তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে
সব গাছ ছাড়িয়ে
উকি মারে আকাশে।
মনে সাধ কালো মেঘ ফুঁড়ে যায়—
একেবারে উড়ে যায়—
কোথা পাবে পাখা সে?
তাই তো সে ঠিক তার মাথাতে
গোল গোল পাতাতে
ইচ্ছাটি মেলে তার
মনে মনে ভাবে বুঝি ডানা এই,
উড়ে যেতে মানা নেই
বাসাখানি ফেলে তার।
সারা দিন ঝর্ঝর্ থত্থর
কাঁপে পাতা-পত্তর,
ওড়ে যেন ভাবে ও,
মনে মনে আকাশেতে বেড়িয়ে
তারাদের এড়িয়ে
যেন কোথা যাবে ও।
তার পরে হাওয়া যেই নেমে যায়,
পাত-কাঁপা থেমে যায়,
ফেরে তার মনটি—
যেই ভাবে মা যে হয় মাটি তার,
ভালো লাগে আরবার
পৃথিবীর কোণটি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
সাদা জীবনের কালো কথায় আজ শুধু তাল কুড়োবার গল্প। জীবনে তাল রাখতে না পারা এই আমি যে একদম অচল, বেমানান এই জগত সংসারে সেই মানুষটাই আজ দুপুর বেলায় ছোট্ট শিশুর মত রাস্তার ধারে মাটির ওপর, মাঠের ধারে পড়ে থাকা তাল দেখে উৎফুল্ল হলাম আনন্দ পেলাম। মনটা বড়ো ভালো হয় গেলো যে কেনো কে জানে। হয়তো গুটিয়ে যাওয়া, বুড়িয়ে যাওয়া, নিভে যাওয়া ইচ্ছা ডানাগুলো আচমকাই ডানা ঝাপটালো ওই নিদাঘ ঘেমো নিস্তরঙ্গ দুপুরে।
মাঠের একপাশে ইতি উতি এই কালো ফল পড়ে থাকতে দেখে মনটা বড়ো ভালো হয়ে গেলো। মনে হলো যদি আমিও ওই কবির লেখা কবিতার মতো ডানা মেলে একটি বার উড়ে যেতে পারতাম ওই দুর আকাশে তাহলে কি ভালই যে হতো কে জানে। জানি হয়তো সেটা সম্ভব নয় তবুও ইচ্ছা তো হয় মাঝে মাঝে। এই পৃথিবীর ভীড় ছেড়ে আত্মাদের ভীড়ে গা ঢাকা দিতে। যেখানে তালহীন, লয়হীন মানুষদের কেউ বলে না তুমি অচল এই সমাজে, এই দুর আকাশের মাঝে তুমি বেমানান।
কঙ্কালীতলার সেই রবিবার এর হাট সেরে একদম বিকিকিনি না হয়ে, বউনি না হয়ে একটু মন খারাপ নিয়ে বাড়ী ফিরে আসার পথে রাস্তার পাশে পড়ে থাকা পাকা তালের ম ম গন্ধে সাইকেল থামিয়ে আমি দাঁড়িয়ে গেলাম নিজেই। বেশ যেনো এই প্রায় বৃদ্ধ আর সিনিয়র সিটিজেন এর ঠিক দোরগোড়ায় পৌঁছেও কেমন যেনো একটা চাপা উত্তেজনা অনুভব করলাম এই ভরদুপুরে। দুপুর বেলায় ফাঁকা রাস্তায় কেউ কোথাও নেই আশপাশে। চুপটি করে মাটি থেকে তাল তুলে ব্যাগে ভরছি। উত্তেজনা আর আনন্দে মনটা ভালো হয়ে গেল আমার। শুনেছি নাকি তাল এর গন্ধে সাপ আসে আশেপাশে। মাঠের ধারে সেটা আসতেও পারে হয়তো। কে জানে কোনোদিকে তখন ভ্রুক্ষেপ নেই আমার। আসলে বয়স যে তখন প্রায় দু কুড়ি কমে গেছে আমার।
বহুকাল আগে প্রায় দু বছর আগে লকডাউন এর সময়
বোলপুরের সোনাঝুড়িতে আদিবাসী পাড়ার মাঠে ঘুরতে ঘুরতে সন্ধ্যার সময় দুটো বড়ো বড়ো তাল কুড়িয়ে বেশ মজা পেয়েছিলাম আমি আর আমার মেয়ে বুটা। দু হাতে তাল নিয়ে সেই ছবি হাসি মুখে পোস্ট করেছিলাম আমি। ছবি তুলে দিয়েছিল বুটা। আজ আর দুটো তাল নয়। প্রায় ছটা তাল ব্যাগে ভরলাম চুপচাপ। কেউ বাধা দেবার নেই। কেউ কেড়ে নেবার নেই। জায়গার অভাবে আর নিলাম না। তারপর ধীরে সুস্থে আবার সেই ভারী ব্যাগ নিয়ে সাইকেল চালাতে শুরু করলাম বাড়ীর পথে। খারাপ মনটা বেশ ফুরফুরে মেজাজে ভালো হয়ে গেলো এই দুপুর বেলায়।
তাল গাছের বৈজ্ঞানিক নাম হলো Borassus flabellifer। ইংরেজি নামগুলি হলো doub palm, palmyra palm, tala palm, toddy palm, wine palm অথবা ice apple। এটি হলো এশিয়া ও আফ্রিকার গ্রীষ্মকালীন গাছ। এই গাছের ফলকেও তাল বলা হয়। এরা এরিকাসি পরিবারের বরাসুস গণের একটি সপুষ্পক উদ্ভিদ। এর আদিবাস হলো মধ্য আফ্রিকা। তাল গাছ পাম গোত্রের অন্যতম দীর্ঘ গাছ যা উচ্চতায় ৩০ মিটার বা ১০০ ফুট পর্যন্ত হতে পারে।
তালের পাতা পাখার মত ছড়ানো তাই বোরাসাস গণের পাম গোত্রীয় গাছগুলিকে একত্রে ফ্যান-পাম বলা হয়। তাল ভারতীয় উপমহাদেশীয় অনেক অঞ্চলেরই জনপ্রিয় একটি গাছ। কারণ এর প্রায় সব অঙ্গ থেকেই কিছু না কিছু কাজের জিনিস তৈরী হয়, প্রায় কিছুই ফেলা যায় না এই গাছের। তাল পাতা দিয়ে ঘর ছাওয়া, হাতপাখা, তালপাতার চাটাই, মাদুর, আঁকার পট, লেখার পুঁথি, কুণ্ডলী, পুতুল ইত্যাদি বহুবিধ সামগ্রী তৈরী হয়। তালের কাণ্ড দিয়েও বাড়ি, নৌকা, হাউস বোট ইত্যাদিও তৈরী হয়।
তালের ফল এবং বীজ দুইই বাঙালির খাদ্য। তালের ফলের ঘন নির্যাস থেকে তাল ফুলুরি তৈরী হয়। কাঁচা ও পাকা দুই অবস্থাতেই তালের বীজ খাওয়া হয়। কচি তালের বীজের মধ্যে থাকে জলে ভরা তালশাঁস। আর পাকা তালের বীজ রেখে দিলে বীজ মধ্যস্থ শাঁস তালের আঁটিতে পরিনত হয়। তাল গাছের কাণ্ড থেকেও রস সংগ্রহ হয় এবং তা থেকে গুড়, পাটালি, মিছরি, তাড়ি (একপ্রকার চোলাই মদ) ইত্যাদিও তৈরি হয়।
তালে রয়েছে ভিটামিন এ, বি ও সি, জিংক, পটাশিয়াম, আয়রন ও ক্যালসিয়াম সহ আরো অনেক খনিজ উপাদান। এর সাথে আরো আছে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ও এ্যান্টি ইনফ্লামেটরি উপাদান। তবে তাল কেনার সময় নরম তাল কেনা উচিত। কারণ বেশি পাকা তাল হজম করতে একটু সমস্যা হয়। পাকা তালে থাকা ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস দাঁত ও হাড়ের ক্ষয় প্রতিরোধ করে।
তালে প্রচুর ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস আছে যা দাঁত ও হাড়ের ক্ষয় প্রতিরোধেও সহায়তা করে। এন্টি অক্সিডেন্ট গুণ সমৃদ্ধ হওয়ায় তাল ক্যান্সার প্রতিরোধেও সক্ষম। এছাড়া স্বাস্থ্য রক্ষায় ও স্মৃতিশক্তি বাড়াতেও তাল বেশ উপকারী। তালে আছে ভিটামিন-বি, তাই ভিটামিন-বি এর অভাবজনিত রোগ প্রতিরোধে তাল ভূমিকা রাখে বলে মনে করা হয়।
আর সেই তালের বড়া খেয়েই তো নন্দ নাচতে লেগেছিল আনন্দে, মহানন্দে। একদিকে এত গুণ এর সমাহার এই তাল এর মধ্যে। প্রভু শ্রী কৃষ্ণের প্রিয় খাবার জিনিস তালের বড়া তৈরি হয় এই তাল দিয়েই। আর তাল এর ক্ষীর এর স্বাদ তো অতুলনীয়। সব মিলিয়ে আমি তাল হারানো বেতাল মানুষ হলেও তাল ফল কিন্তু নিজের গুণেই আমাদের জীবনে জড়িয়ে আছে নানা রূপে নানা ভাবে।
তাল কথা - অভিজিৎ বসু।
বারো আগস্ট, দু হাজার চব্বিশ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন