ফ্ল্যাটের বেলটা বাজিয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল বুটা। একে বাইরে প্রচণ্ড গরমের ঝাপটা। তার ওপর ওর হাতে নানান ঘরের টুকিটাকি জিনিস নিয়ে সে ঘরে ফিরেছে। রাতের খাবার কিনে ঘরে ফিরছে সে। কদিন আগেই বাড়ী এসেছে সে কলেজের ছুটিতে বোলপুর থেকে শ্রীরামপুরের বাড়িতে। কিন্তু কই কেউ তো দরজা খুলে দিলো না। আবারও বিরক্ত হয়ে বেল টিপলো বুটা। কই না তো ঘরে কোনো সাড়া শব্দ নেই। দরজা বন্ধ ভিতর থেকে।
এই তো একটু আগেই ফোনে কথা হলো ওর বুর সাথে। তাহলে কি হলো রে বাবা। কেমন একটা অস্বস্তি বোধ হতে লাগলো ওর। কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না সে এই অবস্থায়। এমন তো হয় না কোনো সময়। যে মানুষটা সারাদিন এই কোথায় তুই। কি করছিস। কি খেলি। বলে সারাদিন পিছনে লেগে থাকে সেই মানুষটার ফোন এর কোনো উত্তর নেই কেনো এই ভরসন্ধ্যা বেলায়। বুটার সারা শরীরে একটা অজানা ভয় ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত। দরদর করে ঘামছে সে ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। মাকে ফোন করলো বললো মা ঘরের দরজা বন্ধ। ভিতর থেকে খুলছে না দরজা বু। কোনো সাড়াশব্দ নেই কারুর।
ফ্ল্যাটের সিঁড়িতেই বসে পড়েছে সে। কি করবে মাথায় আসছে না আর। মাথা কাজ করছে না কিছুতেই। ছাদে গিয়ে দেখবে কি এসি চলছে কি না তাহলে যদি কিছু হয় দরজা খোলে। এই সব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে রিষড়াতে দাদাকে ফোন করে বুটা। দাদা বু ঘরের দরজা খুলছে না। সেকি রে। কেনো কি হলো। এই তো সন্ধ্যা হবার আগে কত কথা হলো ছেলের সাথে। কত জ্ঞান দিলো আমায়। তারপর কি হলো। বুকটা ধক করে উঠল। কু ডাকলো মনটা মঙ্গলবারের সন্ধ্যায়।
খালি ছেলেটা বলতো শনি দেবতা আমার আর ভালো করছে না কিছুতেই। ঘোর শনি চলছে আমার। কি সব উল্টোপাল্টা বলতো সারাদিন। কিছুতেই মাথা নিচু করে মাথা ঠাণ্ডা করে কাজ করতে পারে না কিছুতেই কোনো জায়গায় কোনো অফিসে। তাই তো ছেলেটা কেমন যেনো হয়ে যাচ্ছিল দিন দিন। মা মারা যাবার পর যেনো এই কেমন হয়ে গেলো ছেলেটা। তাই বলে দরজা বন্ধ করে ঘরে কি হলো রে বাবা। দাঁড়া আমি আসছি বুটাকে এইকথা বলে দৌড়ে জামা পড়তে থাকে বাবা।
এদিকে বোলপুরের ঘরে একা বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছে কত কথাই সোমা। লোকটার যদি একটু বোধ বুদ্ধি থাকতো। দুম দাম করে কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে এলো যখন তখন। সত্যিই তো সেই বা কি করে সংসার বাঁচিয়ে রাখবে। আর কত দৌড়বে সে এই বয়সে। আর যে পারছে না সে দৌড়তে এই সংসারের বোঝা মাথায় নিয়ে। এত বয়স হলো একটু কি আর বোধ বুদ্ধি হলো মানুষটার। সারাটা জীবন হৈ হৈ করে কাটিয়ে দিলো। কোনো ভাবনা চিন্তা কিছুই নেই। কি আর বলেছি আমি শুধু এটাই যে একটু চিন্তা ভাবনা করে চলো। এরপর মেয়েটার একবছর পড়া বাকি এখনো। কি করে হবে ভাবো তুমি কিছু। নিজের কথা একটু ভাবো এইবার।
এই কথা বলতেই দুম করে ফোনটা কেটে দিলো মানুষটা। এই এক রোগ লোকটার পছন্দ না হলে এই ভাবে পালিয়ে যায় সব জায়গা থেকে দুম করে রাগ দেখিয়ে। সে ঘরের সংসার হোক আর বাইরের জগৎ। কিন্তু আবার মেয়েটার ফোন মা দরজা খুলছে না বু। সত্যিই তো কি যে হলো মানুষটার। নানা কুকথা মনে উঁকি দেয় তার। কিন্তু মেয়ে একা আছে বলে দেখ নিশ্চয়ই খুলবে দরজা। তুই বাইরে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়া দাদা এলে ঘরের সামনে যাস। উল্টো দিকের ফ্ল্যাটে তখন ছাত্র ছাত্রীদের প্রাইভেট পড়ার ভীড়। কেউ মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করছে না কি হলো। ঘরের বেল এর আওয়াজ শুনেও।
সত্যিই কি অদ্ভুত এই ফ্ল্যাট বাড়ির এই দেয়াল আর ওই দেয়ালের বাসিন্দাদের দূরত্ব যেনো শতক যোজন দুর। কি অদ্ভুত বিচিত্র সব জীবন যে এই সব দেশলাই বক্সের ভেতর সেজে গুজে বাস করে কে জানে। এই সব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যায় বুটা। ফ্ল্যাটের রাস্তায় নেমে একটু হাওয়া পেয়ে একটু ভালো লাগে ওর শরীরটা। কেমন যেনো একটা দিশাহারা ভাব ওকে ওর চারপাশে গোল হয়ে ঘিরে রাখে ওর ছোটো জীবনকে।
বু তো সারাদিন রাত জেগে থাকে। ঘুম আসেনা তার দু চোখে। তাহলে কি হলো। আর কিছুই ভাবতে পারে না আর সে। সারা শরীরটা টল মল করে তার। আর ভাবতে পারে না কিছুই। সে বড়ো ভীতু, দুর্বল প্রকৃতির। কি করবে ভাবতে ভাবতে আবার একটু শরীর জুড়িয়ে নিয়ে ক্লান্ত পায়ে হেঁটে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে বেল টিপে অপেক্ষা করে সে। যদি দরজা খুলে একমুখ বোকা বোকা হাসি নিয়ে তার বু বলে কিরে খাবার এনেছিস তুই বলে দাঁড়িয়ে থাকে।
আমার শব্দ না থাকা ভাইব্রেট মোডে থাকা আমার একমাত্র বন্ধু ফোনে তখন অবিরাম বৃষ্টির ধারার মত ফোন আসছে একের পর এক। শান্তির, ক্লান্তির গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন আমি এক অন্য দেশের মাটিতে নিজের ঘর দুয়ার ছেড়ে। আরও গভীর একটা ঘুমের দেশে আমি ভেসে বেড়াচ্ছি আপন মনে। কোনো সাড়াশব্দ নেই আমার। গরমে আর বাইরে না বেরিয়ে ঘরেই শুয়ে পড়ে আছি এই অবেলায়। চোখটা একটু লেগে গেছে মাত্র। ফোনে কথা বলতে বলতে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছি কখন খেয়াল নেই আমার নিজের।
আর সেই আমার একমাত্র বন্ধু ফোনটা হাত থেকে পাশে পরে আছে মেঝেতে উল্টে। সেই ফোনে কত মানুষের উদ্বিগ্ন হওয়ার ভালোবাসার ঝাপটা লাগছে যে বারবার সেটা আমি টের পাচ্ছি না কিছুতেই। দীঘার সমুদ্রের ঢেউ এর মত আছড়ে পড়ছে সব ঢেউ। আমি অকাতরে একাত্তরে বুড়োর মত ঘুমের দেশে ভেসে যাচ্ছি হা করে। আমার ঘুমিয়ে থাকা কল কল করা জীবন কেমন যেন চুপ করে গেছে আচমকাই দুম করে।
আসলে গোটা জীবনটাই তো চুপ করে দাঁড়িয়ে গেছে বহুদিন আগেই আমার। তাই এসব নিয়ে আর কোনো উত্তেজনা অনুভব করিনা আমি। হালকা একটা আওয়াজ শুনে ঘুমের দেশে ভেসে থাকা আমি যেনো একটু পাশ ফিরলাম এদিক থেকে ওদিক। কিন্তু আবার সেই দুর থেকে ভেসে আসছে একটা ঘন্টার রিন রিন আওয়াজ। ভেসে যাওয়া আমি থমকে দাঁড়িয়ে গেছি আমি। শূন্যতায় ভেসে যাওয়া আমি, পৃথিবীতে বন্ধুহীন আমি, আত্মীয় স্বজনহীন আমি, কর্মহীন আমি, বউ এর গাল শোনা আমি, বোকা মানুষ একটা আমি আবার ধীরে ধীরে জেগে উঠে বন্ধ দরজা খুলে দিলাম।
দেখলাম আমার আত্মজ বুটা একবুক ভালোবাসা নিয়ে, উদ্বিগ্নতা নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমায় বকছে ওর নিজের স্বভাব সুলভ ঢঙে কি যে করো তুমি বু। কোনো দায়িত্ব জ্ঞান কিছুই নেই তোমার। এত বয়স হলো তুমি দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়লে কি করে। মনে হলো না একবার ও যে আমি বাইরে আছি দরজা বন্ধ কি করে ঘরে আসবো। কত মানুষ ফোন করেছে দেখো তুমি। আমি বেবাক বোকা সোকা মানুষ হয়ে ঘুম জড়ানো চোখে ভাবলেশহীন হয়ে বুটার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
একদম ওর মার মতই ও আমায় বকে চলেছে অবিরাম চোখ পাকিয়ে। আর একে ফোন করছে, ওকে ফোন করছে আর বলছে, হ্যাঁ উঠেছে। দরজা খুলেছে এই বার। ঘুমিয়ে পড়েছিল এই অসময়ে। সব কিছুর মাঝে ওর চোখের উদ্বিগ্ন ভাব, ভালোবাসার ছোটো ছোট স্পর্শ আমার সারা শরীরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে নানা দিক থেকে।
আমি অনুভব করলাম আবার নতুন করে এই ক্ষুদ্র, অর্থহীন, কর্মহীন, শব্দ হীন, জীবনের জোছনায় এখনো চাঁদ ওঠে আকাশে মাঝে মাঝে। ঘুম জড়ানো চোখে দেখতে পেলাম চাঁদকে। আমি একদৃষ্টিতে বুটার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ওর মুখে গজ গজ করা বকা, আর শাসন খেতে খেতে দেখলাম কেমন একটা গভীর ভালোবাসা দিয়ে ও জড়িয়ে ধরে আছে ও আমাকে ওর একমাত্র বুকে পরম মমতায়, গভীর ভালবাসায়। আমি মুগ্ধ হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম বোকার মত।
কলিং বেল - অভিজিৎ বসু।
উনিশে জুন, দু হাজার চব্বিশ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন