জাগো, তুমি জাগো। জাগো দুর্গা, জাগো দশপ্রহরণ ধারিণী। এই গানটা শুনলেই কেমন বুকের ভেতর ঢাকের বাদ্যি গুড়গুড় করে বেজে ওঠে আমার আপনার সবার। শুধু আমার কেনো এই গান শুনে মনের ঈশান কোণে জমে থাকা এক চিলতে মেঘ কেটে যায়নি এমন লোক পাওয়া ভার বোধহয়। আসলে এই বাংলার চারদিনের দুর্গা পুজো তো এখন আর সার্বজনীন নয় বিশ্বজনীন। আমাদের ঘরের মা দুর্গা তো এখন আর শুধুই চারদিন এর গন্ডিতে আটকে নেই।
যদিও সেই পুজোর এখনও ঢের বাকি আছে। তবুও কেমন যেন এই ভরা শ্রাবণের মেঘে ঢাকা আকাশেও কেমন শরতের নীল আকাশ এর ছোঁয়া লেগে গেলো সবার অগোচরে। পুজোর গন্ধ মাখা, শিউলি ভরা সকাল আমাদের দুয়ারে হাজির হল বলে। এই সেই বহু পুরোনো গানের সুরের মুর্ছনায়। আসলে পুজো আসবে, পুজো আসছে এই কাউন্ট ডাউন বেশ একটা আনন্দের। জীবনের হাজার ঝড় ঝাপটার মাঝে মা দুর্গার আরাধনা আসলে আমাদের জীবনে একটা যেনো দখিনা বাতাসের মত। জীবনের এই চারটে দিন সব কিছু ভুলে আনন্দে নেচে ওঠা। ভুলে থাকার চেষ্টা করা সারা বছরের পুরোনো দুঃখ আর কষ্টের লড়াই এর দিনগাঁথা কাহিনী।
আর সেই বাতাসের ছোঁয়া যিনি লাগিয়ে দিলেন এই ভরা বর্ষায় সেই আমাদের সবার মনে তিনি হলেন আমাদের সবার প্রিয় দিদি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একেবারে হাসি মুখে ঘোষণা করলেন পুজোর অনুদান বেড়ে গেল এইবার কিছুটা। আপনারা ভালো করে পুজো করুন,আনন্দ করুন। সামনের বার আরও কিছু টাকা বাড়িয়ে দেবেন তিনি।
শুধু একটাই অনুরোধ পুজো কর্তাদের কাছে কি পুজোর মণ্ডপ তৈরি হচ্ছে বা কি মূর্তির পরিকল্পনা করবেন পুজো কর্তারা সেটা যেনো একটু আগাম বলে দেওয়া হয় স্থানীয় প্রশাসনকে। যাতে ভীড় সামলানো যায় পুজোর চারদিন। কোনো পুজোর সময় যেনো কোনো বিতর্ক সৃষ্টি না হয়। এটাই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুরোধ সবার কাছে। তাই তো সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের বার্তা দিতে সবাইকে নিয়ে পুজোর বৈঠক সেরে ফেললেন তিনি। একদম হাসি মুখে আর সব শেষে নিজেই গানের সুরে পুজো আগমনের বার্তা দিয়ে দিলেন তিনি।
আসলে এই ভাবে তো আর বাংলার পুজো নিয়ে কেউ ভাবেন নি কোনো দিন। পুজোর খরচ জোগাতে দরাজ হস্ত হয় নি কোনো সরকারও। যাই হোক দু হাজার ছাব্বিশ এর ভোটের রাজনীতিতে এর যাই প্রভাব পড়ুক তার জন্য আগাম ঘোষনা সেরে ফেললেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। নিন্দুকেরা যাই বলুক অদূর ভবিষ্যতের কথা ভেবে এমন হিসাব কষে পুজোর পরিকল্পনা আগে কোনো দিন হয়েছে বলে আমার মনে নেই।
আসলে আমাদের সেই পূজোর গন্ধ মানেই তো নতুন জামার অচেনা গন্ধ। সেই যে কবে থেকে কত মধুর অপেক্ষার পর পাড়ার দর্জি ছোটো ভাই আর বড়ো ভাই এর দোকানে জামা প্যান্টের মাপ দেবার পর ডাক পড়তো আমার। সেই ডাক ছিল ট্রায়াল দেবার ডাক। আর সত্যিই সেই ডাক পড়লে বুঝতে পারতাম পূজোর আর বেশি দূরে নেই একদম। দুরু দুরু বুকে হাজির হতাম দর্জির দোকানের ভেতর। জামা আর প্যান্ট পরে দেখে ট্রায়াল দিয়ে হাসি মুখে বেরিয়ে আসতাম আমি সেই দোকান থেকে। পাড়ায় তখন বাঁশ পড়ে গেছে পাড়ার পূজোর মাঠে। স্কুল থেকে ফিরে এসে সেই বাঁশের খুঁটি ধরে খেলা চলছে আমাদের জোরকদমে।
তখনও পাড়ায় পাড়ায় থিমের জোয়ারে ভেসে যায়নি মা দুর্গার মণ্ডপ।পূজো নিয়ে কেউ কোনো সরকার এই ভাবে ভাবতে শুরু করেনি। এত সরকারি অনুদান মেলেনি কোনোদিন পুজোর সময়। মণ্ডপের কাঠামো, মা দুর্গার মুর্তি নিয়ে হাসি মুখে কেউ ফরমান জারি করে নি কোনো দিন। পাড়ায় পাড়ায় তখন সন্ধ্যা হলে অফিস থেকে ফিরে চা জল খাবার খেয়ে ক্লাবের ছেলেরা চাঁদার বই নিয়ে কাকিমা, জেঠিমা বলে হাঁক দিত বাড়ির দরজায়। আর সেটা শুনে রান্না ঘর থেকে হাসি মুখে বেরিয়ে এসে বলতেন কাকিমা জেঠিমারা, এইবার কিন্তু পুজোয় একটু কম টাকা দেবো বাবা চাঁদা। কারন কাকুর কারখানা বন্ধ আছে একটু সমস্যায় আছেন তারা। চিন্তা নেই মাসীমা আপনার যা মনে হয় দেবেন। বলে হাসি মুখে চলে যেতো পাড়ার ছেলে পুলের দল।
তারপর মা আসতেন মণ্ডপে। সেই ঘাম তেলে মাখা মায়ের চকচকে মুখ, সুন্দর চোখ, অসুরের বুকের মাঝে ফোঁটা ফোঁটা রক্তের দাগ, পূজোর মণ্ডপে মন্ত্র পাঠ, কাঁসর ঘণ্টার আওয়াজ। ধূপের ধুনোর গন্ধে ঢেকে যাওয়া সাদা কাপড়ের কম দামি মণ্ডপ কেমন যেন অচেনা লাগতো। নতুন জামা কাপড় পড়ে হৈ হৈ করে কেটে যেতো পুজোর চারটে দিন। আসলে এগুলো মনে পড়লে কেমন বেশ ভালো লাগে।
বহুদিন পর কাল সেই শ্রীরামপুরের রাস্তায় হেঁটে বেড়ালাম সন্ধ্যা বেলায়। সেই সব চেনা রাস্তায় যে রাস্তায় আমার শৈশব কেটেছে। সেই ছোটো বেলায় জমজমাট ভীড়ে ঠাসা লাহিড়ী পাড়ার পুজো মণ্ডপের সাথে গোস্বামী পাড়ার পুজো মণ্ডপের মিষ্টি মধুর প্রতি যোগিতা চলতো। আজ যেনো সেই সব আনন্দ মিলিয়ে গেছে কোথায়। পুজো এখন বিশ্বজনীন। পুজো নিয়ে ভাবছেন সরকার থেকে শুরু করে প্রশাসন পুলিশ সবাই। কিন্তু হাজারো ভাবনার ভীড়ে সেই পূজোর ভীড়ে মিশে হারিয়ে যাওয়া শৈশবের সেই মিষ্টি মধুর দিন কোথায় যে চলে গেলো কে জানে।
সেই পাড়ার চেনা দর্জির দোকান আর নেই। আর অষ্টমীর সন্ধ্যায় সেই নতুন লাল ফ্রক পড়া মামার বাড়িতে ঠাকুর দেখতে আসা আগুন রং এর জামা পরা সেই লাল টুকটুকে ঠোঁট নিয়ে চুপ করে মার দিকে তাকিয়ে থাকা মেয়েটিকে কতদিন যে আর দেখতে পাইনি কে জানে। হয়তো সেও হারিয়ে গেছে কোথায় দূরে বহু দূরে। কতদিন দুরু দুরু বুকে আগলে রেখেছি আমার প্রথম দেখা রাজকন্যের সেই সুন্দর পানপাতার মত মুখ। ওর ঠোঁটের নিচে ছোটো কালো তিল আমায় কেমন পাগল আর মোহময় করতো সেই ছোটো বেলায়। যে মুখের খোঁজ মেলেনি বহুদিন। যে মুখের চারিদিকে শ্রাবস্তীর কারুকার্য, চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশার মত যে নেশা ধরাতো আমার কচি একরত্তি মনে। যে মনটাও আজ হারিয়ে গেছে কোথায় কে জানে।
না, সাহস করে কোনো দিন বলতে পারিনি আমি তাকে আবার সামনের বার পুজোয় আসবে তো তুমি, দেখা হবে আবার। ওর স্থির নির্নিমেষ বোবা চাহনি দেখে আমি সাহস করে সে কথা জিজ্ঞাসা করতে পারিনি কোনোদিন, কিছুতেই। আজ কতদিন পর ভোর বেলায় যে মনে পড়ে গেলো এই জোর ডাক শুনে।
সেই কিশোর বয়সের একটি ছেলের এক টলটলে দীঘির জলে ডুব দেওয়া পানকৌড়ির মত সুন্দরীর প্রতি আকৃষ্ট হবার, মুগ্ধ হবার ডাক। দু চোখে প্রথম ভালবাসার সেই সুখ স্মৃতিকে বুকে আগলে নিয়েই তো বেঁচে থাকা। এত দিন পর ঝিরি ঝিরি বর্ষায় পুজোর সেই গান আর ডাক শুনে মনে হলো একটি বার যদি সেই মেয়েটিকে বলতে পারতাম, বুকে সাহস এনে। তুমি আসবে তো আবার পুজোয়।
সেই আগুন রং এর মেয়েটি দু ঠোঁটের মাঝে এক চিলতে চাপা হাসি ছড়িয়ে যদি একটি বার আমার কথার উত্তর দিত। যে কথা তাকে বলতে পারিনি। যদি চুপ করে স্থির হয়ে ওর টলটলে দীঘির জলে ভেজা পানকৌড়ির মত শরীর নিয়ে উঠে আমার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে একটি বারও ভীড়ের মধ্যে দেখতো আমায়। তাহলে কি ভালই যে লাগতো আমার কে জানে।
বাজলো পুজোর বাদ্যি - অভিজিৎ বসু।
চব্বিশ জুলাই, দু হাজার চব্বিশ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন