সাদা জীবনের কালো কথায় আজ তিন জন বন্ধুর কথা। বন্ধু কি বলা যায় তাদের। নাকি অন্য কিছু বলতে হয়। অন্য কোনো নাম দেওয়া যায় কি এই আপাত নিরীহ মেঠো সম্পর্কের। যে সম্পর্কের মেঠো পথে এখনো পিচের প্রলেপ পড়েনি। এবড়ো খেবড়ো ভাঙা রাস্তায় এখনো ভালো করে হাঁটা যায় না, হোঁচট খেতে হয়। কিন্তু সেই রাস্তায় যে এমন সব মানুষের সন্ধান পাওয়া যাবে সেটা ভেবে বড়ো ভালো লাগে আজ আমার। যারা সব শক্ত পাকাপোক্ত রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়ে একসাথে হেঁটে চলেও কেমন যেনো অচেনা হয়ে গেছে বহুদিন আগেই। আসলে এই যে নানা ধরনের সম্পর্ক, সম্পর্কের বন্ধন, তার গভীরতা, যা আমাদের সারা জীবন নানাভাবে জড়িয়ে থাকে। সেই সম্পর্কের ওম নিতে বড়ো ভালো লাগে এই বুড়ো বয়সে।
আসলে শনিবার হলো হাটবার। মা কঙ্কালীতলার হাটে যাওয়া। খোলা আকাশের নিচে মুক্ত চিন্তা নিয়ে, মুক্ত মনে বসে থাকা। বিকিকিনি না হলেও কেমন সব জড়িয়ে ধরে থাকা একে অপরকে। কিন্তু সকাল থেকেই আকাশ এর মুখ যে ভার। ব্যাজার মুখের আকাশ দেখে আজ আর সেই মুক্তির স্বাদ পেতে যেতে পারলাম না আমি হাটে সাইকেলে নিয়ে। আসলে সত্যি কথা বলতে কি সেই বক্সিগঞ্জের পদ্মা পাড়ের শুক্রবারের হাট না হলেও এই শনিবারের হাট আমার বেশ ভালই লাগে। সব চেনা মুখের সারি। একে অপরের সাথে হাসি মুখে কুশল বিনিময় করা। বউনি হলো কি না নির্দ্ধিধায় জিজ্ঞাসা করা একে অপরকে। কোনো লজ্জা শরম না করেই। আবার ঘরের খবর নেওয়া, সুখ দুঃখের গল্প করা। বেশ ভালই লাগে আমার কিন্তু। জীবনের এক নতুন অভিজ্ঞতা আর কি।
সে আর কি করা যাবে। কিন্তু হাটে না যেতে পারলেও সকাল বেলায় দেখলাম সিপ্পুর ফোন এলো। আপনি হাটে গেছেন আজ। ওরা জানে আমি ঠিক সাইকেল নিয়ে পৌঁছে যাই মন্দিরে এগারোটা বাজলেই। বললাম না গো আজ যেতে পারিনি। সিপ্পু উত্তর দিলো তারও যাওয়া হয় নি আজ হাটে। কারণ ওর দাদা ভোর বেলায় ডিউটি করতে মোটর সাইকেল নিয়ে চলে গেছে সেও যেতে পারে নি আজ তাই। ভাবলাম যাক তাহলে একজন যেতে পারে নি কিন্তু খবর তো নিলো আমার। মেঘলা দিনেও মনটা ভালো লাগলো বেশ।
একটু পরেই এলো মংলার ফোন। কিগো আজ এলেনি তুমি। আমি বললাম না, যেতে পারলাম না আজ হাটে। ওদিক থেকে উত্তর এলো, খুব বৃষ্টি হচ্ছে এখানে। সকাল থেকে বসা যায়নি একদম হাটে জিনিস নিয়ে। বেচাকেনার কথা তো বাদ দাও। আমি বললাম সেকি রে। মংলা বললো এই তো বৃষ্টি থামলেই বাড়ী চলে যাব আমিও। ভালই করেছ না এসে। কিছুই লাভ হতো না আজ।
আমি ওর এই কথা শুনে একটু থমকে গেলাম। সম্পর্কের এই মেরজাপের বন্ধনে কি তাহলে এই লাভ আর ক্ষতির ক্ষত্রিয় চরিত্র লুকিয়ে থাকে সংগোপনে গা ঢাকা দিয়ে। ঠিক যেমন করে বাঁশের সবুজ পাতায় রং মিলিয়ে লুকিয়ে থাকে ওই চোখ পিটপিট করা গিরগিটি কেমন চুপটি করে। কেমন হিসেব করে চলতে হয় জানে সে বেশ ভালো করে। তারপর হিসেব মিলিয়ে, রং মিলিয়ে কেমন বেঁচে থাকে ওরা সুন্দর করে।
মংলা ফোন রেখে দিল। বৃষ্টি থামলে সে ঘরে ফিরে যাবে বলে। বাড়ী ফিরে ভাত খাবে। তারপর তো তার সবুজ মাঠের টান। খেলতে নামবে সে। আমিও ভাবলাম বাহ সুন্দর খবর তো নিলো আমার। বলতে বলতে পল্টুর ফোন এলো। শ্রীরামপুরের পল্টু বাজারে বসে আছে কিন্তু বৃষ্টিতে ওর বেচাকেনা নেই একদম। সে জানালো বাজারে জিনিসের দাম আগুন। কে আর কিনবে বাজার যত কম কেনা যায়। পল্টু বললো তুমি অনেকদিন শ্রীরামপুরে আসোনি। তাই খবর নিলাম তোমার। কিছু কাজ করছো তুমি। নাকি ঘরে বসে আছো। আমি বললাম না না আমি বেকার। ঘরেই আছি। পল্টু একটু চিন্তা নিয়ে ফোন ছেড়ে দিল।
আমি কেমন যেন একটা বুকের মাঝে জড়িয়ে থাকা গভীর গোপন ভালোবাসার চিনচিনে অনুরণন অনুভব করলাম। বাড়ীতে বলতে শুনলাম আজকাল এরাই তোমার খবর নেয় আর কেউ তো নেয়না খবর। কি অবস্থা হয়েছে ভাবো তুমি তোমার তাহলে। কিন্তু তাতে কি আর অবস্থা হলো। জীবন তো এমন বহমান। গঙ্গায় ভেসে যাওয়া কচুরিপানার মত।
তবু তো এই সিপ্পু, মংলা, পল্টুরা তো একটা ফোন করে খবর নিলো। কেনো আমি আজ হাটে যায় নি বলে। শ্রীরামপুরে যাইনি বলে। এরা হয়ত তথাকথিত পাকা রাস্তার, পাকা বাড়ির ধোপদুরস্ত আধুনিক ঘরের বাসিন্দা নয়। যাদের খুব কাছ থেকে দেখলে মনে হবে এরা তো আর আমাদের শ্রেনীর সেই বাবু শ্রেনীর মানুষ নয়। যারা মেপে পা ফেলে, মেপে কথা বলে, মেপে হেসে কথা বলে, বুঝে লোকের খবর নেয়।
এরা সব আগলছাড়া মানুষজন। যারা অল্প কদিনের আলাপে কেমন এলোমেলো এলেবেলে হয়ে জীবনের নদীতে ঠিক কচুরিপানার মতই ভেসে যায়। এদিক থেকে ওদিক। কোনো হিসেব না করেই। সত্যিই অসাধারন এই অনুভূতি। এই সম্পর্কের অভিজ্ঞতা আর বন্ধন। যা মনের গভীরে বহুদিন ধরে বেঁচে থাকবে। মনে পড়ে গেলো সেই যে আমার বহু পুরোনো এক পরিচিত বন্ধু নয় নিশ্চয়ই সে। সেই যে একটা করে মোবাইল বার্তায় অনেককে লিখে চুপটি করে বসে থাকতো। কি খবর বলে। কতটা খারাপ আছে না তার থেকে ভালো আছে জানার চেষ্টা করত চুপিসাড়ে কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে।
যেমন করে ছিপ ফেলে ফাতনার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা আর কি। তারপর অবসর নেওয়া হলেও যে দিব্যি সুখেই অফিস এর ব্যাগ নিয়ে ভীড় ট্রেনে আবার সকাল হলেই উঠে পড়ছে চুপি চুপি কাউকে কিছু না জানিয়ে। সেই যে বুধবার হায়দরাবাদ এ ওর সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বেড়াতে গিয়ে সেই ভাগ্যলতায় জটাশঙ্কর লাহিড়ীর বাড়িতে একসাথে দুপুরে ভাত খেয়েছিলাম দুজনে। সত্যিই কত যে বিচিত্র বন্ধুর দল এই ভাবে আমাদের আশপাশে ঘুরে বেড়ায় কে জানে। যাদের দেখে চেনা যায় না কোনো ভাবেই।এসবের মাঝেই যে এলো এই তিনজনের ফোন। যা আপাত দুঃখের জীবনে কিছুটা সুখের অনুভূতি দিলো আমায়।
যে সম্পর্কে কোনো লেনাদেনা নেই, হিসেব নিকেশ নেই, চাওয়া পাওয়ার আশায় বেঁচে থাকা নেই। শুধু একজনকে অনেকদিন না দেখে তার খবর নেওয়া আছে। সে এই ধূলিধুসর পৃথিবীতে বেঁচে আছে, না সব মায়াবী সম্পর্কের বন্ধন ছেড়ে চলে গেছে অন্যলোকে, অন্য কোনো খানে। নতুন করে সম্পর্কের বন্ধন তৈরি করতে।সেটা জানতে খবর নেওয়া।
মনে মনে আমি এই বৃষ্টিভেজা দুপুরে একা একদম হয়েও সিপ্পু, মংলা আর পল্টুকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানালাম মনে মনে। ভাবলাম ভাগ্যিস এদের সাথে আমার দেখা হয়েছিল। এই মেঠো একটা সম্পর্কে জড়িত হয়েছিলাম আমি মাতব্বর, তালেবড়, সাংবাদিক হয়েও। তাই তো বোধহয় জীবনের এই শেষ প্রান্তে এসে অনুভব করলাম সম্পর্কের এক নতুন সংজ্ঞা। যেখানে আমার জীবনের হাজার মানুষের ভীড়ে জ্বল জ্বল করছে এই সিপ্পু, মংলা আর পল্টুর হাসি মাখা মুখ।
সম্পর্ক - অভিজিৎ বসু।
চব্বিশ আগস্ট, দু হাজার চব্বিশ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন