আজ সাদা জীবনের কালো কথায় এক নতুন গল্প। নতুন চরিত্র। নতুন জীবনের কথা। যার সাথে আমার পরিচয় আলাপ যোগাযোগ কিছুই ছিল না কোনোদিন কোনো ভাবেই। আমাদের দুজনের সাথে যোগাযোগ ছিল না কোনো ভাবেই একদম। দেড় হাজার কিলো মিটার দূরে থাকা একজন মানুষের সাথে অন্য এক মানুষের আলাপ এর মাধ্যম ছিল সেই আমার অতি ভালোবাসার খুব কাছের মানুষ আরেফুল ভাই। যার কথা, যার গল্প, যার জীবনের নানা কথা আমি আগেই লিখেছি আমার এই আঁকিবুঁকি ব্লগে একবার।
আজ আরেফুল নেই আমাদের দুজনের জীবনে। তবু তার স্পর্শ, তার কথা, তার ভালোবাসা, অনুভব করি আমি আজও এই এত দিন পরেও। আমার সাদা জীবনের কালো কথায় নানা মনি মুক্তের মত ছড়িয়ে আছে এমন কিছু মানুষ জন যারা আমায় প্রতি নিয়ত ভালোবাসেন। হয়তো এই ভালোবাসা আমায় বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। আর সেই ভালোবাসার এক সুন্দর গল্প বলব আজ আপনাদের। আমাদের এই ভালোবাসার বন্ধুত্বের দিনে। যে দিনে ভালোবাসার মানুষটাই নেই এই পৃথিবীতে।
আমার মেয়ে চন্দননগর সেন্ট জোসেফ কনভেন্ট স্কুল থেকে ক্লাস টুয়েলভ পাশ করলো। আর আরেফুল ভাই সেই খবর পেয়ে খুব খুশি হলো। কিন্তু এর পর সেই আরেফুল যেই শুনলো আমার মেয়ে ব্যাঙ্গালোরে সেন্ট জোসেফ কলেজে চান্স পেয়েছে ভর্তি হবে সেখানে। সেই শুনেই ঝাঁপিয়ে পড়লো আরেফুল কি করে সাহায্যে করা যায় আমায়। কিভাবে আমাদের উপকার করা যায় সেই নিয়েই তার মাথা ব্যাথা শুরু হলো। আর তাতে আমি কিছুটা হলেও সংকুচিত হয়ে পড়েছিলাম ওর এই পাগলামো দেখে। কিন্তু আরেফুল যে এমনই গোত্রের একজন মানুষ। যারা কোনো হিসাব নিকাশ না করেই ঝাঁপিয়ে পড়ে এই ভাবেই ওপরের জন্যে।
আমরা হলাম সাধারণ, অতি সাধারণ গোছের একজন মানুষ, যারা সব হিসেব নিকেশ করে পা টিপে টিপে অপেক্ষা করি, বাঁচি নিঃশ্বাস নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাই একে অপরকে পিছনে ফেলে এগিয়ে টপকে যাই ঠেলেঠুলে। আমরা ভাবতেই পারিনা যে কোনো একজন মানুষ অন্য মানুষের পরিবারের জন্যে, তার মেয়ের বাইরে পড়তে যাবার জন্য নিজের উদ্যোগে তার থাকার ঘরের সুলুক সন্ধান করতে শুরু করে দিয়েছে নিজে থেকেই কাউকে কিছু না জানিয়ে। আসলে আরেফুল প্রকৃতির মানুষরা বোধ হয় এমন টাই হয়। যারা আগু পিছু কোনো কিছু না ভেবেই যে কোনো দরকারে এই ভাবেই ঝাঁপিয়ে পড়ে। যদি কোনো ভাবে একটু উপকার করা সম্ভব হয় সেই আশায়।
আর তার ফলেই সে ব্যাঙ্গালোরে নিজে যোগাযোগ করে এই হাবিব রহমান মল্লিক এর সাথে। যার বাড়ী হাওড়া জেলায়। হুগলীর আরামবাগে তার কোনো এক আত্মীয় থাকেন দাদা বোধ হয়। সেই সূত্রেই সে হাবিব রহমান এর খোঁজ পেয়ে যায় আরেফুল আরামবাগে বসে। তারপর আমার মেয়ে ব্যাঙ্গালোরে সেন্ট জোসেফ কলেজে চান্স পেয়েছে তার থাকার ঘর লাগবে এই কথা বলে হাবিব এর বাড়িতেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দেয় সে বেশ কম ভাড়ায়। যাতে কোনো অসুবিধা না হয় আমাদের এই অচেনা অজানা জায়গায় পড়তে গিয়ে। এমনকি আমার বউ যদি একটা কাজ পায় ব্যাঙ্গালোরে সেই বিষয়েও কথা বলে সে।
সেই থেকেই তো হাবিব ভাই এর সাথে আমার আলাপ, যোগাযোগ, কথা বার্তা আর সম্পর্ক শুরু হলো। বেশিদিন নয় সেই দিনের কথা। ব্যাঙ্গালোরে ইন্টেরিয়র ডিজাইন এর বড়ো ব্যবসা করেন হাবিব ভাই। বড়ো ব্যবসায়ী তিনি সেখানে বহু মানুষের সাথে তাঁর পরিচয়। আরেফুল ভাই এর কথায় রাজি হয়ে গেলেন এক কথায় হাবিব ভাই। আমার মেয়ের মতো তাঁর মেয়েও একসাথে বারও ক্লাস পাস করেছে সেই বার। সেও ভর্তি হবে কোনো কলেজে ব্যাঙ্গালোরে কম্পিউটার নিয়ে পড়বে সে। তার দুই ছেলে আর এক মেয়ে।হাবিব ভাই এর কথায় ভালই হলো দুজনের ভালো বন্ধুত্ব হবে তাহলে। সেই শুরু যোগাযোগ আর কথা বার্তা।
কিন্তু যার মাধ্যমে এই যোগাযোগ আলাপ হয়েছিল সেই মানুষটাই আজ আর নেই এই ধূলিধূসর পৃথিবীতে। আজ বহুদিন পর বন্ধুত্ব দিবসের দিনে আরেফুল ভাই এর কথা মনে হলো আমার। হাবিব ভাইকে বললাম সেই কথা ফোনে। তিনিও বললেন ঠিক বলেছেন আপনি, যে আমাদের যোগাযোগ করে দিলো দুজনের সাথে। আজ আর সেই ভালো মানুষটাই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। সত্যিই ভগবানের কি বিচার কে জানে। আমার বেশ মাঝে মাঝে রাগ হয় এই ভগবানের ওপর কি এমন ঘটনা ঘটে গেলো যে আরেফুল চলে গেলো সবাইকে ছেড়ে দিয়ে।
তারপর অনেক জল বয়ে গেলো গঙ্গা দিয়ে। আমার মেয়ের ব্যাঙ্গালোরে যাওয়া হলো না আর। সে ভর্তি হলো বোলপুরে শান্তিনিকেতন এর ভাষাভবনে জাপানী ভাষা নিয়ে পড়বে বলে। হাবিব ভাই যে ঘর রেখে দিয়েছিলেন আমাদের জন্যে কোনো এডভ্যান্স ছাড়াই দীর্ঘদিন পড়ে সেই ঘর অন্য কেউ ভাড়া নিয়ে নেয়। তাতেও কিছুই বলেন নি তিনি। সেই থেকে আরেফুল আমদের ছেড়ে চলে গেলেও, আমরা কেউ একে অপরকে ছেড়ে চলে যাইনি হাবিব ভাই ও আমি। বরং দুজনের বন্ধুত্ব আরোও গাঢ় হয়েছে এই দুর্দিনেও। দরকারে অদরকারে আমরা দুজন একে অপরকে ফোন করে কথা বলেছি, গল্প করেছি। যেখানে হিসেব করে কিছুই হয়নি। আজ এতদিন পর সেই সব কথা মনে পড়ে যাচ্ছে আমার। যেদিন বন্ধুত্বের দাবি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে সবাই এ ওর গায়ে ফেসবুকের দেওয়ালে হামাগুড়ি দিচ্ছে সবাই রক ক্লাইম্বিং এর মত। এটাই তো বন্ধুত্ব দিবসে অন্যরকম একটা অনুভুতি তাই নয় কি।
যেখানে দূরের দেশে হারিয়ে গিয়েও পরোপকারী সেই আরেফুল আমাদের দুজনকেই একে অপরের বন্ধু করে দিয়েছে অজান্তেই কেমন করে কে জানে। যে বন্ধুত্ব আজও টিকে আছে আমাদের জীবনে এত দিন পরেও সেই দেড় হাজার কিলোমিটার দূরে থেকেও। উনি কলকাতায় এলে আমাদের শ্রীরামপুরের বাড়ী যান খোঁজ করেন কেমন আছি আমরা। মেয়ের খবর নেন কোন ক্লাস হলো ওর। আসলে পরিচিত মানুষজন, খুব কাছের আত্মীয় স্বজন না খবর নিলেও অনামী একজন মানুষ আমাদের খবর নেন। যা এই বন্ধু খোঁজার দিনে বড়ো বেশি করে মনে পড়ে যায় আমার।
ব্যাঙ্গালোরে আর বোলপুরে বসে আমরা দুজন অস্ফুটে বলি ভাগ্যিস আমাদের দুজনের এই পরিচয়টা হয়েছিল একে অপরের সাথে। না হলে কি আর এই সৌভাগ্য হতো আমাদের। কদিন আগেই তো আমার প্রাক্তন ক্যামেরাম্যান অসুস্থ হয়ে ব্যাঙ্গালোরে যায় এবিপি আনন্দ এর রিপোর্টার সৌরভ বন্দোপাধ্যায়। ওকে কোথায় থাকতে হবে কোন ডাক্তার দেখবে সেটাও হাবিব ভাই বলে দেয় আমায় গাইড করে দেয় কোনো কিছু মনে না করেই।
আজ কত দিন পর এই সব কথা বড়ো বেশি মনে পড়ে যাচ্ছে আমার আরেফুল বন্ধুকে হারিয়ে। হাবিব ভাই কতবার যে ব্যাঙ্গালোর যাবার আমন্ত্রণ জানিয়ে বলেছেন আসুন আপনারা, সব আপনাদের ঘুরিয়ে দেখাবো আসুন দাদা একবার ব্যাঙ্গালোরে চলে আসুন সবাই মিলে। আমিও বলেছি হ্যাঁ যাবো যাবো এইবার। হয়তো পরিস্থিতির চাপে পড়ে যাওয়া হয় ওঠেনি আমার। কিন্তু আরেফুল এর দৌলতে আলাপ হওয়া সেই বহু দূরের সম্পর্ক আজও টিকে আছে, বেঁচে আছে কেমন করে কে জানে।
এটাই তো এই বন্ধু খোঁজার দিনে আমার পাওয়া সেরা উপহার। আর আরেফুল হয়তো দুর থেকে সেটা দেখে মনে মনে খুশি হচ্ছে। আর মিটিমিটি করে হাসছে আকাশ থেকে আমাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে। আর বলছে এত হিসাব নিকেশ না করে এইভাবেই এমন সহজ সরল সম্পর্ক নিয়ে বেঁচে থাকো তোমরা। দেখবে জীবন কত সুন্দর হবে, মোহময় হবে, আনন্দের হবে, সুখের হবে।
জীবনের নানা রঙের নানা কথা এই ভাবেই যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আমার এই ক্ষুদ্র জীবনে। আজ তাই এই রাতের অন্ধকারে আমায় ছেড়ে চলে যাওয়া বন্ধু আরেফুলকে স্মরণ করে সেকথাই আমি লিখে ফেললাম এমন বন্ধুত্বের দিনে। আমার সাদা জীবনের কালো কথায় এই আঁকিবুঁকি ব্লগে। যে কথা বলতে বড়ো ভালো লাগে। কোনো রকম হিসেব নিকেশ না করেই লিখে ফেললাম এই আরেফুলের কিছু অকথিত কথা। যা কোনো দিন ভোলা যাবে না।
আরেফুল, হাবিব ভাই ও আমি - অভিজিৎ বসু।
পাঁচ আগষ্ট, দু হাজার চব্বিশ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন