আসলে এই সাদা জীবনের কালো কথায় আপনারা কি জানেন জীবনের কত ঘটনা, ঘটনার ঘনঘটা যে ছড়িয়ে থাকে এদিক সেদিক টুকরো টুকরো হয়ে। সেগুলোকে ভাবলেই কেমন যেন অবাক লাগে আমার এই রাতের অন্ধকারে। মনে হয় জল পড়ে, পাতা নড়ে এর মত জীবনতো জলবৎ তরলং নয়। সেই কোনো এক দলের গোপন বৈঠকে বিপ্লবী নেতার সেই বিখ্যাত উক্তি কমরেড জল পড়ে, পাতা নড়ে। তাই তো যারা বুঝতে পারলেন তারা বুঝে নিন আপনারা। আর যারা বুঝতে পারলেন না, তারা অন্য কমরেডদের থেকে বুঝে নিন। এরপর তো বাকিটা সবটাই ইতিহাস। সাদা জীবনের কালো কথায় আজ সেই সব নানা ইতিহাসের টুকরো কিছু কথা।
যে যেদিকে খুশি, যেভাবে খুশি সে চলতে পারে তার নিজের মতই, নিজের দাপটে আর ক্ষমতার দম্ভে আর মোহে। সেটাও কিন্তু সবসময় একভাবেই ঘটে না। কিন্তু মাঝে মাঝে কিছু ঘটনা, আর ঘটনার অভিঘাত মনে করিয়ে দেয় না। সব কিছুই নিয়ম মেনে জলের মতো সহজ ভাবেই যে ঘটে না এই পোড়া আমাদের জীবনে। কথায় আছে না গাছের একটি পাতাও যে নড়ে না তাঁর ইচ্ছা ছাড়া। সত্যিই তো তাই এই পৃথিবীর সব কিছুই যে তাঁর ইচ্ছাধীন। যতই ক্ষমতা সম্পন্ন মানুষ হইনা কেনো আমরা। ঘুড়ি আকাশে উড়লেও লাটাই যে থাকে অন্য একজনের হাতেই। কখন যে সেই তিনি অদৃশ্য সেই লাটাই ধরে টান দেন কে জানে। যে টানে আমরা আত্মগর্বে গর্বিত মানুষ কেমন করে চিৎপটাং হয়ে পড়ে যাই। শুকনো মাটিতে আছাড় খাই। যাক গে এসব কথা থাক।
সাদা জীবনের কালো কথায় আজ এক বৃদ্ধ বাঘ এর গল্প। যে বাঘ হয়তো সেই শ্রীনাথ বহুরূপীর মতই। সে সেজে গুজে কেমন হালুম হালুম করা এক বাঘ। জলে আর জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো দাপিয়ে বেড়ানো এক বাঘ। যে বাঘ মামা বাংলার বাঘ হলেও ঝাড়খন্ড এর জঙ্গল পার হয়ে, মালভূমি পার হয়ে, কয়লা খনি অঞ্চল পেরিয়ে অনেক কষ্টে সমতলে এসে আশ্রয় নিয়েছিল অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে। আসলে জাতে সেতো বাঘ তাই না। বিড়াল, বনবিড়াল তো নয়।
এদিক ওদিক অনেক ঘুরে বেড়িয়ে শিকার ধরার মতো হাজার কাঠখড় পুড়িয়ে এক সিংহকে বাবু ধরে ছিল সে বহু কসরত করেই। আর কি বাঘ আর সিংহের যুগল মিলনে তখন আপাত সুখের সংসারে তখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা অন্যদের। কে কি করে বাঁচবেন সেটাই আসল কথা। কিন্তু উপায় কি বাঘের গর্জন, তার নখের আঁচড়ানো, হালুম হালুম ডাক শুনে অন্যদের তখন কাহিল অবস্হা। প্রাণ যায় যায় আর কি। আর চালাক বাঘ মামা তো জানেই কে আর কি করবে তাকে। তার মাথায় যে সিংহের আশীর্বাদ আছে। সেই সিংহের গুহায় যে তার অনায়াস যাতায়াত আছে। বেশ সুখের দিন, সুখের সময় দিন যাপন চলছিল বাঘ আর সিংহের দুজনের।
কিন্তু ওই যে ঘুড়ি ওড়ে কিন্তু লাটাই থাকে অন্য কারুর হাতে। জল পড়ে, পাতা নড়ে কিন্তু মাঝে যে নানা ঘটনা ঘটে যায়। সাদা ধবধবে রাজপ্রাসাদ থেকে সিংহাসন থেকে সিংহ বেরিয়ে পড়ে। গুহা থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নেমে পড়তে বাধ্য হয় সে একদিন। সিংহের রাজত্ব চলে যায় কোনো এক অজ্ঞাত কারণে। আর বাঘ মামাও কেমন বেকায়দায় পড়ে যায় সেই সময়। কি করবে বুঝতে পারে না সে নিজেই। অনেক চেষ্টা করেও সেই সাদা রাজপ্রাসাদে ঠাঁই হয়না তার কিছুতেই।
আসলে এই বাঘ সেজে ঘুরে বেড়ানো বহুরূপীকে সাক্ষাৎ করার সুযোগ হয় আমার অল্প কিছুদিন। মহাকরণে ডিউটি করার সুযোগ পেয়ে। সত্যিই বাবা কি যে দাপট তার। যে দাপটে তখন মহাকরণের অলিন্দে ঘুরে বেড়ানো জুনিয়র সাংবাদিকদের প্রাণ যায় যায় অবস্থা আর কি। কিন্তু উপায় কি বাঘ মামা বলে কথা যে।মান্যিগণ্যি করতে হয় যে তাকে। দুর থেকে মহাকরণের বারান্দার এক কোনায় বসে থাকা বৃদ্ধ বাঘকে দেখে ভাবতাম সত্যিই তো কি অসীম ক্ষমতার অধিকারী ইনি।
কি দাপটে লেজের ঝাপটা মারেন তিনি এদিক ওদিক এই বৃদ্ধ বয়সেও। তাহলে যৌবনে কি দাপট ছিল ভেবে কিছুটা আতঙ্কিত হই আমি। কিন্তু সেই মহাকরণের সুন্দর রাজ্যপাট চলে গেলো আচমকাই তার একদিন।সেই ঘুড়ি আর লাটাই এর জন্য। কখন কি যে হয়। তারপর ধীরে ধীরে বাঘ মামা ঘুরে বেড়াতে লাগলো নিজেই একা একা। শিকার এর সন্ধানে সে বাজারে ঘুরতে ঘুরতে পেয়েও গেলো শিকার এর খোঁজ অনেক কষ্টে। সাদা বাড়ির রাজপ্রাসাদ ছেড়ে একটু কষ্টের কোঠা বাড়ীতে ঠাঁই হলো বৃদ্ধ সিংহের।
আর কি নতুন জায়গা, নতুন জঙ্গলে আবার গর্জন সেই টারজান সিনেমায় সেই গর্জন এর মত। আর আমার নিজের কপালের ফেরে হাজির হলাম আমিও সেই বৃদ্ধ বাঘের বাস করা জঙ্গলে। আর দুর থেকে নয় একদম কাছ থেকে দেখলাম বাঘকে। তার ঝুলে পরা চামড়া, শ্লথ গতি, দুলে দুলে হাঁটা, ডোরা কাটা দাগে ধূসর ধুলোর মোটা আস্তরণ। চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে ক্ষীণ, আগের মত সেই ক্ষিপ্রতা নেই তাঁর, তবু পরিচয় একটাই বৃদ্ধ হলেও বাঘ তো সে।
যে বাঘ ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজের ইচ্ছায় এর ওর ঘাড়ে যখন তখন। ঘাড় মটকে দেয় অনায়াসে। নিরীহ ডানা ঝাপটানো পাখিদের মেরে আনন্দ উল্লাসে মত্ত হয় সে। তারপর একা একা জঙ্গল ছেড়ে কেমন কংক্রিটের শহরে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায় আনমনে, আপনমনে কিছুটা নিজের আত্মগর্বে। আসলে সে যে জঙ্গলের রাজা। অপরকে শিক্ষা দিয়ে, ভুল ধরে, তাকে তার জঙ্গল থেকে তাড়িয়ে দিয়ে, অন্যের পেটে লাথি মেরে যে তার অনাবিল আনন্দ হয়। সে যে আত্মতৃপ্তি লাভ করে। সুখের আবেশে সে চোখ বুজে ধ্রুমপান করে। আর মোটা গোঁফের ফাঁকে মিটিমিটি হাসে। মনে মনে বলে দেখ কেমন লাগে। কাঁচের ঘরে যে আমার অনায়াস অবাধ যাতায়াত।
কিন্তু আমি শুনলাম সেই জঙ্গলের রাজা বৃদ্ধ বাঘ যে বাঘকে একদিন তার নিজের রাজ্য ছেড়ে চলে যেতে হলো আচমকাই। যে বাঘ একদিন মনে মনে খুশি হয়ে বলেছিল অন্যদের হাসি মুখে এই তো আর কটা দিন।ছোটো ছোট পায়ে, গুটি গুটি পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে বাকি জীবনটা উপভোগ করতে চাই আমি। যেটা সে মনে মনে চেয়েছিল সেটা সে করতে পারল না। কেমন যেনো সব হিসেব ওলট পালট হয়ে গেলো সব কিছুই। উল্টে গেলো তার নিজের হিসেব নিকেষ।
ওই বৃদ্ধ বাঘকে তাড়া করে নিজের রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হলো কেমন সহজেই। কোনো হালুম ছাড়া মাথা নিচু করে চুপটি করে সেই বাঘ মামা নিজের রঙিন পোশাক খুলে ঘরে ফিরে গেলো চুপ করে দূরে অনেক দূরে নিজের ঘরে। কোনো প্রতিবাদ না করেই। খবরটা শুনে আজ আমার মনটা খারাপ হলো বড়ো। সত্যিই তো বাংলার এই বিখ্যাত টাইগার এর এমন অবস্হা হলো। কিন্তু মনে হলো এটাই বোধহয় কর্মফল।
যে বৃদ্ধ বাঘ একদিন চিতা, চিতা বাঘ এর জন্য গলা তুলে হুংকার ছেড়েছিল। সেই বাঘ কেমন চুপ করে নিজের সাম্রাজ্য ছেড়ে দিয়ে চলে গেলো মাথা নিচু করে ভাবলেও অবাক লাগে আমার আজ। তাহলে এরা কিসের মহারাজ। কিসের মস্তবড় মাতব্বর দু পেয়ে জীব। মনে পড়ল আমার সেই শরৎ চন্দ্রের শ্রী নাথ বহুরূপীর কথা মনে পড়ে গেলো। সেই শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা বিখ্যাত লাইন, মেজদার চৈতন্য হইলে তিনি নিমীলিতচক্ষে দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া সংক্ষেপে কহিলেন, দি রয়েল বেঙ্গল টাইগার।
সত্যিই তো সেই বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগারের এই হাল শুনে আমার এই আপাত কঠিন মনটা খারাপ হলো বেশ আজ। আরও মন খারাপ হলো সেই বিখ্যাত গল্পের পিসেমশাই এর হুকুম শুনে,উহার ল্যাজ কাটিয়া দাও। তখন, তাহার সেই রঙিন কাপড় জড়ানো সুদীর্ঘ খড়ের ল্যাজ কাটিয়া লইয়া তাকে তাড়াইয়া দেওয়া হইল। আমি জানিনা খড়ের ল্যাজ সেই বিখ্যাত বৃদ্ধ বাঘের ছিল কি না। যে বাঘ ঝাঁপিয়ে পড়ে অন্যকে একদিন ক্ষতবিক্ষত করেছে। অন্যকে মেরে ফেলেছে নখের আঁচড়ে। দেবতাদের জয় করে সে ভেবেছিল সে অজেয় অপরাজেয়। আর আনন্দে মত্ত হয়ে ঘুরে বেরিয়েছে সে এদিক ওদিক। আজ সে কেমন একা। একদম একা।
এক বৃদ্ধ বাঘের গল্প - অভিজিৎ বসু।
বাইশে আগস্ট, দু হাজার চব্বিশ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন