন বুঝিনি শুধু মুখে আউড়ে গেছি। যার প্রভাবে সংসারে, জীবনে, নানা ঝড় ওঠে, ঝাপটা আসে। আর আমরা সেই সবকে সামলে জীবনের রাস্তায় হাসি মুখে চলার চেষ্টা করি। আর মুখে বিড় বিড় করে বলি জয় নবগ্রহের জয়।
নয়ে নবগ্রহ - অভিজিৎ বসু।
আটাশে মে, দু হাজার চব্বিশ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন