সাদা জীবনের কালো কথায় আজ শুধুই কিছু ব্লক কলের কথা। জীবনের এই নানা ওঠা আর নামা, জীবনের চলার পথে নানা মানুষের সাথে আলাপ হওয়া, সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া আবার সেই সম্পর্কের অবনতি হওয়া, কাউকে কাছে টেনে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরা আবার কাউকে দূরে সরিয়ে দিয়ে হাফ ছেড়ে একা একা বাঁচার চেষ্টা করা। আর এসবের মাঝেই কেমন করে যে আমার জীবনের দীর্ঘ পথে জুড়ে গেছে এই ব্লক কলের দীর্ঘ তালিকা কে জানে। ঠিক যেনো দেওয়াল বেয়ে সারি দিয়ে উঠে যাওয়া পিঁপড়ের সারির মতই, দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে ব্লক কলের তালিকা ক্রমেই।
বয়স বাড়ছে, অভিজ্ঞতা বাড়ছে, জীবনের সাদা আর কালোর রূপরেখার প্রাসঙ্গিকতা বাড়ছে। আমার পছন্দ আর অপছন্দের তালিকায় ঢুকে পড়ছে নানা ধরনের, নানা রকমের লোকজন ঠিক বেনোজলের মতই। আর তাদের হাত ধরেই কেমন করে যে ব্লক কলের পুতুলের হাতে নিজের জীবনকে সঁপে দিয়েছি সেটা নিজেই জানি না আমি। আসলে আজকাল এই শুধুই দেওয়া আর নেওয়ার যুগে, একদলের ওপরে উঠে যাওয়া আর অন্যদলের এক পাশে দাঁড়িয়ে পড়ে পড়ে মার খাওয়া আর দাঁড়িয়ে থাকা সম্পর্কের মাঝে আচমকাই কেমন করে যে দেওয়াল উঠে যায় নিজে নিজেই কে জানে।ঠিক যেনো চীনের প্রাচীরের মতই।
এই যার সাথে গলায় গলায় ভাব ভালোবাসার নিগূঢ় বাঁধনের সম্পর্ক, একটু স্বার্থের কারণেই সেই সুন্দর সম্পর্কের কাঁচের বয়ামে ঢিল মেরে ফাটিয়ে দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করা। আর যে কোনোভাবে সেই সম্পর্কের সরু সুতোয় যাতে টান না পড়ে তার জন্য যে কোনো উপায়ে তাকে ছিন্ন করে দিয়ে ব্লক করে দেওয়া। যাতে আর যোগাযোগ না হয় কোনোদিন একে অপরের সাথে কোনো ভাবেই। কোন ভাবেই আর বাক্যালাপ না হয়। চলে তীব্র স্নায়ুর যুদ্ধ অবিরাম দুপক্ষের মধ্যে। সরকার পক্ষ আর আন্দোলনরত চিকিৎসক পক্ষের মতই। কে জিতবে আর কে হারবে চলে সেই কঠিন পরীক্ষাও। কিন্তু কেউ যে হারতে চায়না জীবন যুদ্ধে। সাথে সাথে ব্লক কলের যুদ্ধেও।
এক বছর আগেও রাতের বেলায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা যার সাথে জীবনের নানা কথা আলোচনা করতাম। কি করে বাতিল হয়েও মাঠে ফেরা যায় আলোচনা করতাম একে ওপরে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত দুজনে মিলে। চোখে চোখ রাখা সাংবাদিকতা করা চ্যানেলে কাজ করার পর সেটা ছেড়ে দিয়ে অন্য কাজের সুযোগ সন্ধানে সে যখন ঘুরে বেড়ালো এদিক থেকে ওদিক। তার মন খারাপ এর একটা দিনে একসাথে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে আকাশ দেখলাম দুজনে সেই শান্তিনিকেতনের আমার ভাড়া বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে, মা কঙ্কালীতলার মন্দিরে পূজো দিলাম একসাথে সন্ধ্যাবেলায়, আর সন্ধ্যার অন্ধকারে সোনাঝুড়ির জঙ্গলে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক শুনলাম আমরা দুজন এক হয়ে একসাথে, এক পথে।
তারপর একদিন মা কঙ্কালী সত্যিই মুখ তুলে দেখলেন বাতিল হয়েও কাজ জুটে গেলো আমাদের দুজনের। ঝাঁপিয়ে পড়লাম আমরা কাজের নেশায়। দৌড়ে, ছুটে বেড়িয়ে নেশায় বুঁদ হয়ে পড়লাম আমরা সবাই। কিন্তু সেই দীর্ঘ কুড়ি বছরের সম্পর্কও যে কি করে ক্লিশে হয়ে গেল, দূরে চলে গেলো, অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কেমন করে ব্লক লিস্টে চলে গেলো সেই সম্পর্কের গভীর বন্ধন কে জানে।
মাঝে মাঝে মোবাইলের স্ক্রীনে হাত বুলিয়ে দেখি আমি আর ভাবি, এই বোধহয় সব কিছু ভেঙে সেই ঝড়ের রাতের মতো যে রাতে শুধু আমরা দুজন রাত জেগেছিলাম একা একা গোটা অফিসে। সেই রাতের মতই একদিন সব কিছু ভেঙে যাবে। ফিরে আসবে আবার সেই আগের পুরোনো বন্ধুত্বের সম্পর্কের শিকড়ের টানের সেই ফোন অভিজিৎ কি করছ তুমি। রান্না হলো,খাওয়া হলো তোমার। জানি আমি ব্লক লিস্টের দেওয়াল ভেদ করে, সম্পর্কের ইগো আর অভিমান ভেদ করে কেউ আর কোনো দিন আমরা দেওয়াল ঘেঁসে চুপি চুপি উঠে একে অপরকে ডাকতে পারবো না কোনোদিনই কেউ কাউকে আর।
আসলে ব্লক কলের এই হলো মাহাত্ম্য। গভীর গোপন মনের ইচ্ছাকে অবদমিত করে কিছুতেই যে দেওয়াল ভেদ করে সম্পর্কের কথা মাথায় রেখে আর ইগো কাটিয়ে এগিয়ে আসা যায় না আর কিছুতেই। ঠিক প্রথম প্রেমের ভালবাসার দিনে একে অপরের কাছে আসার মতই। এটাই যে তার একমাত্র কাজ দূরে সরিয়ে রাখা। রক্ত,মাংসের গন্ধ মাখা জীবন এর নিনঢ় বাঁধন নয় শুধুই একটা মোবাইলের স্ক্রীনে ছোট্ট একটা চিহ্ন। যে চিহ্ন সারাজীবনের মতই দুজনের মাঝে যতি চিহ্নের মত বেঁচে থাকে।
এই ভাবেই যখন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে রাতের অন্ধকারে আমার মোবাইলটা দেখি নিজের আত্মার বন্ধনের, যোগযোগ এর নানা নাম আর নম্বর দেখি কত যে এমন সব নম্বর ব্লক হয়ে পড়ে আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে এদিক ওদিক কে জানে। সেই তালিকায় দাপুটে সব নানান মাপের নানা ধরনের সাংবাদিক, দাপুটে সব বাংলার বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের জনপ্রিয় সঞ্চালক বা সঞ্চালিকা, দাপুটে সেই ডবল প্রমোশন পাওয়া সিনিয়র এডিটর যার হাতের মুঠোয় গোটা বাংলা আর গোটা জেলা যার কথায় ওঠে আর বসে।যার কথায় দিন হয় রাত হয়। যে আমায় রাত দুটো পর্যন্ত বসিয়ে রেখে জেলার স্ট্রিংগার এর কাজের কথা বলেও কোনো ইন্টারভিউ না নিয়েই বলে দেয় ইন্টারভিউ হয়ে গেছে।
আর যে সেই সাত সকাল বেলায় সুদূর ট্রেন পথে অফিস এসে সবাইকে জানিয়ে দেয় সে এসে গেছে আর কোনো চিন্তা নেই কারুর। মর্নিং টিআরপি যে একমাত্র তার হাতেই,যতই সে অবসর নিক। তাঁকে ছাড়া কি আর চ্যানেল চলে কোনো ভাবে। বাংলা মিডিয়াতে যে যাই বলুক তাঁর নামে তিনি যে অপরিহার্য উপাদান হয়েই বেঁচে থাকবেন বাংলা মিডিয়াতে সারাজীবন ধরেই এইভাবেই সকাল আটটা আর পাঁচটার ডিউটি করেই।
আবার সেই বিখ্যাত মাতব্বর সাংবাদিক মানুষ যাঁর গলার গান শুনে মোহিত হতো অফিসের সবাই। যে গোটা অফিসকে মাতিয়ে রাখতো শুধুই নিজের মেধা আর বুদ্ধি দিয়ে। অফিসের বস ঘরে এলেই যে সবার আগে ঘরে ঢোকার চেষ্টা করে যেতো প্রাণপণে। আর তাকে ডিঙিয়ে অন্য কেউ বস এর ঘরে ঢুকে পড়লে বলে দিত কিরে কিডনি,হার্ট তোরা সব লাইন দিয়ে বস এর ঘরের সামনে হত্যে দিয়ে পড়ে আছিস যে সর সর আমায় যেতে দি অনেক নিজের কথা বলেছিস তোরা।
যার সাথে একসাথে মুড়ি খেতে যাওয়া, রাতের বেলায় সেই বাসের জন্য অপেক্ষা করা বৃষ্টি ভেজা রাতে ছাতা হাতে তার পাশে পাশে। সেই যে দৌড়ে দৌড়ে পেয়ারা, পাকা পেঁপে বা কলা এনে দিয়ে বন্ধুত্বের সম্পর্ক কে আরও মজবুত করার চেষ্টা করা। সেই সম্পর্ক যে মজবুত করতে পারিনি কিছুতেই। আর সেই যে বাংলার দাপুটে সঞ্চালিকার কথা, দাদার আমলে যা হয়েছে ভুলে যাও এই কথা শুনে অফিস ছেড়ে চলে এসে টোটো চালকের কথা বলে ঘুরে বেড়ানো পাঁচ বছর ধরে। আর সেই যে মাত্র দু মিনিট গেস্ট লিস্ট দিতে দেরি হবার জন্য এক বিখ্যাত সঞ্চালিকার বিখ্যাত কঠিন কঠোর উক্তি শোনা। এদের বাড়ির কাজের লোকের কাজ করার খুব শখ হয়েছিল সেদিন আমার।
কিন্তু সেই সব সম্পর্ক যে কেমন করে কালো তালিকায় চলে যায় আর কিভাবে যায় কে জানে। যাদের এক সময়ে আমি নিজেই বলেছিলাম একান্তে আমার মেয়ের জন্য কাজটা করতে হবে আমায়। আমার খুব দরকার এই কাজের জীবন। কিন্তু না কেউ তারা সেদিন সেই কথা শুনতে পাননি কিছুতেই। বহুদিনের সেই গান গাওয়া মাতব্বর সাংবাদিক বন্ধু, সেই দীর্ঘ কুড়ি বছরের পুরোনো চেনা জানা বন্ধু মানুষ হয়েও কেমন যেন অচেনা আর অজানা হয়ে গেলো তারা। কেমন করে যেনো দুজনেই খুব পরিচিত দুজন কেমন করে লুকিয়ে পড়লো, গা ঢাকা দিলো তারা সেই সন্ধ্যায় পথের বাঁকে। শুধু কিছু প্রাপ্তির জন্য দূরে সরে গেলো তারা।
এই ভাবেই যে কত মানুষ ব্লক কলের তালিকায় চলে আসে এই একটা জীবনে কে জানে। সেই যে এক সময়ের সাংবাদিক পরে যিনি বিখ্যাত ব্যবসায়ী হয়ে যান সেই দিদি। আবার সেই যে এক সময়ের বিদেশের আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থায় কাজ করা এক বিখ্যাত সাংবাদিক যিনি নিজের কাজ মিটে যাওয়ার পর নিজেই কিছুদিন আগে আমায় ফোন করে জানিয়ে ব্লক করে দেন। যাদের জন্য যাদের কথা আমার এই সাদা জীবনের কালো কথায় আমার লিখতে ইচ্ছা হয় রাতের বেলায়। মাঝে মাঝেই মনে হয় আবার ফিরে যাই আমরা সব কিছু ভেঙে চুরমার করে সেই ফেলে আসা পুরোনো হাসি মাখা জীবনে। যে জীবনে কোনো দেওয়াল ছিল না, কোনো স্বার্থপরতা ছিল না, কোনো বাধা ছিল না, কোনো অভিমান, রাগ, ইগো কিছুই ছিল না।
শুধু গভীর গোপন ভালোবাসার সম্পর্কের সরু সুতোয় বেজে উঠতো কখনও রাগ ভৈরব, কখনও রাগ ইমন, আবার কোনো সময় মেঘমল্লার। যার ঝংকারে ফেলে আসা ক্লিশে হয়ে যাওয়া ভেঙে যাওয়া সম্পর্ক গুলো কেমন সতেজ হয়ে যেতো প্রাণ ফিরে পেতো আবার। মোবাইলের স্ক্রীনে হাত বুলিয়ে দেখতাম না একটাও আর কালো দাগ নেই, কালো তালিকায় থাকা কোনো নম্বর নেই। সব মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে।
আমি পরম যত্নে পরম মমতায় মোবাইলের স্ক্রীনে হাত বুলিয়ে আদর করছি, আমি সেই অজানা অচেনা নম্বর গুলোকে এক মনে আদর করছি। ধীরে ধীরে একে একে সব নম্বর গুলো থেকে ভেসে উঠছে সেই পরিচিত চেনা মুখ, চেনা হাসি, চেনা কন্ঠ স্বর। আমি কেমন একদৃষ্টিতে রাতের নিকষ কালো অন্ধকারে তাকিয়ে আছি আমার মোবাইলের স্ক্রীনের দিকে। আমার চোখের পাতা পড়ছে না কিছুতেই। ভারী হয়ে আসছে আমার দু চোখের কোল।
ব্লক কল - অভিজিৎ বসু।
চোদ্দ সেপ্টেম্বর, দু হাজার চব্বিশ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন