আজ সাদা জীবনের কালো কথায় সেই আমাদের প্রিয় কলেজের কথা। শ্রীরামপুর কলেজের কথা। আসলে স্কুল জীবনের গণ্ডী পার করে কলেজ জীবন যেনো একটা নতুন মুক্তির স্বাদ পাওয়া। জীবনের অনেক গুলো বছর ধরা বাঁধা মাপা জীবন কাটানোর পরে যেনো একটু খুশির মুক্তির দিন কাটানোর সুযোগ পাওয়া। সেই সব পুরোনো দিনের নানা কথা, সুন্দর দিনের স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই কলেজের আনাচে কানাচেতে। জড়িয়ে আছে সুখ, দুঃখ, ভালোবাসা, অভিমান, অনুরাগের কতই না কাহিনী। সে সব কথা থাক। আজ শুধু কেরি দিবসের কথা।
প্রথম যেদিন এই কলেজের গেটে পা দিয়েছিলাম কেমন একটা ছন্দহীন জীবন এর অনুভূতি লাভ করেছিলাম সেই সময়। আসলে কলেজের সেই সব নতুন নতুন ছেলে মেয়েদের সাথে কেমন একটা দুরত্ব অতিক্রম না করতে পারার কারনে হবে হয়তো। পরে সেটা ধীরে ধীরে কেটে যায় আমার। আমাদের সেই সাধের শ্রীরামপুরের কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন উইলিয়ম কেরী, মার্শম্যান, আর উইলিয়াম ওয়ার্ড আঠেরোশ আঠারো সালে। যাদেরকে একসাথে ত্রয়ী বলা হতো সেই সময়।
এই শ্রীরামপুর কলেজ এবং শ্রীরামপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাঁরা তিনজন। যা ভারতের প্রথম ডিগ্রি প্রদানকারী বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে খ্যাত ছিল। যে কলেজ কেরি কলেজ নামেই বেশি পরিচিত ছিল একসময়। উইলিয়ম কেরি 1761 সালের 17 আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন ইংল্যান্ডের নর্দানটন শায়ার এর পলাইপুরী গ্রামে। এক দরিদ্র তাঁতী পরিবারে তাঁর জন্ম হয়। খুব কষ্ট করে বড়ো হন তিনি।
আজ সেই কেরি দিবস। কলেজের প্রতিষ্ঠাতা উইলিয়ম কেরির আজ 263 তম জন্মদিবস। যে কলেজের ইতিহাসে জড়িয়ে আছে অনেক গল্প আর অনেক কাহিনী। ছোটকাল থেকেই কেরি ছিলেন জ্ঞানপিপাসু। প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও উদ্ভিদ বিদ্যায় তাঁর ছিল গভীর আগ্রহ। প্রথম জীবনে কেরি মুচির কাজ করতেন। শিখেছিলেন নানা বিদেশী ভাষাও। হিব্রু, ইতালি, ডাচ ও ফরাসি ভাষা শেখেন তিনি। পরে তিনি বাংলা ভাষাও শেখেন যখন এই দেশে অর্থাৎ ভারতে চলে আসেন তিনি।
পরে মুচির কাজ ছেড়ে দিয়ে তিনি একটি চার্চে পূর্ণ সময়ের জন্য প্যাস্টররূপে কাজ শুরু করেন। সেই সময় তিনি জুতো তৈরির কাজ ছেড়ে দেন। তাঁর সেই সময় একটি বিখ্যাত উক্তি খুব প্রসিদ্ধ হয়। সেটি হলো ঈশ্বরের কাছ থেকে মহৎ বস্তু প্রত্যাশা কর, ঈশ্বরের জন্য মহৎ কর্ম প্রচেষ্টা কর। যে কথাকে মনে করেই তিনি সারাজীবন ধর্ম প্রচারের কাজ করে গেলেন।
এইভাবেই একদিন তিনি নিজের দেশ ছাড়লেন। 1793 সালের 13 জুন একটি স্মরণীয় দিন কেরির জীবনের। এই সময় তিনি স্ত্রী,পুত্র ও কন্যাকে নিয়ে লন্ডন ছাড়েন। ভারতের উদ্দেশে রওনা হন তিনি জাহাজে চেপে। 1793 সালের নভেম্বর মাসে তিনি ও তার সহযাত্রীগণ কলকাতায় এসে পৌঁছে যান। তখন তাঁর বয়স একত্রিশ বছর। কলকাতায় এসে রামরাম বসুর কাছে তিনি বাংলা শিখতে শুরু করেন। এমনকি নিজের হাতে কোনো কাজ না থাকায় মেদিনীপুরে এক নীলকুঠিতে ম্যানেজার হিসেবে কাজও শুরু করেন তিনি সেই সময়।
সপরিবারে সেই সময় মেদিনীপুরে থাকতে শুরু করেন তিনি। কুঠির ম্যানেজার হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। এমনকি সেই সময় একটি অবৈতনিক একটি পাঠশালা খোলেন যেখানে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায় পড়তে পারে সেখানে। কেরি একটি কলেজ করার কথাও ভাবেন রামপালদিঘিতে। এই সময় তিনি বাংলা ভাষা শিখে বাংলা ভাষায় বাইবেলের নতুন নিয়মের অনুবাদ করেন। এর প্রথম সংস্করণের কাজ সমাপ্ত করেন তিনি। এরপর 1798 সালে কেরি শ্রীরামপুরে ছাত্রাবাস স্থাপন করেন। এর মধ্যে মূল মিশনারি সোসাইটি ভারতে আরোও মিশনারি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন।
আর এই সূত্র ধরেই প্রথমে এদেশে আসেন ফাউন্টেইন। তিনি মেদিনীপুরে একটি স্কুল চালু করেন। তারপর 1799 সালের শেষ দিকে আসেন চিত্রকর উইলিয়াম ওয়ার্ড, স্কুল শিক্ষক জোশুয়া মার্শম্যান, মার্শ ম্যানের ছাত্র ডেভিড ব্রানসডন আর উইলিয়াম গ্র্যান্ট। কিন্তু সেই সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এই সব মিশনারিদের প্রতি বিরুদ্ধ মনোভাব পোষণ করতেন। তাই তাঁদের গ্রেফতার করার কথা বলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। যাতে ধর্ম প্রচারের নামে এদেশে ভারতে মিশনারিরা প্রবেশ না করতে পারে। কিন্তু সেই সময় তাঁরা কলকাতা থেকে কিছু দূরে শ্রীরামপুরের ড্যানিশ কলোনিতে বসবাসের সিদ্ধান্ত নেন। সেখানেই তাঁরা বসবাস শুরু করেন পরে 1800 সালে উইলিয়াম কেরিও তাদের সাথে এসে যোগ দেন এই শ্রীরামপুরের ডেনিশ কলোনী তে মেদিনীপুর থেকে।
আর এদের সবার প্রচেষ্টায় শ্রীরামপুরে গড়ে ওঠে ব্যাপটিস্ট মিশন। যা পড়ে এই মিশন নানা কাজ শুরু করে। ধর্ম প্রচার ও শিক্ষা প্রসারের জন্য তারা একটি ছাপাখানাও তৈরি করেন এই শ্রীরামপুর শহরে। এই প্রেস থেকেই আঠেরোশ সালের পাঁচ মার্চ উইলিয়ম কেরির প্রথম বাংলা ভাষায় বাইবেলের নতুন নিয়ম প্রকাশ হয়। কিন্তু সেই ছাপা খানায় আগুন লেগে যায় 1812 সালে। টাইপ, অনুলিপি, পুস্তক সব নষ্ট হয়ে যায় এই আগুনে। ক্ষতি হয় প্রায় একলক্ষ তেত্রিশ হাজার টাকা। কলকাতায় এই খবর পৌঁছালে সেখান থেকে আট হাজার দুশো টাকা সংগৃহীত হয়। পরে ইংল্যান্ডে এই খবর পৌঁছনোর পর প্রায় একলক্ষ বিয়াল্লিশ হাজার টাকার সাহায্য আসে।
এরপর কেরির লেখা ইতিহাস মালা পুস্তকটি প্রথম প্রকাশিত হয়। এরপর 1818 সালে শ্রীরামপুরে তৈরি হয় মিশনারিদের তৈরি শ্রীরামপুর কলেজ। যে শতাব্দী প্রাচীন কলেজের ইতিহাসে জড়িয়ে আছে অনেক পুরোনো কাহিনী। যে কলেজে একমাত্র পড়ানো হয় ধর্মতত্ত্ব বা থিওলজি। ভারতের মধ্য একমাত্র এই কলেজেই ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে পড়ানো হয় সেই সময়।
দেশের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দাসত্ব ঘুচিয়ে স্বাধীনতার অনেক আগে এই উইলিয়াম কেরি এই ভাবে শিক্ষার প্রসার করেন তিনি। ধর্মের প্রসার করতে তিনি যে কলেজ তৈরি করেন সেই আমাদের সবার শ্রীরামপুর কলেজ আজ দুশো বছর পার করে দিয়েছে। গঙ্গা দিয়ে বয়ে গেছে অনেক জল। আজ তাই কেরি দিবসের দিনে একটাই গর্ব হয় আমার এই কলেজের ছাত্র ছিলাম আমিও। জীবনের দুটো বছর হয়তো খুব দ্রুত গতিতে ফুরিয়ে গেছে কিন্তু তবু আজও অমলিন হয়ে বেঁচে আছে কলেজের সেই মরচে পরা স্মৃতি। কিছু বন্ধুত্বের সম্পর্ক। আর গঙ্গার ধারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সেই শ্রীরামপুরের উইলিয়াম কেরি কলেজ।
কেরি দিবস ও শ্রীরামপুর কলেজ - অভিজিৎ বসু।
সতেরো আগস্ট, দু হাজার চব্বিশ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন