নীল ফেসবুকের দেওয়ালে বাঁশের বিক্রির উজ্জ্বল বিজ্ঞাপন। জ্বল জ্বল করছে এই লেখাটা। রাতের অন্ধকারে আমার চোখ এড়ালো না স্বাভাবিক ভাবেই। তাতে অনেকেই কমেন্টস বক্সে লিখেছেন কি ধরনের বাঁশ বিক্রি করা হবে।
আসলে এই বাঁশের কেল্লা নিয়ে আর বাঁশের খুঁটি নিয়েই তো আমাদের গোটা একটা জীবন কেটে যায়। যে জীবনে বাঁশের বিক্রি হয় কখনও জানতে, কখনও আবার নিজের অজান্তেই। সেটা কি আর আমরা বুঝতে পারি, কে জানে হয়তো বুঝেও চুপ করে থাকতে হয় জীবনের নিয়ম মেনে আর সম্পর্কের জটিলতা মেনে।
আর তাই এই বাঁশ বনের ভেতর দিয়ে চলাচল করতে করতে আমি বুঝতে পারি বাঁশবনেই তো দেখা হয়েছিল সেই ভূতের রাজার সাথে গুপী আর বাঘার। যারা জীবনে অপাঙতেও ছিল একসময়। তারা তো বাঁশ বনেই তাদের জীবনের সেরা তিন বর লাভ করেছিল একসময় সততা আর নিষ্ঠার জোরে। তাহলে আর দোষ কোথায় এই বাঁশ বিক্রির বিজ্ঞাপন প্রকাশ্যেই প্রকাশ করায় এত কথা কিসের।
যাই হোক সাধারণ ভাবে আমি বুঝি বাঁশকে এদিক থেকে ওদিক নিয়ে যাওয়া হয় কোনো সময় নদীপথে আবার কখনও লাল কাপড় গায়ে জড়িয়ে তিন চাকার ভ্যান করে সড়ক পথে। জলের ওপর যখন সে যায় সে তখন ঠিক মত ভেসে থাকে চুপটি করে চলে যায়। কিন্তু রাস্তায় ভ্যানের ওপর কেমন বেসামাল হয়ে যায় তার সারা শরীর। রাস্তায় যাবার সময় তার সেই পুরোনো খোঁচা মারা অভ্যাস চাগিয়ে ওঠে বারবার। যেটা জলপথে পার হবার সময় দেখা যায় না কিছুতেই।
সে চুপ করে মুখ বুজে থাকে। জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ সহ্য করে, জলের ঝাপটা, ঢেউ সহ্য করে মুখ বুজে পড়ে থাকে কখন ডাঙায় উঠবে এই অপেক্ষায় থাকে সে। সুযোগের অপেক্ষায় প্রহর গোনে সে চুপটি করে, জলে ভিজে, নেয়ে, একসা হয়ে। ঠিক যেভাবে বাঁশের বনের ভেতর দিয়ে শুকনো পাতার গন্ধ গায়ে মেখে হলদে ছোপ ছোপ নাম না জানা সাপ হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে চলে এদিক থেকে ওদিক কাউকে বুঝতে না দিয়েই চুপটি করে।
আর এই ভাবেই তো বাঁশের খোঁচায় রক্তাক্ত হয় সুন্দর পেলব দুধে আলতা ফর্সা জীবন হঠাৎ কেমন নীল হয়ে যায়। যে জীবনের রাস্তায় কোনো ঝোপ, ঝাড়, জলা, জঙ্গল কিছুই দেখা যায়নি কস্মিন কালেও। সেই রাস্তায় তো হঠাৎ আচমকাই বাঁশ বনের ছোটো বড়ো,মেজো, সেজো,ছোটো,খুড়ো এমন কি বাড়ির ন ছেলের নামের বাঁশও যে বড়ই যাতনা দেয়। যে যাতনায় জীবন অতিষ্ঠ হয়। যে যাতনায় কখনও চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত চুপ চাপ ঝরে পড়ে সবার অগোচরে। আবার কেনো সময় বাঁশের ডগার আঘাতে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় গোটা একটা জীবন। এদিক ওদিক মাঠের মাঝে ঘুরে পড়ে থাকে গোটা একটা শরীর, গোটা জীবন। যার থেকে উঠে দাঁড়াবার, ঘুরে দাঁড়াবার কোনো ক্ষমতা থাকে না আর।
আর বাঁশ বিক্রি করা মানুষজন কি রকম জুল জুল করে মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে একবার নিজের পিঠ চাপড়ে দেয় সবার অজান্তে। আর একবার দুর থেকে সহানুভূতির ছোঁয়া মাখা হাসি ছড়িয়ে দুঃখ প্রকাশের নাটক করে মাত্র সবাইকে দেখিয়ে। সত্যিই বাঁশের খোঁচা না খেলে কি আর এত কিছু দেখার সৌভাগ্য হতো কে জানে। জীবনের রঙ্গমঞ্চে তাই এই বাঁশের বিক্রির বিজ্ঞাপন তো শুধুই ভালবাসার পরশ মাখা নরম বাঁশ বিক্রি নয় মাত্র। এর সাথে লুকিয়ে আছে নানা রকম মাপা, হিসেব নিকেশ করা খোঁচায় রক্তাক্ত হবার অভূতপূর্ব স্বাদ আস্বাদন।
যা মানুষের জীবন এর অতীত বর্তমান আর ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করে দেয় এক খোঁচায়। সত্যিই যিনি এই বিজ্ঞাপন প্রকাশ করেছেন তিনি সত্যিই অসাধারন একটা উপস্থাপনা করেছেন এমন একটি পোস্ট করেছেন। না হলে কি আর এমন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় এর কথা লেখা যেতো। আজকাল কে আর বাঁশ কিনতে চান বলুন। সেধে সেধে যেচে বাঁশ কিনবেন। ঘরে বাঁশ কিনে ঘরে ফিরবেন এমন মানুষের দেখা মেলা ভার আজকাল।
তবে সবুজ নির্জন রাস্তায় বাঁশ বনের ভেতর দিয়ে হেঁটে হেঁটে ঘরে ফেরা। যে রাস্তায় জোনাকির আলো পূর্ণিমার চাঁদকে ম্লান করে পথ দেখায় পথিককে তার নরম আলো দিয়ে। যে আঁধার রাতে জোনাকির আলো গায়ে মেখে আর ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক শুনে দূরে ব্যাঙের গম্ভীর গলায় ডাক শুনে পথ পার হতে হয়। সেই পথে থাক না ঝুঁকে পড়া বাঁশ বনের ঘন নিবিড় জঙ্গল ভয় কি তাতে।
হয়তো দু একটা শৃগাল আচমকা রাস্তার পাশে ঝুপ করে এদিক থেকে ওদিক পার হতে পারে তাতেও ক্ষতি কি আর। সবুজ বাঁশের পাতায় লেগে থাকা জোনাকির আলো দেখতে যে বড়ো মায়াবী লাগে। যে আলোর কাছে ম্লান হয় চাঁদের উজ্জ্বল নক্ষত্র মাখা আলোও।
সত্যিই তো যে বাঁশবন গুপী গায়েন আর বাঘা বায়েন এর জীবন বদলে দিল। সেই বাঁশ বন পার হতে ভয় কিসের। না হয় একটু খোঁচা খেতে হবে। একটু রক্তাক্ত হতে হবে। কিন্তু নতুন ভোরের আলো মাখা সেই দিন এর দেখা মিলবেই একদিন না একদিন। যে নতুন ভোর, নতুন প্রভাত, আমাদের সব দুঃখ, কষ্ট, জ্বালা, যন্ত্রণা, ভুলিয়ে দেবে একদিন। আমরাও গেয়ে উঠবো সেই গুপী বাঘার বিখ্যাত গান, দেখরে নয়ন মেলে জগতের বাহার।
বাঁশ বিক্রির বিজ্ঞাপন - অভিজিৎ বসু।
দশ জুলাই, দু হাজার চব্বিশ।
চমৎকার লেখা। দারুণ লাগলো।
উত্তরমুছুন