আজ মন্টাই এর ঝুলন এর ছবি দেখে যা পোস্ট করেছে হুগলী জেলার এই সময় পত্রিকার বিখ্যাত সাংবাদিক প্রদীপ চক্রবর্তী। সেটা দেখে ছোটবেলার কত কথা যে মনে পড়ে গেলো আমার। আসলে এই ঝুলন যাত্রা তৈরি নিয়ে শৈশবের কত পরিকল্পনা যে করা হতো তার হিসেব নেই। শৈশব, কৈশোর, যৌবন পার করে এখন তো আমি বৃদ্ধ বয়সে এসে পৌঁছে গেছি প্রায়। তবু মন্টাই এর খবরের কাগজ পেতে ঝুলন যাত্রা কেমন যেন অতীতকে মনে করিয়ে দিলো আবার।
সেই ঝুলনের সাত দিন আগে থাকতেই আমাদের ছোটবেলার চরম ব্যস্ততা। কত যে পরিকল্পনা করা হতো কে জানে। পুরোনো ছেঁড়া শাড়ি বা কাপড় দিয়ে কাদামাটি গুলে পাহাড় তৈরির আপ্রাণ চেষ্টা। রাস্তার পাশ থেকে বালি জোগাড় করে লাল, সবুজ রং করে বালির রাস্তা তৈরি করা। পাথর এনে রং করে জলের মধ্য দিয়ে পুকুর তৈরি করে। সেই পুকুরে মাছ ছেড়ে নতুন চমক দেওয়া ঝুলন এর উৎসবে নয়া চমক। আর শ্যাওলা পড়া মাঠের মাটি এনে ফুটবল মাঠ তৈরী করা।
খেলার মাঠের পাশে একটু দূরে বাজার বসিয়ে সেখানে হরেক রকমের পুতুল কিনে বসিয়ে বাজার এর চিত্র ফুটিয়ে তোলা। সেই বাজারে কি না কিনতে পাওয়া যায়। মাছ, ফ্যাল, শাকসবজি, সুধ, মিষ্টি কিছুই বাকি নেই যে। আসলে এই ঝুলন যেনো শুধু রাধা, কৃষ্ণ আর গোপ-গোপীনিদের নয়। এর সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের নানা গল্প, আর নানা শৈশব এর টুকরো টুকরো স্মৃতির ঝলমলে উজ্জ্বল সব নানা ঘটনাও। যে সময়ে আমাদের শৈশবে এই সব ফ্ল্যাট না হওয়া ভেঙে না পড়া বাড়ির অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে বারান্দায় কম আলোয় ঘাড় নাড়া বুড়ো মাথা দুলিয়ে মিটিমিটি হাসত আর দেখতো আমাদের দিকে চেয়ে চেয়ে।
থাকতো পেটমোটা গোপাল ভাঁড়, পাহাড়ের কোণে লাল টুনির অল্প আলোয় সেনা অভিযানে মত্ত থাকতো বন্দুক নিয়ে মিলিটারি সবুজ পোশাক পরে সেনারা। গাছের আড়ালে লুকিয়ে চুরিয়ে যুদ্ধ করতো তারা বুক চিতিয়ে। আর সেই পাহাড়ের ধারে ঘাসের জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতো বাঘ, সিংহ, চিতার দল। শিকার এর জন্য ওঁত পেতে থাকতো তারা চুপটি করে। আর দূরে সবুজ বালির রাস্তায় গাড়ির সারি। মাঠের একপাশে ধান ক্ষেত, গ্রাম্য দৃশ্য, গোয়ালঘর, ধানের মরাই। গ্রামের বউ ঘরে ফিরছে গরু নিয়ে সন্ধ্যার সময়। বা জলের কলসী কাঁখে নিয়ে ঘরে ফিরছে গল্প করতে করতে মেঠো পথ দিয়ে। শহর, গ্রাম সব যে মিলেমিশে একাকার হতো আমাদের শৈশবের সেই দিনগুলোয়।
এমন সব আমাদের শৈশব জুড়ে ছিল শহর, গ্রাম, পাহাড়, দোলনা। যে দোলনায় দোল খেত রাধা আর কৃষ্ণ। ঝুলনের শেষ দিনে সেই দোলনাকে ফুল আলো দিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে রাধা আর কৃষ্ণকে নৌকায় চাপিয়ে দেওয়া হতো। নৌকাবিহার হতো রাধাকৃষ্ণের। সখীরা সব রাধা কৃষ্ণের এই দৃশ্য দেখে মনে মনে খুশি হতেন। রাধা আর কৃষ্ণের মূর্তির সামনে লুচি,ভোগ, তালের বড়া, মিষ্টি দেওয়া হতো।
কি মজা যে হতো এই ঝুলনের শেষ দিনে। সাথে রাধাকৃষ্ণকে ভোগ নিবেদন করে তার প্রসাদ পাওয়া। এই বাড়ির প্রসাদ ওই বাড়ির চৌকাঠ পার করে অনায়াসে ঢুকে যেতো কোনো বাধা না পেয়েই কিছু মনে না করেই। মনে হতো না ওদের বাড়ির রকে বা বারান্দায় ঝুলন এর আয়োজন করলে কেউ কিছু বলবে না তো। কেমন যেনো সব কিছু মেনে নিয়ে মানিয়ে নিয়ে সম্পর্কগুলো কত সহজ ছিল সেই সময়।
কিন্তু ধীরে ধীরে বদলে গেলো কেমন করে সব কিছু। ভাঙা পড়লো বাড়ির সামনে বসার রক, বারান্দা, বড়ো বাড়ির দালান, ভাঙা পড়লো অনাবিল সম্পর্কের টান। কেমন করে যে সব ছোটো ছোটো ফ্ল্যাট এর কুঠুরিতে আটকে গেলো ওই বড়ো বড়ো চেহারার হাসি খুশি সব বাড়ীগুলো কে জানে। তবু তো মন্টাই এর মাঝেও খবরের কাগজ পেতে ঝুলন বসিয়েছে কত যত্ন করে ভালোবেসে। মনে করিয়ে দিয়েছে শৈশবের সেই ফেলে আসা দিনগুলোকে।
আসলে ঝুলন যাত্রা বা হিন্দোলা হলো একটি হিন্দু ঝুলন উৎসব। যা রাধা ও কৃষ্ণকে উৎসর্গ করা হয়। হিন্দোল হলো সংস্কৃত শব্দ যার অর্থ দোলনা। এই ঝুলনযাত্রার উল্লেখ আছে ভাগবত পুরাণ, হরিবংশ ও গীতগোবিন্দ। এই ঝুলন উৎসব মথুরা, বৃন্দাবন, মায়াপুরে এমনকি ইসকন এর ঝুলন পূর্ণিমা উৎসব খুব বিখ্যাত।
একসময় তো শ্রীরামপুর মহাপ্রভুর বাড়ীতে বড়ো করে ঝুলন হতো। ছোটবেলায় দেখতে যেতাম সেই ঝুলন। ঝুলন বসত শ্রীরামপুর রাজবাড়ীতেও। আজ সব কিছুই তো স্মৃতির ঝাপসা আলোয় কেমন ম্রিয়মান হয়ে গেছে। কিন্তু তার মাঝেই জ্বলজ্বল করছে মণ্টাই এর এই সুন্দর কাগজে পাতা ঝুলন যাত্রার একটা ছবি। যে ছবি আমায় ফিরিয়ে নিয়ে গেলো শৈশবের ফেলে আসা সেই দিনে এই বুড়ো বয়সেও।
মন্টাই এর ঝুলন - অভিজিৎ বসু।
উনিশে আগস্ট, দু হাজার চব্বিশ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন