আজ কৌশিকী অমাবস্যা। বিশ্বাস অনুযায়ী এই তিথিতে বিশেষ পুজোয় অংশ গ্রহণ করে দ্বারকা নদীতে স্নান করলে নাকি জীবনের সব পাপ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।আর এদিন সঠিক ভাবে যদি তন্ত্র ক্রিয়া করা যায় তাহলে জীবনের সব বাধা বিপত্তি কেটে যায় খুব সহজেই।
কথিত আছে এই দিনেই তারাপীঠে কৌশিকী অমাবস্যা দিনে সাধক বাম্যাক্ষ্যাপা সিদ্ধিলাভ করেন। যে জন্য এইদিনে লক্ষ লক্ষ মানুষের ভীড় উপচে পড়ে মা তারার মন্দিরে। ভক্তরা এই বিশেষ দিনে মাকে পূজো দিয়ে তাঁদের মনোস্কামনা পূরণ করতে চান। কথিত আছে সাধক বামাক্ষ্যাপা বারোশ চুয়াত্তর বঙ্গাব্দে তারাপীঠ মহাশ্মশানে শ্বেতশিমুল বৃক্ষের তলায় তিনি সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। ধ্যানমগ্ন বামাক্ষ্যাপা এদিন মা তারার দর্শন পান বলেও শোনা যায়।
এইদিনে, এই তিথিতে কৌশিকী রূপে মা তারা বিশেষ সন্ধিক্ষণে শুম্ভ আর নিশুম্ভ নামের অসুরদের দমন করেন। সেই নামে এই কৌশিকী অমাবস্যা নামটি এসেছে। এই অমাবস্যা অন্য যে কোনো দিনের থেকে একটু আলাদা। কারণ এই দিনটি বিশেষ একটি দিন আর বিশেষ একটি তিথি। শোনা যায় এইদিনেই নাকি খুলে যায় স্বর্গ আর নরকের দ্বার একসাথে। সাধক এই দিনে কুলকুণ্ডলিনী চক্রকে জয় করে। তন্ত্র মতে এই রাতকে তারা রাত্রিও বলা হয়। যে রাতে অন্ধকার এর রাত হলেও হাজার তারার আলোয় আলোকিত হয় সাধকের জীবন।
এক বিশেষ মুহূর্তে যে রাতে খুলে যায় স্বর্গ আর নরকের দুই দরজা। সাধক এই দুই এর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে নিজের ইচ্ছামত পজিটিভ ও নেগেটিভ শক্তির সাধনার মধ্য দিয়ে আত্মস্থ করেন ও সিদ্ধিলাভ করেন। তাই এই রাত হলো বিশেষ সাধনার রাত। তন্ত্র সাধনার রাত। যে রাতে সিদ্ধিলাভ এর বাসনায় প্রাণপণে চেষ্টা করেন সাধু সন্তরা। যে রাত তাঁদের কাছে বিশেষ সাধন ভজনের রাত। যা বছরের এই একটি দিনেই আসে।
কৌশিকী একজন হিন্দু দেবী। যিনি পার্বতীর আবরণ থেকে আবির্ভূত হন। যিনি হলেন কোষের নারী। যাঁর হাতে থাকে ত্রিশূল, ঘণ্টার, ধনুক, তীর, লাঙ্গল, মস্তক, শঙ্ক , আর সুদর্শন চক্র। তিনি অসুর ভাই শুম্ভ আর নিশুম্ভের সাথে পার্বতীর বিরোধের আগে সৃষ্টি হয়ে ছিলেন বলে জানা যায়। লক্ষী তন্ত্র অনুসারে কৌশিকী হলেন দেবী লক্ষ্মীর প্রকাশ। আজ হলো সেই কৌশিকী অমাবস্যার বিশেষ রাত।
পুরাকালে বলা আছে যে, একবার শুম্ভ ও নিশুম্ভ কঠিন সাধনা করেন। একটাই ইচ্ছা তাঁদের দুজনের অমর বর লাভ করা। কেউ যেনো তাদের দুজনকে মারতে না পারে কোনো ভাবেই। দুজনেই সাধনা করে ব্রম্ভাকে তুষ্ট করেন। চতুরানন তাদের দুজনকে বর দেন তুষ্ট হয়ে। হ্যাঁ কোনও পুরুষ তাদের বধ করতে পারবে না কোনোদিন। শুধু কোনো অ-যোনি সম্ভূত নারী তাঁদের বধ করতে পারবেন। অর্থাৎ এমন এক নারী যিনি মাতৃগর্ভ থেকে জন্ম গ্রহণ করেননি। সেই নারীর হাতেই মৃত্যু হবে এই দুই অসুর এর। কিন্তু পৃথিবীতে এমন নারী কোথায়। আদ্যাশক্তি মহামায়াও তো মেনকা রানীর গর্ভে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। তাই তিনিও এই দুজনকে নাশ করতে পারবেন না।
সৃষ্টির আদিকালে আদ্যাশক্তি মহামায়া কে নিজের কন্যা রূপে পাওয়ার আশায় এক সময় কঠোর তপস্যা করেছিলেন প্রজাপতি দক্ষ। দক্ষ নিজেও ছিলেন ব্রম্ভার মানসপুত্র। তাঁর তপস্যায় তুষ্ট হলেও দেবী একটা শর্ত দেন তাঁকে। তিনি বলেন দক্ষ রাজার কন্যা হয়ে জন্মাতে তাঁর কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু যদি কোনো দিন পিতৃগৃহে তার কোনো অনাদর বা অপমান হয় তাহলে সেই সময়েই তিনি দেহত্যাগ করবেন। সেই শর্ত মেনেই দক্ষ রাজার ঘরে আসেন ছোট্ট ফুটফুটে মেয়ে সতী।
কিন্তু সেই ছোট মেয়ে শিবের খুব অনুরক্ত। কিন্তু রাজা দক্ষ কোনো মতেই তাঁর এই আদরের মেয়ের সাথে শিবের বিবাহ দেবেন না। শ্মশানে ঘুরে বেড়ানো এই দেবতাকে তো রাজা দক্ষ দেবতা বলে মনেই করেন না একদমই। কিন্তু বাবার অমতে মহাদেবকে বিবাহ করেন সতী। কিন্তু এই বিবাহ মেনে নিতে পারলেন না রাজা দক্ষ।
আর তাই তিনি শিবের নিন্দা করতেই বিরাট প্রজাপতি যজ্ঞের আয়োজন করেন দক্ষ। আর সেই যজ্ঞস্থলেই ঘটে গেলো বড়ো অঘটন। সবার সামনে বাবার মুখে শিবের নিন্দা শুনে, পতি নিন্দা শুনে রাগে ক্ষোভে আর অপমানে যজ্ঞের আগুনে প্রাণ বিসর্জন করেন দেবী সতী। দক্ষ যজ্ঞ পণ্ড হবার পরে পর্বত রাজার ঘরে দেবী মহামায়া জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর নতুন নাম হয় পার্বতী।
যজ্ঞের আগুনে প্রাণ আহুতি দেওয়ায় সতীর গৌরবর্ণ ঝলসে কালো হয়ে যায়। জন্মাতরেও পার্বতীর গায়ের রঙ তাই শ্যামলা। আবার কেউ কেউ বলেন না এই কথা ঠিক নয়। মহাদেবকে স্বামী রূপে পাবার জন্য নিজের চারিপাশে অগ্নিকুণ্ড জ্বালিয়ে একসময় কঠোর তপস্যা করেছিলেন পার্বতী। সেই তপস্যায় তাঁর গায়ের রঙ কালো হয়ে যায়। এই অপরূপ সুন্দরী শ্যামবর্ণের উমাকে মহাদেব প্রায়ই আদর করে কালী বা কালিকা বলে ডাকতেন।
স্কন্দপূরাণের দেবী মাহাত্ম্যম এর কালিকাপুরান ও শিবপুরানে এই গল্প আছে। একদিন শম্ভু আর নিশুম্ভ এই দুজনের অত্যাচারে অতিষ্ঠ দেবতারা ছুটে গেলেন কৈলাস পর্বতে। মহাদেব আর মহামায়ার কাছে। তাঁদের দুর্দশার কথা শুনে মহাদেব পার্বতীকে ডেকে বলেন কালিকা তুমিই এখন একমাত্র ভরসা। তুমিই ওদের উদ্ধার করো দেবী।
কিন্তু নারীর মন কি জন্য যে আহত হয় সেটা কি আর পুরুষ কোনো সময় বুঝতে পরে। সবার সামনে এই ভাবে মহাদেবের মুখে কালিকা শুনে দেবী পার্বতী অপমানিত বোধ করেন। মনে মনে ভাবেন তাঁর কালো গায়ের রঙ নিয়ে দেবতাদের সামনে তাঁকে এইভাবে অপমান করা হলো। অভিমানে একাই তিনি মানস সরোবর এর তীরে চলে গেলেন। শুরু করলেন সাধনা। কঠোর সাধনা।
কঠোর তপস্যার বলে দেবীর শরীর হয়ে উঠলো উষ্ণ। তারপর একদিন তপস্যার শেষে দেবী মহামায়া চোখ মেললেন। স্নান করতে নামলেন তিনি মানস সরোবরের বরফ ঠাণ্ডা জলে। স্নান করে নিজের দেহের সব কালো কোষ ঝরিয়ে ফেললেন দেবী। দেখতে দেখতে তিনি পূর্ণিমার চাঁদের মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠলেন। তাঁর সারা শরীরে দেখা গেলো এক নতুন রূপ।
আর দেবীর শরীর থেকে ঝরে পড়া ওই কালো কোষগুলো থেকেই জন্ম নিলো আর এক দেবী। সে দেবীর গায়ের রঙ অমাবস্যার মত কালো। এই দেবী পার্বতীর শরীরের ঝরা কোষ থেকে জন্মেছেন। তাই তিনি কুমারী আর অযোনিসম্ভূতা। মহামায়ার এই নতুন কালো রূপ হলো দেবী কৌশিকী। যিনি ঔদ্ধত্য আর সেই অহংকারের প্রতীক দুই দানব শুম্ভ আর নিশুম্ভকে হত্যা করেন।
আজ হলো সেই কৌশিকী অমাবস্যার রাত। যে রাতে স্বর্গের দুয়ার খুলে যায়। আর নরকের দুয়ারও খুলে যায় এক সাথেই। আমাদের জীবনের ঔদ্ধত্য, অহংকার, দম্ভ ,পরাক্রম, এই সব কিছুকে তুচ্ছ করে ত্যাগ করে মা কৌশিকীর কাছে একটাই প্রার্থনা। মা, তুমি আমায় এই সব কিছু থেকে মুক্ত করো।
আমি যেনো এই অন্ধকার রাতে তোমার এই রূপের আলোয় নিজেকে আলোকিত করতে পারি। আমার ভিতরের অসুরকে বধ করতে পারি। নিজের সব দানবিক, আসুরিক শক্তিকে প্রতিহত করতে পারি নিজের শক্তি দিয়ে। ভালবাসতে পারি সবাইকে। সবাইকে কাছে টেনে নিয়ে বাঁচতে পারি একসাথে। এই কৌশিকী অমাবস্যার অন্ধকার রাতের আলোয় যেনো তোমার ওই জ্যোতির্ময় রূপের ছটায় আমার সেই চৈতন্যের উদয় হয়। মা, মাগো আমায় এই শক্তিটুকু দাও মা। আর কিছুই চাই না আমি তোমার কাছে।
কৌশিকী অমাবস্যার রাত - অভিজিৎ বসু।
দোসরা সেপ্টেম্বর, দু হাজার চব্বিশ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন