সাদা জীবনের কালো কথায় আজ এক ফুটবল মাঠের স্ট্রাইকার এর গল্প। গ্রামের ফুটবল মাঠের এক স্ট্রাইকার। যার নাম মংলা সোরেন। গ্রাম মহুলা। বোলপুর থেকে ওই গ্রামের দূরত্ব মেরে কেটে প্রায় কুড়ি কিলোমিটার হবে বোধ হয়। বোলপুর বিধানসভার শেষ গ্রাম। এরপর শুরু হচ্ছে লাভপুর এলাকা বোলপুর বিধানসভার শেষ।
কঙ্কালীতলার হাটে ওর সাথে আমার আলাপ পরিচয় হয়। কেমন সুন্দর লম্বা চেহারা, একঝাঁক কালো মাথা ভর্তি চুল, আর ওর কালো চোখের মেদুর দৃষ্টি আকর্ষণ করে আমায়। ওর মুখের ঝকঝকে হাসি মুখ দেখে একঝলকে কেমন ভালো লেগে যায় আমার। বলতে গেলে ওর প্রেমে পড়ে যাই আমি কিছুটা। নিজের অভ্যাস বসত ওই কালো ছেলের নাম আর ফোন নম্বর জোগাড় করি আমি নিজের তাগিদেই। আসলে এই হলো এক সমস্যা। চেনা অচেনা, জানা অজানা, সকল মানুষের জীবনের ভিতরে প্রবেশ করে গুবড়ে পোকার মতো খবর সংগ্রহের নেশাটা কাটিয়ে উঠতে পারছি না আমি কিছুতেই। কি করবো বলুন এত দিনের অভ্যাস বলে কথা।
কদিন আগের বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়া মা কঙ্কালীতলার মন্দির একদম শুকিয়ে কাঠ। কে বলবে কদিন আগেই জলে ভেসে গেছিলো মন্দির অমন করে। কদিন আগের সেই জলে ভেসে যাওয়া মা কঙ্কালীর মন্দির আবার আগের রূপে ফিরে এসেছে। সকাল থেকেই মন্দিরে পূজো দিতে আসছেন পুণ্যার্থীরা। আর তাই কিছু বেচা কেনার আশায় তাই সবাই মন্দিরের গাছ তলায় ভীড় করেছেন শনিবার সকাল হতেই মন্দির চত্বরে। দু সপ্তাহ তো মন্দির চত্বরে আসা হয়নি কারুর। প্রকৃতির রুদ্র রূপে ভেসে গেছিল সব কিছুই। সেই সব চেনা মুখগুলো ভীড় জমিয়েছেন এই শনিবারের হাটে। সতীপীঠ মা কঙ্কালীর মন্দিরে।
যাই হোক এবার মংলার গল্পে আসি। কথা হচ্ছিল মন্দিরের পাশে গাছের তলায় বসে ওর সাথে। খেলার নেশা ওর ছোটো কাল থেকেই। স্কুল জীবনের সেই নেশা বড়ো হয়েও ছাড়তে পারে নি সে কিছুতেই। গ্রামের সব বন্ধুদের নিয়ে ফুটবল খেলা ওর বহুদিনের নেশা। যার জন্য সে বিকেল হলেই খেলার মাঠে দৌড়ে যায় প্রতিদিন নিয়ম করে। স্কুল এর গণ্ডি পার করে বোলপুর কলেজে ভর্তি হয় সে কলা বিভাগ নিয়ে পড়বে বলে। লকডাউন এর সময় পর পর দু বছর পরীক্ষা হয়নি। কিন্তু নিজের গাফিলতিতে আর পরীক্ষা দিয়ে স্নাতক হওয়া হয়নি তার। কিছুটা এই নিয়ে যে আফশোষ হয় এখন তার। কিন্তু কি হবে আফশোষ করে যা হবার সে তো হয়েই গেছে।
বাবা দুর্গাপুরে একটা কারখানায় কাজ করেন। মা চাষের জমিতে কাজ করেন। দু বিঘা জমি আছে তাদের। ঘরে নতুন বিয়ে করেছে সে। কিন্তু তার প্রেম, তার ভালোবাসা ওই সবুজ মাঠ, আর ফুটবলকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। না, কোনো দিন কলকাতার মাঠ দেখার সৌভাগ্য হয়নি তার। কলকাতার মাঠে খেলার কথাও ভাবে না সে কোনোদিন। তেমন কোনো স্বপ্ন সে দেখেও না। সে জানে বৃথা চেষ্টা করে কি লাভ। সে শুধু জানে ওই যে দূরে দূরে খেলতে গেলে টাকা দেয় নগদ টাকা। যে সব খেলায় দূরে দূরে যেতে হয় সেই খেলার মজাই আলাদা।
যদিও এন্ট্রি ফি দিয়ে নাম লেখাতে হয় সেই ফুটবল খেলায়। তাতে কি বাইরে খেলতে যাওয়ার একটা মজাই আলাদা। মণিপুর, ঝাড়খন্ড নানা জায়গায় বাইরে খেলতে গেছে সে গ্রামের হয়ে। গ্রামের ছেলেরা সবাই মিলে এক হয়ে দাপিয়ে বেরিয়েছে ওই সবুজ মাঠে। কোনো খেলায় পুরস্কার এসেছে আবার কোনো খেলায় আসেনি কিছুই। তবু তো মন খারাপ হয়নি তাদের। যেবার সেই ত্রিশ হাজার টাকার পুরস্কার পেলো তারা সবাই মিলে গ্রামে ফিরে কত আনন্দ হলো, পিকনিক হলো, মজা হলো। কিছু টাকা রেখে দেওয়া হলো জমা করে পরের বার খেলায় নাম দেবার জন্য। ওর চোখেমুখে কেমন যেনো একটা আনন্দের বান বইছে।
আমি গাছতলায় বসে বসে ওর কথা শুনছিলাম। সেই বিখ্যাত কোনি সিনেমার গল্পের কথা মনে পড়ছিল আমার। সাঁতারু সেই মেয়ে কোনির কথা মনে পড়ছিল আমার। সেই কোচ এর চিৎকার কোনি ফাইট ফাইট। আর কোনির প্রাণপণ লড়ে যাওয়া। জলের মধ্যে, জলের বাইরে। একপেট খিদে নিয়ে লড়ে যাওয়া। সত্যিই তো কতদিন আগে যে সেই কোনটি সিনেমা দেখেছিলাম। কিন্তু সেই জলের মধ্যে ওই লড়াইটা আজও মনে আছে।
এই মংলা সোরেন কোনো তেমন কোচ পায়নি খেলার জন্যে। কোনো রকম সাহায্য পায়নি কারুর। খেলার উপযুক্ত জিনিসও পায়নি সে ঠিক করে। তবু বিকেল চারটে বাজলেই ওকে সবুজ মাঠ হাতছানি দেয়। মাঠের মাঝে ফুটবল ওর প্রতীক্ষায় প্রহর গুনে অপেক্ষা করে। কখন স্ট্রাইকার মংলা বল নিয়ে সবুজ মাঠে দৌড়ে বেড়াবে। আর সবাইকে কাটিয়ে বিপক্ষের জালে বল জড়িয়ে দেবে। আর শুন্য আকাশে দু হাত তুলে গোল বলে চিৎকার করবে সে। ওর চোখে মুখে আনন্দের উচ্ছ্বাস প্রকাশ হবে। ওর সারা শরীরে আগুন বয়ে যাবে।
কেমন যেনো ওকে দেখে মনে মনে বেশ মুগ্ধ হলাম আমি ওর কথা শুনে। সেই যে সাঁইথিয়া যেবার খেলতে গেলো গ্রাম থেকে কি মজা হয়েছিল। ওর কিশোর মুখের অনাবিল সুখের উপচে পড়া ঝকঝকে হাসি দেখে কেমন যেন মনটা ভরে গেলো আমার। নিজের ছোটো বেলার সেই খেলার মাঠে ফিরে যেতে ইচ্ছা হলো আমার। সেই যে শ্রীরামপুরের রাজবাড়ীর মাঠ, সেই কোন্নগর নবগ্রাম সেবক সংঘের মাঠ, সেই শ্রীরামপুরে বাণীভারতী স্কুলের কাদা মাঠ, যে মাঠে খেলতে গিয়ে শামুকের খোলে হাঁটুর মালাইচাকির মাংস কেটে গেলো। মাঠ থেকেই ওয়ালস হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। সেলাই করে ভয়ে ভয়ে সন্ধ্যা বেলায় ঘরে ফিরলাম বন্ধুদের সাথে। সেই যে আশু গোস্বামীর মাঠ, সেই নিতুদার কোচিং ক্যাম্প, সেই বল নিয়ে দৌড়, সেই স্বাধীনতা দিবসের দিন শ্রীরামপুরের সিইএসসি ক্লাবের মাঠে একদিনের ফুটবল খেলে হেরে শুকনো মুখে ঘরে ফেরা। কত যুগ আগের কথা মনে করিয়ে দিলো এই স্ট্রাইকার মংলা সোরেন আমায় আজ।
মাথার ওপর আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা। মেঘ ডাকছে মাঝে মাঝে। মংলা দ্রুত নিজের জিনিস পত্র গুছিয়ে ফেলে। ঘরে ফিরতে হবে তাকে দ্রুত। তারপর ঘরে ফিরে একটু ভাত খেয়ে ঘরে দু দণ্ড জিরিয়ে নিয়ে আবার মাঠে দৌড়বে সে প্রতিদিনের মতো। ওই চেনা সবুজ মাঠ, মাঠের চেনা ঘাস, ওই দূরের গোল পোস্ট, ওই চেনা গোল বল, তাকে ডাকছে যে হাতছানি দিয়ে।
মংলাকে দেখে মনে মনে আমার বড়ো হিংসা হলো। যদি আবার আমিও ওর মতো ওই সবুজ ঘাসের মাঠে একবার প্রাণপণে দৌড়তে পারতাম। ছোটো বেলার মত নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে বল নিয়ে এদিক ওদিক ছুটে বেড়াতে পারতাম। দূরের গোলপোস্টের জালে ওই গোল বলকে জড়িয়ে দিয়ে গোল বলে শূন্য আকাশে একবার দু হাত তুলে গোল বলে চিৎকার করতে পারতাম। তাহলে কি ভালো যে লাগতো আমার।
স্ট্রাইকার মংলা - অভিজিৎ বসু।
এগারো আগস্ট, দু হাজার চব্বিশ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন