'প্রত্যেকটি মানুষই দ্বীপের মতো। চারিদিকে বিচ্ছিন্নতা, অতলান্ত জল। মানুষের ভীড়।এই সমাজ, জঙ্গলেরই মতো। দূর থেকে মনে হয়, জড়াজড়ি করে একে অন্যের পর নির্ভর করে এক জোট বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে দারুণ ভালোবাসায় একতাবদ্ধ মানুষেরা সব।আসলে ,সবাই-ই আলাদা আলাদা।সব গাছ;সব মানুষ। বাঁচার জন্যে, নিজের রস নিজেকেই শুষে নিতে হয় মাটি থেকে, অন্য কেউই সাহায্য করে না; নিজের সব ফুল ফোটাতে হয় নিজেকেই।একা একা। নিজের সুগন্ধও ছড়াতে হয় একাই। যদি, সুগন্ধ বেঁচে থাকে কিছু।
আমরা সকলেই একা।.... মানুষ, গাছ, আকাশের তারারা।সমষ্টি একটা ইল্যুশান্ । চোখের ভুল।
কার কবিতা যেন? মনে থাকে না কবিদের নাম! শুধু কবিতা মনে থাকে। কার? মনে পড়েছে। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের...
"পথে যেতে কষ্ট হয়,পথের একপাশে বসে থাকি।
গভীর গাছের নিচে বসে থাকি যেন শুকনো পাতা-
পাতার মতন থাকি, কষ্ট পাই বাতাসের হাতে,
উড়ে যেতে পারি বলে ভয় পাই,পুড়ে যেতে পারি।
পথে যেতে কষ্ট হয়, তাই একপাশে বসে থাকি
পড়ে থাকি ঢিবি কিংবা পুরাতন পাথরের মতো...'
মাধুকরী: বুদ্ধদেব গুহ
সাদা জীবনের কালো কথায় আজ তো বন্ধুত্ব দিবস এর কথা। চারিদিকে শুধুই বন্ধুত্বের নানা আঁকিবুঁকির ছড়াছড়ি। তবু সব কিছুর মাঝেও যে মানুষ বড়ো একা। বিছিন্ন দ্বীপের মতই। যতই জড়াজড়ি করে থাকি আমরা, সবাই যে বড়ো একাই বেঁচে থাকি আমরা। ঠিক ওই গুবরে পোকার মতই। তাহলে বুদ্ধদেব গুহর লেখা সেই মাধুকরীর রুষা আর রিভু কি বড়ো একা ছিল। কে জানে। হয়তো তাই।
জীবনের এই দীর্ঘ পথে কত পরিচয়, কত মধুর স্মৃতি, কত আপন আর পরের সাথে যোগাযোগ, কত বিছিন্ন হয়ে যাওয়া কারণে অকারণে। তার মাঝেও যে কত একাকীত্ব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কে জানে। জানি না কি বলতে চাই আমি, সত্যিই জানি না। তবু যেনো মনে হয়, মনের ভিতর শরীরের ভিতর যে ভালোবাসার অনুভূতি জন্মে যায়। জীবনের দীর্ঘ পথে যে সম্পর্কের বন্ধন তৈরি হয় একের সাথে অপরের সেই বন্ধুত্ব তো মনের মধ্যেই বেঁচে থাকে ডুব সাঁতার কেটে। তার জন্যে দিবস পালন করা কেনো জানি না আমি।
ছোটো বেলার সেই রাজবাড়ীর কাদা মাঠে ভিজে কাদা মেখে ফুটবল খেলার বন্ধুত্ব, টিনের কৌটোয় কাঁচের গুলি জমিয়ে রাখা দুই বন্ধুর বন্ধুত্ব, সেই নীল আকাশে পেটকাটি আর চাঁদিয়াল ঘুড়ির বন্ধুত্ব, সেই কড়কড়ে মাঞ্জা সুতোয় হাত কেটে গেলে একজন অপর জনকে ছেড়ে চলে না গিয়ে ওষুধ এনে হাতে লাগিয়ে দেওয়ার বন্ধুত্ব, কলেজের ক্যান্টিনে এক কাপ গরম চাকে দু ভাগ করে খেয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করার বন্ধুত্ব, আর সেই যে ছোটো বেলায় দুর্গা ঠাকুর দেখতে গিয়ে একসাথে দুজনের টাকা দিয়ে মিলে মিশে একসাথে আলুকাবলি খেয়ে ঘরে ফিরে আসার বন্ধুত্ব।
আবার বহু বছর পরে সেই যে বড়ো হয়ে একসাথে হাত ধরে ব্যবসা করবো বলে নিজেদের নামে কোম্পানির প্যাড ছাপিয়ে স্বপ্ন দেখার বন্ধুত্ব, যে বন্ধুত্ব আজও অমলিন হয়ে বেঁচে থেকে আজও স্বপ্নিল হয়ে। এমন কত কি যে টুকরো টুকরো জীবন, জীবনের দৌড় সব বন্ধুত্বের বাঁধনে বাঁধা পড়ে আছে কে জানে। ঠিক যেনো ভেজা রাস্তায় জুরি গাড়ি করে স্মৃতির সরণী বেয়ে চলার মত। আবছা আলোয় আলোকিত সব এমন মধুর স্মৃতি উপচে পড়ছে এই বন্ধুত্ব দিবসের দিনে সাত সকালে।
তাই এই বন্ধুত্ব দিবস এর কথা বলতে গিয়ে এসব কথা লিখে ফেললাম আমি। যা নিয়ে আজ এত হৈ চৈ, এত হুল্লোড় এসবের মাঝেও যে আমরা বড়ই একা। নির্জনে বাস করি নিজের অজান্তেই নিজের মধ্যে। ছোটকাল পার করে বড়ো হয়ে বন্ধুত্বের সংজ্ঞা সম্পর্কে যে কিছুটা মরচে পড়ে যায়। ঘটা করে এমন বন্ধুত্বের দিবস পালনের দিনের মধ্যেই যে সে কেমন মন মরা হয়ে মুখ লুকিয়ে থাকে বসে থাকে একা একা। নিজের চিন্তায় বুঁদ হয়ে। তবু তো সে কেমন যেন একা, বড়ই একা। হাত বাড়ালেই বন্ধু এই সব এর মাঝেও কি এই অতলান্ত জীবনে চলতে গিয়ে সে বড়ই একা একাই ঘুরে বেড়ায় এই জল, জঙ্গল, মাঠ, ঘাট, চরাচর পেরিয়ে। সেই অপু আর দুর্গার রাল পথের ধার দিয়ে। কলমি শাকের সোঁদা গন্ধ, ভেজা আমলকী বনের মৃদু বাতাস গায়ে মেখে। সেই লাল মাটির রাস্তা ধরে একা একদম একা।
সত্যিই কি মাধুকরীতে লেখা সেই লাইন গুলোই বড়ো প্রকট হয়ে গেলো জীবনে। সত্যিই যে মানুষ বড়ো একা একদম একাই। তার মাঝে হয়তো জোনাকির আলো গায়ে মেখে বেঁচে থাকার ইচ্ছা হয়, শীতের ভোর বেলায় সেই ঘুড়ি লাটাই এর উৎসব, সেই কাঁচের লাল নীল গুলির টক টক শব্দ, সেই ভেজা কাদা মাঠে বল নিয়ে দৌড়ে যাওয়া, সেই লাল বুড়ির চুলের মিষ্টি স্বাদ নিয়ে একটু কিছু বুকের মাঝে বেঁচে থাকে। সেটাই বোধ হয় সারা জীবন ধরে, সারা জীবন জুড়ে বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ে টুপটাপ করে। আমরা আপ্লুত হই। আমরা স্নাত হই। আমরা ঋদ্ধ হই, আমরা সমৃদ্ধ হই।
আমরা জীবনকে আরোও বেশি করে জড়িয়ে ধরি একা একাই। একা জীবনের মাঝে বন্ধুত্বের এই জড়োয়া গায়ে জড়িয়ে ইচ্ছা করে বেঁচে থাকতে। ঘুরে বেড়াতে। কিন্তু তাহলে মাধুকরীর সেই লেখা, সেই লাইন, মানুষ যে বড় একা। কে জানে কোনটা ঠিক, কোনটা বেঠিক। তবু বন্ধুত্বের দিবসে আঁকা বাঁকা ক্যানভাসে আঁকা আমার এই আঁকিবুঁকি লেখা। আমার সব বন্ধুদের প্রতি অমলিন ভালোবাসা।
বন্ধুত্ব দিবস ও আমি - অভিজিৎ বসু।
চৌঠা আগষ্ট, দু হাজার চব্বিশ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন