সাদা জীবনের কালো কথায় আজ শুধুই এক দাদার কথা। আসলে মিডিয়া জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে গেলে নিজের এলেম, নিজের কর্মদক্ষতা আর ক্যারিশমা ছাড়াও চাই দাদার আশীর্বাদ, ভালোবাসা,আর দাদার বরাভয়,আর চাই মাথার ওপর দাদার শক্ত হাত। সেটা থাকা খুব জরুরী। না হলে সিঁড়ি টপকে সবাইকে এড়িয়ে ওপরে ওঠা খুব মুসকিল এই মিডিয়া জগতে। সে আপনি যত ভালো কর্মী হোন না কেন।
আমার এই পঁয়ত্রিশ বছরের মিডিয়া জীবনে আমার খুব বেশি দাদার দাক্ষিণ্য আর আনুকূল্য আমার বরাতে জোটেনি বললেই চলে আর কি। কারণ একটাই আমার কপাল খারাপ আর আমায় দেখতে খারাপ দুটোই এর কারণ বলে মনে হয় আমার। সাথে অন্য একটা কারণ হলো ক্ষমতার মসনদে বসা দাদাদের বিরুদ্ধ মত প্রতিষ্ঠা করে নিজের পায়ে কুড়ুল মারা। যা আমি বরাবর করে এসেছি নিজের স্বভাববশত বারবার। তার ফল ভোগ করেও সেই কাজ করতে ভয় পাইনি আমি কোনোদিনও।
এত কিছুর পরেও কিন্তু যাই হোক তবুও যাঁর কথা না বললেই নয়। সেই বিখ্যাত সাংবাদিক অনির্বাণ চৌধুরীর সঙ্গে কবে আমার আলাপ হলো, কি করে পরিচয় হলো দুজনের আমার আজ আর সেটা ঠিক মনে নেই এতদিন, এত বছর পরে। শুধু এটা মনে আছে যে ইটিভির চাকরির সুবাদে আমি জেলায় কাজ করলেও কলকাতার এই দাপুটে হ্যান্ডসাম বসের সাথে যোগাযোগ ছিল আমার। আর সেই যোগাযোগ রয়ে গেলো এতদিন ধরেই। বিছিন্ন হলো না কোনোভাবেই। হাজার ঝড় ঝাপটা সামলে সেই যোগাযোগ, ক্লিশে হয়ে যাওয়া সম্পর্ক, সবটাই কেমন আজও বৃষ্টি ভেজা দুপুরে ভেজা রাস্তার মতই অমলিন হয়ে আছে আজও আমাদের দুজনের মেঠো সম্পর্ক। কিছুটা অভিমান আর কিছুটা চাপা ভালোবাসা নিয়ে আজও টিকে আছে সেই পুরোনো সম্পর্ক একদম ঠিক কাঁচের বয়ামে রাখা পুরোনো আচারের মতই।
আসলে কি জানেন তো একবার সম্পর্কের নিগূঢ় বাঁধন যদি আটকে যায় জমে থাকা পলির চড়ায় সেটা হঠাৎ করে ভেঙে যাওয়া বড়োই কঠিন। সে আপনার দেওয়া নেওয়া, পাওয়া আর না পাওয়া যাই থাক। কিছু কিছু সম্পর্ক তো জীবনে এমনভাবেই আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকে। যাকে ইচ্ছা করলেও, রাগ করলেও, অভিমান করলেও, দূরে সরে গেলেও ছাড়িয়ে ফেলা যায় না কোনো ভাবেই। এটাই বোধ হয় সেই গোটা পিঁয়াজের খোসার মধ্য পরতে পরতে জড়িয়ে থাকা খোসার মত আটকে থাকা যেনো একে অপরের সাথে গায়ে গা ঘেঁষে।
ইটিভির চাকরি ছেড়ে অনির্বাণদা চলে গেলেন হিন্দুস্থান টাইমস। একদিন আমি আর জটাশঙ্কর লাহিড়ী দেখা করতে গেলাম সেই ইংরাজি কাগজের অফিসে। সেই এক রকম হাসিখুশি মুখে বুঝিয়ে দিলেন উচ্চপদে কর্মরত হলেও চারপাশে বর্মের ঘেরাটোপে বন্দী না করলেও আরামেই চলে যায় জীবন। সে তুমি যত ওপরেই উঠে যাও।আর যত বড় রাজনীতির লোকদের একদম কাছে চলে যাও। আর সেটাই বোধ হয় অনির্বাণদার একমাত্র টিআরপি। যার জন্য হয়তো কিছু ক্ষতিও হয়েছে ওনার। কিন্তু তবু সেই একভাবে অধরা না থেকে কাঁচের ঘরে বসেও নিজেকে ঘেরা টোপে বন্দী করেননি তিনি কোনোদিন। যার জন্য সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে, সবার কাছের মানুষ হয়ে বিন্দাস হাসিমুখে কাটিয়ে দিলেন নিজের জীবন একদম স্ট্রেইট ব্যাটে ব্যাট করে ছক্কা মেরে হাসি মুখে।
যাক গে ধান ভানতে গিয়ে শিবের গীত বেশি না গাওয়াই ভালো। যে জন্যে এই রাত দুপুরে কলম ধরা আমার। সেই অনির্বাণদা ইংরাজি কাগজ ছেড়ে চলে এলেন আবার টিভি মিডিয়াতে। জী চব্বিশ ঘণ্টার এডিটর হয়ে। সেই পোদ্দার কোর্টে অফিস। আমি সবে হায়দরাবাদের কাজ ছেড়ে প্রতিদিন কাগজে জেলা সাংবাদিক হিসেবে খুব কম টাকার কাজ করি। একদিন দুপুর বেলায় নিজের লেখা নিয়ে প্রতিদিন অফিসে ধর্মতলায় লেখা জমা দেবো বলে এসেছি। হঠাৎ অনির্বাণদার ফোন আমার মোবাইল ফোনে। তুই কোথায় রে।আমি বললাম এই তো তোমার অফিসের কাছেই। বললো চলে আয় আমার অফিসে। বলেই ফোন কেটে দিল।
দুরু দুরু বুকে সেই যে অফিসে পরীক্ষা দিয়েও পাশ করতে পারিনি দু বার সেখানে সেই নরম সোফায় বসলাম। বললাম এডিটর অনির্বাণ চৌধুরী সঙ্গে দেখা করবো। রিসেপশনে ফোন করে ডেকে নিলেন আমায় একটু পরে অনির্বাণদা নিজেই। সেই কাঁচের ঘরে যেখানে আমি ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম কিন্তু পাশ করতে পারিনি। সেই পুরোনো টিফিন বক্স খোলা রুটি খেতে খেতে কথা হলো। বললেন একটা সিভি দে। বলে এইচ আর অয়নকে ডেকে নিলেন ইন্টারকমে। সিভি দিয়ে বললেন যদিও ও বলে ত্রিশ বছরের এক্সপেরিয়েন্স কিন্তু ওটাতে জল আছে একটু। অয়ন হেসে সিভি নিয়ে ওর ঘরে চলে গেলো।
রুটি খেতে বললেন আমায় অনির্বাণ দা নিজের টিফিন বক্স এগিয়ে দিলেন। আমিও খিদে পেটে খেলাম রুটি বক্স থেকে নিয়ে কোনো দ্বিধা না করেই। হম, যে অফিসে বার বার ফেল করেছি আমি লিখিত পরীক্ষা দিয়েও, ইন্টারভিউ দিয়েও পাশ করিনি আমি। কোনভাবেই আমায় দেখে পছন্দ হয়নি আগের সেই অফিসের দাদাদের। যার মধ্য দুই দাদাই আমার পরিচিত ছিলেন। একজন পরিচিত ছিলেন আকাশবাণী কলকাতাতে কাজের সূত্রে। আর অন্যজন যদিও তিনি আজ আর বেঁচে নেই তিনিও আমার পরিচিত ইটিভির চাকরি করার সূত্রেই।
সেই চব্বিশ ঘণ্টার অফিসেই কেমন করে যেনো আমার চাকরি হয়ে গেলো এই অনির্বাণদার জন্যই। যা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি কোনোদিন। প্রতিদিন এর হুগলী জেলার চাকরি ছেড়ে এক লহমায় চলে এলাম কলকাতার পোদ্দার কোর্টের সেই অফিসে। না, কোনো রিপোর্টার এর চাকরি নয় সেটা হলো অ্যাসাইনমেন্টের কাজ। রিপোর্টারদের খোঁজ খবর নিয়ে তাদের খবরের দেখভাল করা আর তাদের গতিবিধির হালহকিকত জানার কাজ। রিপোর্টারদের কাছে সঠিক সময়ে গাড়ি ক্যামেরা পৌঁছে দেবার কাজ। একটু এদিক ওদিক হলেই চারিদিক থেকে গাল শোনা।
এক কথায় হলো স্টোর রুমে বসে বা বাথরুমে বসে অফিস এর সব ঝক্কি সামলানো আর কি। যা সময় ধরে, ঘড়ি ধরে জানাতে হবে অফিস এর তালেবর বাবু শ্রেনীর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে। যাদের এডিটর এর ঘরে প্রবেশে অবারিত দ্বার, যাঁরা যখন তখন এডিটর এর ঘরে প্রবেশ করতে পারেন দরজা ঠেলে পান চিবুতে চিবুতে হেলেদুলে। আর সব কিছু জেনে কাকে শুলে চাপাবেন সেটা ঠিক করবেন তারাই মাতব্বররা। কাকে গাল দেবেন সেটাও তাদের বিচার বিবেচনা করেই ঠিক হবে। পেটের জ্বালায় আর কিছুটা ওই বোকা বাক্সের মোহে সেই কাজেই লেগে পড়লাম আমি মন দিয়ে। আমার অনির্বাণদার ঘরে প্রবেশের অবারিত দ্বার থাকলেও এডিটর এর রুমে খুব দরকার না পড়লে সেখানে যেতাম না আমি। পারতপক্ষে একটু দূরেই থাকতাম আমি সেই সময়।
না, তাতে দাদার ভালোবাসার কোনো খাঁকতি পড়েনি কোনোদিন আমার ওপর। কোনো ছোটো কর্মী হলেও তাকে নিয়ে সবার সামনে তাকে ছোটো করে দিয়ে হেনস্থা করা সেটাও তিনি করেননি কোনোদিন কাউকে। যেটা এই মিডিয়া জব করতে এসে আকছাড় দেখা যায়। যেটা তাঁর সবথেকে বড় প্লাস পয়েন্ট এডিটর হয়েও অফিসের সুইপারকে, অফিসার ড্রাইভারকে জুনিয়র রিপোর্টারকে বুঝতে না দেওয়া যে তিনি এডিটর অফিসের সর্বময় কর্তা। ক্ষমতার মসনদে বসেও আস্ফালন না করা এটা বোধ হয় একটা বড় গুণ ওনার। যার জন্যে এত দুর এগিয়ে গেছেন তিনি হাসি মুখেই।
এইভাবেই তো বেশ ভালই জীবন চলছিল। কখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলে কে এডিটর এর ডাক পাবে চা খেতে যাবার সময়ে। মোটার দোকান বা প্রদীপের দোকানে বা কালামের দোকানে সেই নিয়েও একটা মজার প্রতিযোগিতা চলতো সবার মধ্যে। যদিও এদের মধ্যে কেউ কেউ ফিক্সড ডিপোজিট এর মত স্থায়ী অছি পরিষদের সদস্য থাকতেন সেই চা খাবার টিমে। আসলে ক্ষমতার বৃত্তে থাকতে কে না ভালোবাসে বলুন। তবু অনির্বাণদার সাথে চলতে গিয়ে মনে হয়নি একজন এডিটর হয়েও তিনি আমায় শুধু কাজের সুযোগ নয় একটা নিশ্চিত জীবনের সুযোগ দিয়েছিলেন। যে জীবনটা সত্যিই বড়ো ভালো কেটেছিল আমার ওই ছটা বছর। স্বর্ণযুগ বলতে দ্বিধা হবে না আমার।
কিন্তু জীবনের হিসেব নিকেষ কখন যে উল্টে যায় কে জানে। অনির্বাণদা হঠাৎ ছেড়ে দিলেন চব্বিশ ঘণ্টা চ্যানেল। আমরাও সব দাদাহীন হয়ে পড়লাম। অনাথ হয়ে গেলাম কিছুটা। মাথার ওপর ছাতা নেই। দাদার লোক হয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকলাম আমরা সব এদিক ওদিক। রোদে,জলে, ঝড়ে কাজ করেও কেমন সব দাদার লোকরা কাজের নয় বলে প্রতিপন্ন হলাম প্রতি মুহূর্তে অফিসে। নতুন ক্ষমতার সন্ধান পাওয়া লোকের আস্ফালনে আর আক্রমণে আমরা দিশেহারা হয়ে কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে এলাম কিছুটা একপ্রকার বাধ্য হয়েই। শুধু আমি একা নই, অনেকেই। একটা নিশ্চিত জীবনের মোরাম রাস্তা ছেড়ে গ্রামের এবড়োখেবড়ো টোটো চলা রাস্তায় হাঁটতে শুরু করলাম আমি ধীরে ধীরে।
আজ এতদিন পর সেই পাঁচ বছর ধরে এবড়ো খেবড়ো রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বড়ই ক্লান্ত আমি। আজ এই গভীর রাতে ঘুম আসেনা চোখে আমার একদম। শুধু মনে হয় জীবনের সেই কাজের দিনগুলো, দৌড়ের দিনগুলো যদি আবার একবার ফিরে আসতো কি ভালো যে হতো তাহলে। সেই পুজোয় নতুন জুতো পরে এডিটর এর ঘরে ঢুকে দেখানো দাদা দেখো কেমন লাগছে আমায় হেসে বলতেন বাহ দারুন রে। কোন ইন্টার্নকে নিয়ে ঘুরতে যাবি আজ। মেয়ের পাশ করার খবর শুনে দৌড়ে গিয়ে বলা দাদা, মেয়ে পাশ করেছে। মেয়ের হাতের কাজ এর ছবি দেখানোর জন্যে যখন তখন কাঁচের ঘর এর দরজা ঠেলে ঢুকে যাওয়া একটুও ভয় না পেয়ে এডিটরকে। আর যে কোনো এডিটর রুটি খাবার জন্য বক্স এগিয়ে দিয়ে বলে খা তুই। এটা খুব মিস করি আমি আজ।
সত্যিই তো এমন একজন দাদাকে পাশে পেলে হয়তো বাকি জীবনটাও কেমন নিশ্চিন্তে কাটিয়ে দিতে পারতাম আমিও অন্যদের মতই। ভাবতে হতো না কি করে জীবনের এই এবড়ো খেবড়ো রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে হবে একা একা। সত্যিই বড়ো মিস করি আজ তোমায় আমি অনির্বাণদা। জীবনের এই ব্যালেন্সের খেলায় আমি আর তুমি হয়তো ছিটকে গেছি দুজন দুদিকে, দুপ্রান্তে। কিন্তু তবুও তোমাকে আমি মিস করি অনির্বাণদা আজও এতদিন পরেও।
এই এতদিন পর বেকার জীবন পালন করেও তোমায় মিস করি আমি আজও। তোমার দেওয়া চাকরী একসময় আমার অস্থির জীবনের একটা স্থিতি এনে দিয়েছিল। তাই আজ এটাই বলতে পারি যে মিডিয়াতে হয়তো তথাকথিত কোনো দাদা নেই আমার। তবু তুমি আমায় যে সুযোগ দিয়েছিলে তার ঋণ আমি কোনো দিনও শোধ করতে পারবো না।
এই সব চিৎকার করা মিডিয়াতে নানা ক্ষমতার আস্ফালন করা মাতব্বর মানুষদের ভীড়ে তুমি এমনি হাসি খুশি হয়েই থাকো সারা জীবন। যাতে সবাই তোমার নাগাল পায়। তোমায় ফোন করে তোমায় ধরতে পারে। তার নিজের দুঃখের কথা বলতে পারে তোমায়। তুমিও তাদের আস্থা দিয়ে, ভরসা দিয়ে বলতে পারো চিন্তা করিস না তুই। সব ঠিক হয়ে যাবে। দাদা, ভালো থেকো তুমি।
অনির্বাণদা ভালো থেকো তুমি - অভিজিৎ বসু।
বিশে আগস্ট, দু হাজার চব্বিশ।
খুব ভালো লেখা। ওনার বাবা বিশিষ্ট সাংবাদিক অমিতাভ চৌধুরী আমাকে খুব স্নেহ করতেন। উনি তখন যুগান্তর পত্রিকার নিউজ এডিটর ছিলেন। আমাকে " ডাক্তার" বলে ডাকতেন। আমার দেওয়া আর জি কর হসপিটালের একটা খবর যুগান্তর পত্রিকায় প্রথম পাতায় লিড স্টৌরি করেছিলেন ।
উত্তরমুছুন