সাদা জীবনের কালো কথায় আজ শুধুই বিশ্বাস। ভগবান শিবের প্রতি ভক্তের অপরিসীম বিশ্বাস। যে বিশ্বাসের টানে শুধুই ছুটে যাওয়া। পথ চলা। দৌড়ে যাওয়া। হাজার হাজার মানুষের, লক্ষ লক্ষ মানুষের। কথায় আছে বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর। যতই বলা হোক ধর্ম হলো আফিম। আফিমের নেশায় বুঁদ মানুষ ছুটে চলেছে এই ভাবেই। কিন্তু যে যাই বলুক ধর্মীয় বিশ্বাস হলো মানুষের একটা পরম্পরা। যে বিশ্বাস যুগ যুগ ধরে গেঁথে আছে ভক্তের হৃদয়ে ভগবানের জন্য। আর তাই তো এইভাবেই ছুটে যাওয়া। শ্রাবণ মাস হলো পূণ্য মাস। পবিত্র মাস। বাবার জন্ম মাস। সেই সব কিছুকে স্মরণ করেই তো এই ভাবে দৌড়ে যাওয়া।
তারকনাথ মন্দির বা তারকেশ্বর মন্দির ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হুগলি জেলার তারকেশ্বর শহরের একটি হিন্দু মন্দির। এটি হিন্দু দেবতা শিবের উদ্দেশ্যে নিবেদিত। এই মন্দিরে শিবকে "তারকনাথ" নামে পূজা করা হয়। ১৭২৯ সালে নির্মিত এই মন্দিরটি একটি আটচালা মন্দির। মন্দিরের সামনে একটি নাটমন্দির আছে। মন্দিরের কাছে কালী ও লক্ষ্মী-নারায়ণের মন্দির আছে। শিবমন্দিরের উত্তর দিকে দুধপুকুর নামে একটি পুকুর আছে। বলা হয়ে থাকে, এই পুকুরে ডুব দিয়ে স্নান করলে যাবতীয় মনস্কামনা পূর্ণ হয়। রামকৃষ্ণ পরমহংসের পত্নী তথা বিশিষ্ট হিন্দু ধর্মগুরু সারদা দেবী একাধিকবার এই মন্দিরে পূজা দিতে এসেছিলেন।
এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা হলেন রাজা ভরমাল্লা রাও।
বাবা তারকনাথ বাবা তারকেশ্বর বা বাবা তারকেশ্বরনাথ নামেও পরিচিত। তিনি ভগবান শিবের একটি হিংস্র (উগ্র) রূপ, যিনি সমুদ্র-মন্থনের সময় হলাহল (বিষ) পান করেছিলেন। তারকেশ্বরনাথ ভগবতী তারার স্বামী। তার শিবলিঙ্গও তারাপীঠ থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে বাংলায় অবস্থিত আছে।
কিংবদন্তি অনুসারে, রাজা ভরমল্ল একদিন গভীর রাতে একটি স্বপ্ন দেখেন। তারকেশ্বরের কাছে জঙ্গলে একটি শিবলিঙ্গের স্বপ্ন দেখেন রাজা। এরপর তিনি এই স্বয়ম্ভু লিঙ্গটি খুঁজে বের করেন। ১৭২৯ সালে "বাবা তারকনাথ" নামে পরিচিত এই লিঙ্গের উপর আধুনিক মন্দিরটি গড়ে ওঠে। যে মন্দিরের পাশেই রয়েছে দুধপুকুর। যার জলে স্নান করলে তারপর বাবার মাথায় জল ঢাললে মনের সব ইচ্ছা পূরণ হয়। আর সেটা যদি হয় এই বাবার জন্ম মাসে শ্রাবণ মাসে।
এত গেলো ভগবান আর ভক্তের গভীর গোপন বিশ্বাসের কথা। সেই যে শেওড়াফুলির নিমাইতীর্থ ঘাট থেকে গঙ্গায় স্নান সেরে হাজার হাজার ভক্ত জল কাঁধে করে রাস্তা ধরে তারকেশ্বর রওনা দেন। ভোলে বাবা পার করে গা এই স্লোগানে মুখরিত হয় আকাশ বাতাস সব কিছুই। বাবার টানে ছুটে যান আট থেকে আশি বছর বয়সের সব মানুষ।
দীর্ঘ আটত্রিশ কিলোমিটার পথ হাসি মুখে পার হয়ে যান তারা কোনো রকম কষ্ট ছাড়াই খালি পায়ে কাঁধে বাঁক নিয়ে। রাস্তার দুধারে সেই সব ভক্তদের জন্য তৈরি করা হয় নানা জলছত্র শিবির। যেখানে খাবার, জল, চা, ওষুধ সব দেওয়া হয় বিনা মূল্যে। গোটা শ্রাবণ মাস জুড়ে একটা যেনো বৃহৎ উৎসব যে উৎসবে সামিল আপামর জনসাধারণ। যারা শুধু এটাই জানে যে এই পবিত্র মাসে বাবার কাছে যেতে পারলে বাবার চরণে জল ঢাললে সব মনের ইচ্ছা পূরণ করেন বাবা তারাকনাথ। যিনি সমুদ্র মন্থনে হলাহল পান করে পৃথিবীকে রক্ষা করেছিলেন সেই বাবা তারকনাথ ভক্তদের রক্ষা করেন সব সময়।
সারাবছরই এই মন্দিরে তীর্থযাত্রীরা আসেন। বিশেষত সোমবারে এই মন্দিরে বেশি তীর্থযাত্রী সমাগম হয়। ফাল্গুন মাসে (ফেব্রুয়ারি-মার্চ) শিবরাত্রি ও চৈত্র মাসে (মধ্য এপ্রিল) গাজন উৎসবে প্রচুর তীর্থযাত্রী তারকেশ্বরে আসেন। শ্রাবণ মাস (জুলাই-অগস্ট) শৈবদের কাছে হলো বিশেষ পবিত্র একটি মাস। এই মাসের সোমবারগুলিতেও তারকেশ্বরে প্রচুর তীর্থযাত্রী আসেন। কারণ সোমবার হলো বাবার জন্মবার।
মহাশিবরাত্রি ও চৈত্র সংক্রান্তিতে তারকেশ্বর মন্দিরে বিশেষ উৎসব হয়। প্রতি সোমবার হয় বিশেষ পূজা। তবে শ্রাবণের সোমবারগুলিতে তারকনাথকে গঙ্গোদকে স্নান করানোর উদ্দেশ্যে লক্ষাধিক মানুষের সমাগম ঘটে। যার জন্য বিশেষ ট্রেন চলে হাওড়া তারকেশ্বর শাখায় ভীড় সামাল দিতে। তারকেশ্বর রোড এলাকায় সমস্ত যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
শুধুই ভক্তের দল বাবাকে স্মরণ করে এগিয়ে চলে পূণ্য ভূমি তারকেশ্বর মন্দিরে। জয় বাবা তারকনাথ। হে প্রভু জগৎবন্ধু, দীনবন্ধু, জগৎপতি জগতের সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়ের রক্ষাকর্তা তুমিই। তুমি আমাদের সকলকে রক্ষা করো। জীবনের দুঃখ দূর করো। কালিমা মোচন করো। এই বিশ্বাস নিয়েই তো যুগ যুগ ধরে পূণ্য শ্রাবণ মাসে এই ভাবেই ভক্তের দল চলে আসছে বাবা তারকনাথের কাছে। জয় বাবা তারকনাথ।
জয় বাবা তারকনাথ- অভিজিৎ বসু।
পাঁচ আগষ্ট, দু হাজার চব্বিশ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন