আমি সমস্তই দেখিলাম, সমস্ত বুঝিলাম। যে গোপনেই আসিয়াছিল তাকে গোপনেই যাইতে দিলাম। কিন্তু এই নির্জন নিশীথে সে যে তাহার কতখানি আমার কাছে ফেলিয়া রাখিয়া গেল তাহা কিছুই জানিতে পারিল না।
শ্রীকান্ত উপন্যাসের সেই বিখ্যাত লাইন। সেই রাজলক্ষী আর শ্রীকান্তের গভীর গোপন ভালোবাসার মন দেওয়া নেওয়ার কথা। যা আমাদের কাছে বাংলা কথা সাহিত্যে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে চিরকাল।
হ্যাঁ আজ সেই কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর জন্মদিন। যাঁকে বাংলা সাহিত্যের অপরাজেয় কথাশিল্পী বলা হয়। হুগলী জেলার সেই ছোটো গ্রাম দেবানন্দপুরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি আঠারশো ছিয়াত্তর সালে। এক অতি গরীব পরিবারে তাঁর জন্ম হয়। অর্থের অভাবে যাঁর স্কুলের পড়া করা হয়নি একদিন। পরে যদিও তাঁর মামা পাঁচকড়ি বন্দোপাধ্যায় তাঁকে স্কুলে ভর্তি করে দেন ও তাঁকে পড়ার সুযোগ করে দেন। স্কুল তো পাশ করা হলো কোনোভাবে কিন্তু কলেজের গণ্ডী পার হবেন কি করে।
কিন্তু সেই সময় মনীন্দ্রনাথের মা কুসুমকামিনী দেবী নিজের দুই ছেলেকে টিউশন পড়াতে হবে এই বলে তাঁর কলেজের পড়ার প্রতি মাসের বেতন দেবার ব্যবস্থা করে দিলেন। কলেজ ভর্তি হতে পারলেন তিনি এইভাবেই। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রাতে মনীন্দ্রনাথের ছোটো দুই ভাই সুরেন্দ্রনাথ ও গিরীন্দ্রনাথকে পড়াতেন। সেই সময় তাঁর বই কেনার টাকাও ছিল না। বন্ধুর বই এনে রাতে সেই বই দেখে পড়ে পরদিন সেটা ফেরৎ দিতেন তিনি। আসলে সেই মানুষটাই একদিন লিখে ফেললেন বাংলা সাহিত্যের অমর সব কথা ও কাহিনী। যা আজও অবিস্মরণীয় হয়ে আছে।
তাই বোধহয় তিনি তাঁর কলমে লিখতে পেরেছিলেন, কোনো বড়ো ফলই বড়ো রকমের দুঃখ ভোগ ছাড়া পাওয়া যায় না। মন্দ তো ভালোর শত্রু নয়। ভালোর শত্রু হলো যে আরও ভালো সে। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবটাই পরিপূর্ণ সত্য। যাঁর জীবনের পুঁথিগত শিক্ষা গ্রহণ করতে গিয়ে প্রতি পদে বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে তাঁকে।সেই তিনিই এমন কথা লিখে গেলেন নিজের জীবন বোধের উপর দাঁড়িয়ে। তাঁর মতো দরদী মনের মানুষ পাওয়া ভার। অপরের দুঃখে তিনি কাতর হয়ে পড়েন অল্পেই। আর তাই তাঁর লেখায় পুরুষ শাসিত সমাজে মহিলাদের প্রতি তাঁর কলম গর্জে উঠেছে বারবার।
তাই তাঁর লেখা বড়দিদি, পরিণীতা, দেবদাস, চরিত্রহীন, শ্রীকান্ত, দত্তা, গৃহদাহ, পথের দাবী,শেষ প্রশ্ন তাঁর লেখা এইসব বিখ্যাত উপন্যাস আমাদের সবার কাছে পরিচিত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ঊনিশ শো তেইশ সালে জগতারিণী স্বর্ণপদক প্রদান করে। এছাড়াও তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিলিট উপাধি প্রদান করে। কলেজ জীবন শেষ করে তিনি ত্রিশ টাকার বেতনের একটা কাজ জোগাড় করেন। হিন্দি বইয়ের ইংরাজি তর্জমার কাজ। এই সময় উনিশশো বারো সালে যমুনা নামে একটি পত্রিকায় তাঁর লেখা বিখ্যাত গল্প রামের সুমতি প্রকাশ হয়।
কিছুদিন কর্মসূত্রে রেঙ্গুনে থাকলেও তাঁর সাথে কর্তৃপক্ষের মতান্তরের জন্য তিনি রেঙ্গুনের কাজ ছেড়ে চলে আসেন বাংলায় উনিশশো ষোল সালে। বার্মাতে রেলের টিকিট পরীক্ষকের কাজ করার সময় তিনি শান্তি দেবী বলে একজনকে বিবাহ করেন। পরে শান্তি দেবী ও তাঁদের এক বছরের সন্তান প্লেগ রোগে মারা যায় সেখানে। পরে তিনি মোক্ষদা বলে একজনকে বিবাহ করেন। যাঁর নাম রাখেন তিনি হিরণ্ময়ী দেবী। তারা নিঃসন্তান ছিলেন। পরে তিনি হাওড়া জেলার দেউলটি স্টেশন থেকে একটু দূরে রূপনারায়ণ নদীর তীরে সামতাবেড় গ্রামে বাস করতেন দীর্ঘ সময়।
উনিশশো আটাত্তর সালের বন্যায় সামতাবেড় গ্রামের সব বাড়ী ভেঙে গেলেও তাঁর বাড়িটি অক্ষত অবস্থায় ছিল।
শেষ বয়সে তাঁর যকৃতের ক্যান্সার ধরা পড়ে। স্বাস্থ্য উদ্ধারে তিনি দেওঘর যান হাওয়া বদলাতে। কিন্তু শরীর কিছুতেই ঠিক হয় না তাঁর। অবশেষে সকল বিখ্যাত চিকিৎসকের মত নিয়ে তাঁর অস্ত্রোপচার করা হয়। কিন্তু শেষরক্ষা হয়না কিছুতেই। উনিশশো আটত্রিশ সালের বারো জানুয়ারি তাঁর দেহে অস্ত্রপচার করেন বিখ্যাত শল্য চিকিৎসক ললিতমোহন বন্দোপাধ্যায়। কিন্তু মাত্র চারদিন পর ষোল জানুয়ারিতে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর চলে যাবার খবর শুনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতন এর আশ্রমে বসে ইউনাইটেড প্রেসের প্রতিনিধিকে বলেন, যিনি বাঙালির জীবনের আনন্দ ও বেদনাকে একান্ত সহানুভূতির দ্বারা চিত্রিত করেছেন, আধুনিক কালের সেই প্রিয়তম লেখকের মহাপ্রয়াণে দেশবাসীর সঙ্গে আমিও গভীর মর্মবেদনা অনুভব করছি।
আর তাঁর নিজের কলমে সেই কথাসাহিত্যিক তিনি লিখে গেছেন, কাল যে ছিল,আজ সে নাই; আজও যে ছিল, তাহারো ঐ নশ্বর দেহটা ধীরে ধীরে ভস্মসাৎ হইতেছে, আর তাহাকে চেনাই যায় না; অথচ, এই দেহটাকে আশ্রয় করিয়া কত আশা,কত আকাঙ্ক্ষা, কত ভয়,কত ভাবনাই না ছিল। কোথায় গেল? এক নিমিষে কোথায় অন্তর্হিত হইল? তবে কি তার দাম?মরিতেই বা কতক্ষন লাগে? এই ছিল মৃত্যু নিয়ে তাঁর নিজের অভিমত।
তাঁর লেখায় বার বার নারীর কথা উঠে এসেছে। তাই তিনি স্বরাজ সাধনায় নারী বইতে লেখেন, পৃথিবীতে কোন সংস্কারই কখনও দল বেঁধে হয় না! একাকীই দাঁড়াতে হয়। এর দুঃখ আছে। কিন্তু এই স্বেচ্ছাকৃত একাকীত্বের দুঃখ, একদিন সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে বহুর কল্যাণকর হয়। মেয়েকে যে মানুষ বলে নেয়, কেবল মেয়ে বলে, দায় বলে, ভার বলে নেয় না, সে-ই কেবল এর দুঃখ বইতে পারে, অপরে পারে না। আর কেবল নেওয়াই নয়, মেয়েমানুষকে মানুষ করার ভারও তারই উপরে এবং এইখানেই পিতৃত্বের সত্যকার গৌরব।
স্বরাজ সাধনায় নারী / শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
আজকের দিনে তাঁর এই লেখা যে বড়ই প্রাসঙ্গিক হয়ে ধরা পড়ে আমাদের সবার কাছে। বাংলা সাহিত্যের জগতে ছিনাথ বহুরূপীর মতই তিনি নানা রূপে বিরাজ করবেন আমাদের সবার কাছে। তাই তাঁর জন্মদিনে আমার এই আঁকিবুঁকি ব্লগে সাদা জীবনের কালো কথায় তাঁর জন্মদিনের শ্রদ্ধার্ঘ্য।
শরৎচন্দ্রের জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য - অভিজিৎ বসু।
পনেরো সেপ্টেম্বর, দু হাজার চব্বিশ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন