সাদা জীবনের কালো কথায় আমি আপনাদের কাছে সাত সকালেই যে খবর নিয়ে মন খারাপ করেছি সেটা হলো সাংবাদিক শ্রাবণী গুপ্ত নেই। এই খবরে আমাদের মন ভারাক্রান্ত হয়েছে মঙ্গলবার সকাল বেলায়। এই মিডিয়া জগতে কাজ করা একজন সাংবাদিক যিনি অসুস্থ অবস্থায় কত অল্প বয়সে আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন।
কিন্তু এক মন খারাপের ধাক্কা কাটতে না কাটতেই রাতে আবার আর এক খারাপ খবর এলো আমাদের কাছে। চন্দননগরের আলোর অন্যতম কারিগর সেই বিখ্যাত আলোকশিল্পী বাবু পাল আর নেই। তিনিও চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। সত্যিই কি যে হলো কে জানে। একে একে খারাপ খবর আর ধাক্কার পর ধাক্কা। একদম যেনো নুয়ে পড়া কোনো ভাবেই যাকে সামাল দেওয়া যায় না জীবনে।
আসলে জীবনের সব চেনা, পরিচিত সব মানুষেরা একে একে সবাই আমাদের ছেড়ে চলে গেলে কেমন যেনো ফাঁকা ফাঁকা লাগে চারপাশ। মনে হয় আশপাশে কেমন যেন একটা নিঃসঙ্গতা গ্রাস করে আমাদের।বোর চাঁপাতলার সেই বাড়ির ল্যান্ড ফোনে 26835368 নম্বরে ফোন করে আর কোনদিন কথা বলা যাবে না বাবুদার সাথে। পূজো আসার আগেই আমরা সব রিপোর্টার এর দল বাবুদার মোবাইল ফোনে 9830050589 ফোন করে বিরক্ত করতাম বারবার। বলতাম দাদা লাইট রেডি হলে বলবেন কিন্তু। কি পূজো স্পেশাল আলো করলেন আমাদের দেখাবেন কিন্তু দাদা। আর বাবুদা হাসি মুখে সব আমাদের আবদার মেনে, সেই আমাদের রিপোর্টারদের সব দাবি পূরণ করতেন তিনি।
ভাদ্র মাস পার করলেই আশ্বিন মাসের আগমন হতো ক্যালেন্ডারের পাতায়। আকাশে বাতাসে কেমন পূজোর গন্ধ লেগে যেতো। পূজো মানেই যে চন্দননগরের চোখ ধাঁধানো আলোকসজ্জা। আলোর জাদুকর শ্রী ধর দাস এর সুরেরপুকুরের বাড়িতে কারখানায় তখন চরম ব্যস্ততা। ঠিক তেমনি করেই আজ থেকে প্রায় পঁচিশ বছর আগে মাত্র দশ হাজার টাকা নিয়ে বাবু পাল ইলেকট্রিক কোম্পানি চালু করলেন তিনি। যিনি একসময় আলোক শিল্পী অশোক কুন্ডুর সহকারী ছিলেন। তারপর ধীরে ধীরে নিজেই একটা প্রতিষ্ঠান হয়ে গেলেন তিনি তাঁর হাতের কাজের জন্য।
চন্দননগরের আলো মানেই তো আলোর জাদুকর ম্যানড্রেক এর মত শ্রী ধর দাসের নাম উঠে আসে। কিন্তু পরে ধীরে ধীরে কেমন করে যে বাবু পাল ও সেই জাদুকর এর পাশে নিজের কেরামতিতে জায়গা করে নিলেন চুপটি করে কে জানে। হয়তো নিজের কাজের জোরেই সেটা করে নিলেন তিনি। থ্রি ডি লাইট করে হৈ চৈ ফেলে দিলেন তিনি বাজারে। এল ই ডির আলোর ঝলকানিতে চোখ ধাঁধিয়ে গেলো আমাদের সবার।
আলোর সেই পুরোনো টুনি বাল্ব এর দাপট থেকে এক ধাক্কায় এক নতুন আলোর ঝিকিমিকি হাসি ফুটিয়ে তুললেন তিনি। একটা নতুন ঘরানা, একটা নতুন যুগ এর সূচনা হলো সেই বাবু পালের হাত ধরে আলোর শহর চন্দননগরে। শ্রী ধর দাস এর ইলেকট্রিক এর পাশে বাবু পাল এর পাল ইলেকট্রিক কোম্পানিও বাজারে ধীরে ধীরে নাম করতে শুরু করলো। আলোর খোঁজ পড়তে শুধু আর জাদুকর শ্রী ধর দাস নন। খোঁজ পড়তে শুরু করলো ভদ্র, স্মিতভাষী সেই বাবু পালের নামও।
আর আমরা সেই পূজো আসার আগেই ছুটে যেতাম তাঁর সেই বাড়ির পাশের কারখানায়। কত নতুন নতুন আলোর খেলা তৈরি করে যে আমাদের দেখিয়ে টেস্ট করে হাসি মুখে বলতেন অভিজিৎ এই বার এটাই হিট করবে দেখো তুমি। আমি বলতাম বাবুদা সত্যিই আপনার এই ভাবনার আলো বেশ ভালো হয়েছে দাদা। তারপর নিজের অফিসে বসিয়ে মিষ্টি মুখ করিয়ে তারপর আমাদের ছাড়তেন তিনি। এটাই হলেন বাবু পাল। আজ তিনিও নেই। সত্যিই জীবন কেমন নির্দয়।
সেই পূজো আসার আগে নিত্য নতুন লাইট দেখিয়ে তার ছবি তুলে এনে খবর করতাম আমরা সাংবাদিক এর দল। কেমন হাসি মুখে আমাদের সব অন্যায় আবদার মেনে নিয়ে, আর মানিয়ে নিয়ে আমাদের নতুন নতুন আলোর সন্ধান দিতেন তিনি প্রতি বছর। সেই আলোর ছবি তুলে আমরা অফিসে নাম কিনতাম এই বার বাবু পালের সেরা আলো কলেজ স্কোয়ারে দেখা যাবে। তাঁর সেরা আলো এইবার বোড় পঞ্চানন তলায় বা অন্য কোথাও মণ্ডপে দেখা যাবে।
আর চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পূজোর বিসর্জনের দিন তাঁর তৈরি আলোর লরি দেখতে উপচে পড়তো ভীড় চন্দননগরের রাস্তায়। সেই নানা রকমারি আলোর কারিগর বাবু পাল এর মৃত্যুর খবর পেয়ে মনটা একদম খারাপ হয়ে গেলো আজ আবার। শুধু দেশে নয় বিদেশেও তাঁর আলো সমান হারে জনপ্রিয় ছিল। দুবাই এর এক ফেস্টিভ্যালে তাঁর আলো হৈ চৈ ফেলে দিয়ে ছিল একসময়। সেই দুবাই এর আলোর টেস্টিং করে সেদিন তাঁর কারখানায় দাঁড়িয়ে বলেছিলেন এই আলো নাম করবেই দেখো তুমি। সত্যিই সেই দুবাই এর ফেস্টিভ্যাল এর আলো খুব নাম করে সেইবার। খুব খুশি দেখেছিলাম তাঁকে সেই সময়।
আজ গভীর রাতে ফেসবুকের মাধ্যমে জানলাম সেই আলোকসজ্জার কারিগর, আলোর স্পর্শ নিয়ে সারা জীবন দৌড়ে বেড়ানো সেই মানুষটা আর নেই। শুনেই তাই কেমন বিমর্ষ হলাম আমি। একজন ভালো শিল্পী চলে গেলেন আজ। যিনি শুধু চন্দননগরের নামকে উজ্জ্বল করেননি তাঁর সৃষ্টি দিয়ে। তিনি বিদেশের মাটিতে দেশের নামকেও উজ্জ্বল করেছেন বার বার। সত্যিই আজ বোধহয় চারিদিকে বড়ই অন্ধকার।
সেই অন্ধকার রাতের আঁধার ঘুচিয়ে নিত্য নতুন আলো সৃষ্টি করে যে শিল্পের কাজ তিনি করে আমাদের আনন্দ দিতেন। সেই মানুষটা আর নতুন আলোর সন্ধান দেবেন না কোনোদিন আমাদের। সেই আলোর দেশে ফিরে গিয়ে আপনি ভালো থাকবেন বাবুদা । আর কোনোদিন আপনাকে কেউ পূজোর আগে বিরক্ত করবে না। বলবে না ফোন করে দাদা সবার আগে কিন্তু আমাদের চ্যানেলকে আপনার এইবার পূজোর সেরা আলো দেখাতে হবে। ভালো থাকবেন বাবু দা।
চন্দননগরের বাবু পাল নেই - অভিজিৎ বসু।
একুশে আগস্ট, দু হাজার চব্বিশ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন