আমার সাদা জীবনের কালো কথায় আমি বহুদিন ধরেই ভেবেছি উৎপলদার কথা কিছু লিখবো। যদিও কি লিখবো, কেনো লিখবো সেটা আমি জানি না। একজন বিখ্যাত খেলার মাঠের সাংবাদিক এর সাথে আমার তেমন কিছু ভালো কাজের সম্পর্ক তো নয় তবু কেনো জানিনা মনের মাঝে লেখার একটা তাড়না অনুভব করেছি আমি বহুদিন ধরেই। আর তাই সেই উৎপল পট্টনায়ক খেলার মাঠের এই সাংবাদিককে নিয়ে কিছু কথা লেখার চেষ্টা করা আর কি আমার এই আঁকিবুঁকি ব্লগে আমার সাদা জীবনের কালো কথায়।
কিছু কিছু মানুষ আছেন যারা একটু গুটিয়ে থাকেন। হৈ চৈ করে হুল্লোড় করে নিজের ঢাক নিজে পিটিয়ে বাঁচতে জানে না একদম। তেমনি একজন বহু পুরোনো সাংবাদিক এই উৎপলদা। কলকাতার খেলার মাঠের মাঝে ঘুরে বেড়ানো বহু দিনের চেনা মুখ এর এক সাংবাদিক। ইটিভির আগে থেকেই আমার সাথে আলাপ উৎপলদার। বোধ হয় সেই পট পরিবর্তনের কাগজের সময় থেকেই। গ্রাম থেকে কাকদ্বীপ থেকে কলকাতার সেই শিয়ালদহ স্টেশনের কাছে ট্রাম লাইনের পাশে এক মেস বাড়িতে দিন কাটানোর দিন থেকেই আমাদের বন্ধুত্ব দুজনের।
মাঝে মাঝেই রাস্তায় সাংবাদিক হবো বলে ঘুরতে ঘুরতে বিকেল বেলায় চলে যেতাম উৎপলদার সেই মহাত্মা গান্ধী রোডের ওপর পূরবী সিনেমা হলের কাছে পুরোনো সেই মেস বাড়িতে। সেই মেস এর অন্ধকার সিঁড়ি, ভেজা বারান্দা পার হয়ে উৎপলদার ঘরে একতলার ওপরে। একমুখ হেসে বলতেন এসো এসো অভিজিৎ। রাস্তা থেকে উৎপল দা গরম চা, মুড়ি চানাচুর কোনো দিন সিঙ্গারা এনে খেতে দিত আমায়। দুজনে মিলে মজা করে একসাথে খেতাম সেই মুড়ি আর চা। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত দুজনের গল্প হতো কি করবো ভবিষ্যতে তার পরিকল্পনা হতো। সেই কবেকার কথা এসব হয়তো উনিশশো আটানব্বই সাল হবে। প্রায় আজ থেকে পঁচিশ ছাব্বিশ বছর আগের কথা।
শহর কলকাতার রাস্তা ঘাট তার চিহ্ন একদম আলাদা ছিল সেই সময়। চা মুড়ি খেতে খেতে ট্রামের ঘণ্টার আওয়াজ শুনতাম মেসের ঘরে বসে। দূরে সন্ধ্যার শঙ্খ বাজত কোথাও কোনো বাড়ী থেকে। আমি বলতাম চলি এইবার বলেও আবার কেমন গল্প মসগুল হয়ে যেতাম দুজনে। আসলে সেই গ্রাম থেকে আসা একজন সাংবাদিক কলকাতার খেলার মাঠে দৌড়ে বেড়াবার স্বপ্ন দেখছে সেই সময়। যাইহোক এরপর ইটিভির চাকরি হলো দুজনের। উৎপল দা কলকাতায় আর আমি জেলায়। কিন্তু আমাদের দুজনের যোগাযোগ আর সেই মেস বাড়ির বন্ধুত্ব রয়ে গেছে আমাদের। বোধহয় এর একটাই কারণ দুজনেই সিঁড়ি ধরে একে অপরকে ঠেলে ফেলে দিয়ে অনেকটা ওপরে উঠে যাইনি।
জীবন ভালই চলছিল আমাদের দুজনের। সংসার হলো উৎপলদার। বৌদি সরকারি হাসপাতালের নার্স ছিলেন। কিন্তু এইসবের মাঝে অঘটন এলো উৎপল দার জীবনে। সুখের জীবনে সুখের সংসারে বৌদি অসুস্থ হলেন। বৌদি চলে গেলেন। এক ছেলেকে নিয়ে একদম বেসামাল অবস্থা হলো। তবু কোনো দিন হাসি মাখা মুখটা ভুলে যেতে দেখিনি আমরা কেউই। থাক সেসব কথা আজ। বহুদিনের পুরোনো কথা বলে কি হবে আজ।
ছবিতে মাঝে মাঝেই দেখি উৎপলদার ছেলে বড় হয়েছে। বেশ ভালো লাগে আমার। মাঝে মাঝেই আমায় ফোনে বলে অভিজিৎ চলে এসো আমার গ্রামের বাড়িতে কাকদ্বীপ। দুজনে সাইকেল করে ঘুরবো একসাথে নদীর ধারে তুমি যেমন বোলপুরে ঘুরে বেড়াও। মনে হয় হ্যাঁ বেকার জীবনে ঘুরতে তো ভালই লাগে যে। নদীর পাড় ঘেঁষে সাইকেল নিয়ে সেই পুরোনো জীবনে ফিরে যাব আবার গল্প করব,ফেলে আসা জীবনের স্মৃতিচারণ করব বেশ মজাই হবে।
আমার মনে আছে উৎপলদার ভাই এর বিয়ের পাত্র দেখতে সবাই এলো আমার শ্রীরামপুরের ফ্ল্যাটে দুই পরিবারের লোকজন। কত মজা হলো পাত্র এলো, পাত্রী এলো বেশ মজার ব্যাপার আজও মনে পড়ে আমার সেই দিন এর কথা। কাজের ক্ষেত্রে এমন বহু পুরোনো বন্ধুর সাথেই যোগাযোগ হয় সেটা তো কিছুটা ক্লিশে হয়ে যায় ধীরে ধীরে যেমন সেই দিব্যেন্দুর কথা। কত বন্ধুত্ব ছিল আমাদের দুজনের। সাদা বাড়ির চাকরির পরেও বন্ধুত্ব ছিল কিন্তু কবে যে সেই সম্পর্কে মেদ জমে গেলো কে জানে। থাক সেই গল্প আর একদিন হবে না হয়।
কিন্তু উৎপলদা আর আমার সেই ফেলে আসা মেস বাড়ির বন্ধুত্ব,মেঠো সম্পর্ক আজও কেমন করে রয়ে গেছে যে কে জানে। চব্বিশ ঘন্টা চ্যানেলে কাজ ছেড়ে দিয়ে বসে থাকার সময় কাজ নেই আমার সেই সময় রাজভবনের কাছে এক চ্যানেলের অফিসে ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে দেখা হলো উৎপলদার সাথে আমার। সেই এক মুখ হেসে অভিজিৎ ভালো আছো তুমি। যদিও খবরটা চুপি চুপি আমায় উৎপলদাই দিয়েছিল যোগাযোগ করো লোক নেবে আমাদের এইখানে। কাজটা হয়নি আমার কিন্তু খবরটা দিয়েছিল আমায়। সেটাই বা আজকাল কে খবর দেয় কাজের।
আসলে কিছু কিছু সম্পর্ক, কিছু মানুষ বোধহয় এমনি হয়। জীবনের মাঝে কেমন করে যে লেগে থাকে বহুদিন আর বহু বছর ধরে কে জানে। মাঝে মাঝেই ফোন করে ফেলি আমি হঠাৎ করেই। কি খবর গো তোমার। বাড়ির গাছ থেকে ফল,সবজি পাড়ার ছবি দেখে উত্তেজিত হয়ে যাই আমি। আর সেই সব দেখে শুনে বলি বাহ সুন্দর জীবন কাটাচ্ছ তুমি। জীবনের চলার পথে এমন কিছু ভেজা বালির রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো মানুষকে কিছুতেই ভুলতে পারিনা আমি।
দুজন দুজনকে বলি তুমি বোলপুর এসো। আর একজন বলে তুমি কাকদ্বীপ এসো। যাওয়া হয়না আমাদের কারুর কোথাও কিন্তু সম্পর্ক টিকে যায়। কেমন অজানা অচেনা এক রসায়নে। সেই সম্পর্কে দেওয়া নেওয়া নেই। কোনো হিসেব নিকেষ নেই। শুধু সেই পুরোনো মেস বাড়ির গন্ধ, ট্রামের ঘণ্টার আওয়াজ,মুড়ি চানাচুর এর গন্ধ, সন্ধার শঙ্খের আওয়াজ মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। যে গন্ধ আজ দীর্ঘ পঁচিশ বছর পরেও কেমন অমলিন হয়ে বেঁচে আছে আমার বুকের মাঝে।
উৎপল দা ও আমি - অভিজিৎ বসু।
বারো সেপ্টেম্বর, দু হাজার চব্বিশ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন