সাদা জীবনের কালো কথায় আজ শুধুই চিঠির কথা। আসলে চিঠি দিবসের দিনে মনে হলো সেই হারিয়ে যাওয়া চিঠির কথাই একটু লিখি আমি। চিঠি তো হলো মানুষের মনের আয়না। যে আয়নায় নিজেকে দেখে বড়ই অচেনা লাগে। যে আয়নায় নিজের মুখ দেখে মনে হয় এটা আমি। এ যে একদম অচেনা, অজানা, আমি। যে আমিকে আমি নিজেই চিনতে পারিনা একদম। চিঠির ছত্রে ছত্রে নিজেকে ভেঙে ফেলে অন্যের কাছে ধরা দেবার চেষ্টা করা আর কি।
সত্যিই তো সেই চিঠির দিন গুলো যে কোথায় হারিয়ে গেল কে জানে। আজ তো চিঠি দিবসের দিনে মনে হয় আমাদের এই দৌড়ে যাওয়া জীবনে চিঠি উধাও হয়ে গেছে কবেই। সেই হিন্দমোটরের চিলে কোঠার ঘর থেকে চিঠি আসতো আমার সেই রিষড়ার টালির ঘরে। হ্যাঁ আমাদের দুজনের দুই বন্ধুর চিঠি দেওয়া নেয়ার যে কত গল্প, কত কথা ছড়িয়ে আছে কে জানে। শুধু যে সেই চিঠির মাঝে পরতে পরতে জড়িয়ে থাকতো কত গভীর গোপন ভালোবাসার চিনচিনে অনুরণন। যা আজ হারিয়ে গেছে বহুকাল আগেই।
একবার অনেক দুর থেকে একটা চিঠি এলো আমার। সবে তখন গ্র্যাজুয়েশন করে এদিক ওদিক কাজের জন্য ঘুরছি। সেই অনেক দূরের এক জায়গায় স্কুলের ইন্টারভিউ এর একটা চিঠি। জায়গাটা খুব সম্ভবত ত্রিপুরার বিলোনিয়া গ্রাম। মাস্টার হবার জন্য ডাক পড়ল ইন্টারভিউ দেবার জন্যে চিঠি। ঠিক বেলা বারোটার সময় সাইকেল করে সেই খাঁকি পোশাকের পিয়নম্যান ঘন্টি বাজিয়ে পাড়ায় ঘুরে ঘুরে চিঠি দিত। ঠিক তেমন করেই আমার বাড়ির সামনে ঘন্টি দিলো।সাদা খামে চিঠি এলো। অভিজিৎ বসু আছে। তাড়াতাড়ি দরজা খুলে মায়ের অবাক করা চাওনি।আর আমার চোখে দূরে কাজে যাবার স্বপ্ন। ভাবলাম যাক একটা কাজের চিঠি তো এলো অবশেষে পাশ করেই। কিন্তু মার দুচোখে আঁধার নেমে এলো যেনো। সেই চিঠির আর কোনো উত্তর দেওয়া হয় নি আমার আর কোনো দিন। যাওয়া হয়নি সেই স্কুলের ইন্টারভিউ দিতে। জানিনা সেই চিঠিকে বহুদিন আমি বাক্সের মধ্য রেখে দিয়েছিলাম। সাদা খাম, নীল রঙের উজ্জ্বল লেখা ধীরে ধীরে ফ্যাকাসে হয়ে গেলো ঠিক আমার জীবনের মত। হয়তো কোথাও হারিয়ে গেছে সেটা আর খুঁজে পাইনি তাকে।
বহুদিন পর মনে পড়ে গেলো সেই বিখ্যাত এক চিঠির কথা। যে চিঠির মুক্তোর মত লেখা। ঝরঝরে বাংলা শব্দের সুষ্পষ্ট আনাগোনা। সেই বিখ্যাত কথা জীবনকে দেখো, জীবনই হলো সবথেকে বড় শিক্ষক। হ্যাঁ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর সেই চিঠি বুকে জড়িয়ে আঁকড়ে কত দিন যে কাটিয়েছি কে জানে। মনে মনে ভাবতাম এই চিঠিকে হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না কিছুতেই। কোনভাবেই একে কাছছাড়া করবো না আমি।
কিন্তু না আজ এতদিন পর শুধু চিঠি দিবসের দিনে ঝুলি হাতড়ে দেখলাম না সেই চিঠিও নেই। কোথাও যেনো উবে গেছে সেও ঠিক কর্পূর এর মতই। পরে আছে শুধু সেই চিঠির কিছু কথা আর একটু অভিমান। যে অভিমান বুকে আগলে বসে আছি আমি। শুধু জীবনকে দেখি আর নানা রূপে নানা ভাবে শিক্ষা লাভ করি। যিনি এই চিঠি লিখেছিলেন মনে মনে বলি আপনি এমন একটা চিঠি সেদিন আপনার সেই যোধপুর পার্কের বাড়িতে বসে সকাল বেলায় ভাগ্যিস আমায় নিজের হাতে দিয়েছিলেন। আজ সেই চিঠিও নেই আমার কাছে। আছে শুধু পুরোনো কিছু স্মৃতি।
যাক গে হারিয়ে যাওয়া, উধাও হয়ে যাওয়া এই চিঠিকে ঘিরেই তো কত কথা। সেই দেওয়ালে টাঙানো লাল বাক্সের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করা যদি কিছু আসে এই আশায়। চিঠি দিবসের দিনে লিখতে বসে আজ যেনো সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে আমার। সেই যে গ্রামের মাসীর বাড়িতে একশো টাকা মানি অর্ডার করে পাঠিয়ে দিয়ে মেজমামা শ্রীরামপুরের বাড়ী থেকে সেই হরিপালের দ্বারহাট্টা গ্রামে চিঠি লিখে কুশল সংবাদ নিত। যদিও তার উত্তর আসতো না কোনোদিন।
কিন্তু সেই হলদে পোস্টকার্ড এর লেখা চিঠি যেনো একটা কেমন সম্পর্কের বাঁধনে বাঁধা ছিল বহুদিন ধরে। যে সম্পর্কের নিনড় অটুট বন্ধন আমাদের সবাইকে বেঁধে রেখেছিল বহুদিন। তারপর একদিন সেই চিঠি লেখাও বন্ধ হয়ে গেলো। এই ভাবেই তো জড়িয়ে ছিল আমাদের নানা পারিবারিক সম্পর্ক শুধুই দু চার শব্দের ঘেরা টোপে বন্দী হয়ে। আজ যে সব কিছু উধাও। নেই সেই দ্বারহাট্টা গ্রামের মেজদিদা। মেজো মামার খবর নেওয়া হয়নি বহুদিন। বয়সের ভারে সেও হয়তো আর কলম চালাতে পারে না। আসলে জীবন তো এমনই।
যাকগে চিঠির কথা লিখতে বসে যে কথা বলতেই হয় সেতো আমার লতাকে দেওয়া সেই চিঠির কথা। আমার সেই স্বপ্নের লতা। যে চিঠির ভাঁজে লুকিয়ে ছিল গঙ্গার জলের সোঁদা গন্ধ। যে চিঠির ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠতো একটা কাঁচা বয়সের প্রেমের ভালবাসার, ভালোলাগার নানা করুন কাহিনী আর আর্তি। যে চিঠি লিখে আমি নিজেকে উন্মোচিত করতাম অজানা অচেনা এক নারীর কাছে সংগোপনে।
যে চিঠির গভীর গোপন কথা কৃষ্ণচূড়ার পাতায় কেমন করে যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লো কে জানে একদিন। এক রাত জাগা পাখিও কেমন করে জেনেছিল সেই চিঠির কথা। যে চিঠির মধ্য লুকিয়ে ছিল কিছু ভালোবাসা, কিছু যন্ত্রণা, কিছু চাওয়া, কিছু পাওয়া। ছিল নতুন কিছু অভিজ্ঞতা। না আজ সেই সব চিঠিও নেই আর। হারিয়ে গেছে তারাও। কোথায় কে জানে।
হারিয়ে গেছে আমার ভালবাসা, হারিয়ে গেছে আমার ভালোবাসার স্পর্শ মাখা চিঠি, হারিয়ে গেছে আমার সেই কৃষ্ণচূড়া গাছের পাতার কাঁপন। শুধু এই বুড়ো বয়সে একা পড়ে আছি আমি। একদম একা। ঠিক ওই দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেই পোস্ট বাক্সের মত। অপেক্ষায় যদি ফিরে পাই আমার হারিয়ে যাওয়া, উবে যাওয়া চিঠির সন্ধান কোনোদিন।
হারিয়ে যাওয়া চিঠি - অভিজিৎ বসু।
পয়লা সেপ্টেম্বর, দু হাজার চব্বিশ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন