আজ আকাশটা যেনো বড্ড ভারী ভারী লাগছে আমার। বাতাস কেমন যেনো ফিশ ফিশ করে বলছে না, না, আমি কিছুতেই বলতে পারবো না। জানলার ধারে ওই আশশ্যাওড়া গাছটা কেমন রাতের অন্ধকারে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে একা একা,একদম একা মন খারাপ করে। আসলে কেমন যেনো একটা অচেনা ভাব চারিদিকে। নীল আকাশ পথে দিগন্ত রেখা ধরে উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়ানো শঙ্খচিল এর দল কেমন যেন দুর থেকে দেখতেই পাচ্ছে না সেই চিরচেনা সবুজ গ্রামের জলছবির সেই মন ভালো করা দৃশ্য। সেই যে কবির লেখা সেই লাইন।
বাদলের ধারা ঝরে ঝরঝর,
আউশের ক্ষেত জলে ভরভর।
সেই যে মাঠ, ঘাট, ক্ষেত, খামার পেরিয়ে বাতাসে কেমন যেনো সোঁদা শালুক ফুলের গন্ধ, আর সেই ফুলের ওপর কালো হলুদ ছাপ প্রজাপতির ডানায় লেগে যেতো পূজোর রামধনুর ছোপ ছোপ রং। ইতি উতি হাসি মুখে ঘুরে বেড়ানো প্রজাপতির ডানায় ভর করে কেমন করে যেন রঙিন হয়ে ওঠা প্রকৃতি হঠাৎ করেই বদলে যেতো এই সময়ে। ঠিক যেনো নতুন করে প্রেমে পরা অষ্টাদশী কন্যার মতই। আর পচা ভাদ্রের শেষে কেমন করে যেনো বলে ওঠা।
এসেছে শরৎ হিমের পরশ।
সত্যিই তো শরৎ আসছে। বছরের এই একটা ঋতু কত কিছুই যে নিয়ে আসে আমাদের জীবনে। শরৎ মানেই উজ্জ্বল নীল আকাশ, রাস্তার ধারে কাশ ফুলের মাথা দুলিয়ে হাসি মাখা মুখে দাঁড়িয়ে থাকা কারুর প্রতীক্ষায়, সেই মাঠ পেরিয়ে, কাশ ফুলের ঝোপ ঝাড় পেরিয়ে দৌড়ে এসে দুগ্গা দালানে খড় জড়ানো মূর্তির কাছে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকা, আর খড় এর গন্ধ আর মাটির সোঁদা গন্ধকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে সন্ধ্যা হলেই ঘরে ফিরে আসা।
এইভাবেই যে একটু একটু করে খড়,মাটি, তুলি, রং মিলিয়ে তৈরি হয় আমাদের ঘরের মেয়ে উমার চার দিনের এমন ভরা সংসার। যে সংসারের ডাকে সব ফেলে কেমন হাসি মুখে ছুটে আসেন মা উমা স্বর্গ ছেড়ে মর্ত্যে। আর আমরা তাঁর আসার প্রতীক্ষায় দিন গুনি বছরভর। যে প্রতীক্ষা নিয়ে একবুক ভালোবাসা নিয়ে ঘরে ফেরে দুর দেশ থেকে বাবা কাজ করে, যে প্রতীক্ষা নতুন করে কাছের জনকে কাছে পাবার প্রতীক্ষা, যে প্রতীক্ষা নতুন জামার গন্ধে লুকিয়ে থাকে একরাশ ভালোবাসার স্পর্শ। যে প্রতীক্ষা সেই পূজোর অষ্টমীর অঞ্জলীর দিন পাশের গ্রামের মেয়ের দীঘল চোখের কাতর ভালোবাসার চাউনির মন কেমন করা প্রতীক্ষা। সব প্রতীক্ষা যে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় এই পূজোর সময়।
তারপর দেখতে দেখতে প্রতীক্ষার অবসান হয়। মা আসেন, দুগ্গা দালানে আতপ চাল দিয়ে আলপনা দেওয়া হয়। আলপনার গন্ধ আর ধূপের ধুনোর গন্ধ মিলেমিশে কেমন একাকার হয়ে যায়। আসলে জীবন বোধহয় এমনই। মিলেমিশে একাকার হয়ে যাওয়া। ছোটবেলার সাথে বড়বেলার, বড়বেলার সাথে বুড়োবেলার। কে জানে কেনো এমন হয়। তবু সেই ছোটোবেলার পূজো আসার গন্ধ কেমন যেনো মন খারাপ করিয়ে দেয় এই বুড়ো বয়সেও আমায়। মনে হয় বেশ ভালই ছিল সেই ফেলে আসা দিনগুলো।
এই বুড়ো বয়সেও এসেছে শরৎ হিমের পরশ। তবু কেমন যেন সেই শরতের নীল আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা আজ। মেঘের চূড়োয় সূর্যের লাল আলোর স্পর্শ কেমন যেনো অচেনা লাগছে আমার। মনের ভার কাটিয়ে কিছুতেই ঘাড় ঘুরিয়ে আকাশ দেখে মন ভালো হচ্ছে না আর কিছুতেই কেনো কে জানে। আকাশে বাতাসে কেমন যেন একটা মন খারাপের মেঘ উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে চারিদিকে।
সেই যে তার পুরোনো বহুদিনের সঙ্গীকে না পেয়ে মন খারাপ নিয়ে আর একবুক অভিমান নিয়ে যে নিম গাছের ডালে লুকিয়ে বসে থাকা বুলবুলির দেখা পেয়ে মন ভালো হয়ে যেতো আমার তারও দেখা পাইনা আমি বহুদিন আজ এই বুড়ো বয়সে। আর সেই নিজের গায়ে, ডানায় পূজোর গন্ধ মেখে প্রজাপতি যে উড়ে উড়ে বেড়াতো এদিক ওদিক খুশি মনে সেও কোথায় যে চলে গেছে কে জানে। আসলে মন খারাপের তো তেমন কোনো সংজ্ঞা হয় না। আবার মন ভালো রাখার কোনো উপায় নেই যে। এটাই হলো আসল কথা।
বাড়ির কাছে রাস্তার পাশে দুর্গা মন্দিরে কেমন যেনো মন খারাপ নিয়েই খড়ের ওপর মাটির প্রলেপ পড়ছে ধীরে সুস্থে, কিছুটা শ্লথ গতিতে। শুকনো খড়ের গন্ধে ঘুমিয়ে নেই পূজোর মাতাল করা গন্ধ। খড়ের খস খস করা আওয়াজ কেমন করে যেনো রাতের নিস্তব্ধ গ্যালাক্সিতে আছড়ে পড়ছে চুপি চুপি। দূরে ওই দূরে অনেক দূরে পাহাড় ঘেরা দেশে শুনেছি যেখানে উমা থাকেন সেখানেও কেমন যেনো ছন্দহীন গতি। কোনো তাড়াহুড়ো নেই, কোনো আনন্দ নেই, কোনো উৎসবের মেজাজ নেই। রাস্তা দিয়ে টোটো করে মাইকে ঘোষণা হচ্ছে পূজোর কেনাকাটার জন্য বিশেষ ছাড় এর সগর্ব ঘোষণা। কানে কেমন বেসুরো লাগে।
কেমন যেন একটা ছন্দহীন জীবনের ছন্দপতনের শব্দ চারিদিকে। উৎসবের আমেজে ঢাকের কাঠিতে নতুন করে আনন্দের বাদ্যির সেই মন ভালো করা ঢ্যাঙ কুড় কুড় ঢাকের বাদ্যির সুর নেই। আসলে এত নেই এর মাঝে মা আসছেন। জানি না সব কিছু ভুলে আমরা আনন্দের জোয়ারে আবার ভেসে যেতে পারবো কি না। জানি না সেই ছোটো বেলার পুজো আসার আগে থাকতেই তো কত কিছুই যে বদলে যেত কিন্তু এই বুড়ো বেলার মত নয় বোধ হয়।
আজ যে সে সব কিছুই দেখতে পাইনা আর আমি। হয়তো আছে লুকিয়ে আছে, বদলে গেছি শুধুই আমি। বদলে গেছে আমার দৃষ্টি। বদলে গেছে আমার জীবনের স্পন্দন। বদলে গেছে আমার আনন্দের সংজ্ঞা। বদলে গেছে আমার চারিপাশ। বদলে গেছে আমার ঘর,দুয়ার,বাহির, অন্তর সব কিছুই। যেখানে নেই পূজোর গন্ধ, যেখানে নেই ঢাকের বাদ্যি। সত্যিই বোধহয় আমার জীবন, জীবনের ভাবনা বদলে গেছে। পড়ে আছি আমি একা একদম এক।
বদলে যাওয়া জীবন - অভিজিৎ বসু।
বারো সেপ্টেম্বর, দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্য ফেসবুক।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন