আজ সাদা জীবনের কালো কথায় হুগলীর সিঙ্গুরের সেই বাজেমেলিয়া গ্রামের সাদা শাড়ি পরা সরস্বতী দাস এর কথা খুব মনে পড়ছে আমার। কেনো জানিনা আজ ওই সাদা শাড়ির সেই বৃদ্ধা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যাকে মাতঙ্গিনী বলতেন, সেই বৃদ্ধার কথা বলতে ইচ্ছা করছে আজ আমার এই আঁকিবুঁকি ব্লগে। আঁকাবাঁকা অক্ষরে তাই আজ সেই সিঙ্গুরের সরস্বতীর গল্প।
আজকের দিনটা যে সত্যিই বড়ো মন খারাপের একটা দিন। সেই সিঙ্গুরের জমি আন্দোলনে যাঁর হাসি মাখা মুখ, শত্রুর বিরুদ্ধে শক্ত হাতে ঝাঁটা, লাঠি ধরে রুখে দাঁড়ানো সেই কঠিন কঠোর দৃপ্ত ভঙ্গির কথা আজ বড়ো বেশি করে মনে পড়ছে আমার। এই বৃদ্ধাই তো সেই সেদিন বুদ্ধবাবুকে প্রথম কালো পতাকা দেখিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন বন্দুকের নল, গুলি, আর পুলিশের লাঠির জোর দিয়ে চাষীদের বাপ ঠাকুর্দার তিন ফসলি জমি জোর করে দখল করে নেওয়া যায় না কিছুতেই। তার জন্যে বুকের সাহস লাগে আর সঠিক পরিকল্পনা লাগে। যার একটাও ছিল না সেই সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরা আদ্যন্ত ভদ্র সৎ মানুষটার। শুধু ছিল ভালো কিছু কাজ করার সদিচ্ছা আর ছিল একরাশ স্বপ্ন বুনে চলা একটা মানুষের মনের সঠিক সদিচ্ছা।
সে যাই হোক আজ শুধু সিঙ্গুরের সেই মমতার অতি কাছের, অতি প্রিয়, খুব প্রাণের সেই সরস্বতীর কথা। হাজার মানুষের ভীড়েও আর আন্দোলনের ঢেউয়ে সেই বৃদ্ধা মা হারিয়ে যায়নি কোনো দিন কোনো সময়ে। যাকে দূর থেকে দেখলেই সেই সিঙ্গুর আর নন্দীগ্রাম আন্দোলনের জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে কাছে ডেকে নিয়েছেন বার বার। তাঁকে বুকে আগলে হাসি মুখে জড়িয়ে ধরেছেন। বৃদ্ধার সেই হাসিতে যে ছিল আন্দোলনের আসল শক্তি।
কারণ সিঙ্গুর যখন ইচ্ছুক আর অনিচ্ছুকের দড়ি টানাটানিতে দ্বিধাবিভক্ত দ্বিখন্ডিত, রক্তাক্ত। যখন লাল পার্টির নেতারা ভাবছেন এই বোধহয় তাদের স্বপ্ন স্বার্থক হয়ে গেলো। সিঙ্গুরে কারখানা হয়ে যাবে কিছুদিনের মধ্যেই। যখন কাঁটা তারের বেড়া ধরে চাষীদের ফ্যাল ফ্যাল বোবা দৃষ্টি পড়ছে ওই তিন ফসলি জমির ওপর গড়িয়ে গড়িয়ে চোখের জল হয়ে। কিন্তু তখন যে এই বৃদ্ধা মহিলার মতো হাজার হাজার মহিলা রুখে দাঁড়ালেন সিঙ্গুরের মাঠে। শক্তি জোগালেন, আন্দোলনে অক্সিজেনের সন্ধান দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে।
যাদের হাত ধরে প্রায় হেরে যাওয়া গেমটা জিতে গেলেন শেষ ল্যাপে পৌঁছে অগ্নিকন্যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আমি জানি না আজ সেই সরস্বতী, সেই মহাদেবরা আজ কে কেমন আছেন। কে কোথায় আছে সেটাও জানি না আর। জানার ইচ্ছাও হয় না। শুধু এটা জানি বেঁচে থাকলে খুব ভালো নেই তারা। মহাদেব তো অনেক দুরত্ব বজায় রেখে চলছে এখন। সে নিজেই মাঝে একবার ফোনে কথা হয়েছিল আমার সাথে বলেছিল সেই সময়। তাই আজ আর সেই সব কথা নয়। আজ সে সব কথা থাক বরং।
প্রায় নব্বই ভাগ জমিদাতা ইচ্ছুক চাষীদের হারিয়ে, টাটাকে তাড়িয়ে কি করে যে ওই সরস্বতী আর মহাদেবরা জিতে গেলো কে জানে। হয়তো ইচ্ছুকদের ইচ্ছাশক্তির থেকে অনিচ্ছুকদের মনের অদম্য জোর অনেক বেশি ছিল সেই দিন। যার জোরে ওই লাল বাড়ির শক্ত ভিতেও হয়তো কাঁপন ধরে যায় আচমকাই। আর যার ফল প্রকাশের পর দেখা যায় প্রায় দৌড়ে হেরে যাওয়া পিছিয়ে পরা একটা রাজনৈতিক দল কেমন করে জিতে গেলো সবাইকে চমকে দিয়ে।
আসলে এটাই বোধহয় ম্যাজিক। যে স্বপ্নের জাদুকাঠি হাতে ভায়োলিন বাজিয়ে আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর সেই ডাকে ওই বৃদ্ধা সরস্বতী দাস সাড়া দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। যার জাদুতে, যার রক্তাক্ত লড়াইয়ের কঠিন কঠোর দৃঢ়তায় পিছু হঠলো বন্দুকের নল, আর টিয়ার গ্যাসের পুলিশের দল। যা অনেক আগে থাকতেই বুঝে ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই। তাই বোধহয় সিঙ্গুরের লড়াইতে সবার আগে ওই বৃদ্ধা মাতঙ্গিনীকে লড়াইয়ের মাঠে এগিয়ে দিয়েছিলেন তিনি, তাঁকে ভরসা করেছিলেন তিনি।
যার কাছে নতজানু হয়ে হার স্বীকার করতে হলো বন্দুকের নল ধরা, ক্ষমতার দম্ভে কিছুটা বেসামাল হয়ে যাওয়া চৌত্রিশ বছরের পুরোনো ঘুন ধরা এক লাল মসনদের উচ্চ শিখরে বসে থাকা পার্টিকে। যে পার্টির মজবুত ভিতটা নাড়িয়ে দিয়েছে ওই সরস্বতীর মত কিছু মানুষ হাসি মুখে অবহেলায় খুব সহজেই। আজ বড়ো বেশি করে মনে পড়ে যাচ্ছে আমার সেই ফোকলা হাসি মুখের ওই বৃদ্ধার কথা। বিশ্বাস করুন আমি জানি না তিনি কেমন আছেন। কোথায় আছেন। তবুও এটাই বলবো তিনি যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন।
সিঙ্গুরের সরস্বতীর কথা - অভিজিৎ বসু।
নয় আগস্ট, দু হাজার চব্বিশ।
ভালো লেখা।
উত্তরমুছুন