সাদা জীবনের কালো কথায় আজ একটা ডিভোর্সের কথা। যে ডিভোর্সের কথা ঘোষণা করলেন আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই। হ্যাঁ, এই কথা শুনতে কিছুটা অবাক হলেও ব্যাপারটা ঠিক তেমনি আর কি প্রায়। তাঁর কথায় যা শুরু হয়েছে, এইবার তিনি ডিভিসিকে ডিভোর্স দিয়ে দেবেন এইবার। অনেক বলা হয়েছে আর নয়। বার বার এই ভাবে ডিভিসি জল ছেড়ে যেভাবে রাজ্যকে বিপদে ফেলছে। ভাসিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে প্রতি বছর বছর এ ছাড়া আর যে কোনো পথ নেই তাঁর। তাই অনেক হয়েছে, অনেক বার চিঠি দিয়েছেন তিনি কিন্তু না কাজের কাজ কিছুই হয়নি যে।
তাই এরপর তিনি আর ডিভিসির সাথে কোনো সম্পর্কই রাখবেন না আর কোনোদিন। না, তার জন্য তার কোনো অনুশোচনাও থাকবে না আর তার কোনও। যারা এমন করে প্রতি বছর বর্ষা এলেই তাদের সাথে সম্পর্ক রাখার আর কি দরকার। বন্যা দুর্গত এলাকায় গিয়ে আজ এইভাবেই ডিভিসি কে একহাত নিলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একদম নিজের স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে তিনি জানালেন সংবাদ মাধ্যমের কাছে। এমনকি আমি বার বার ঝাড়খন্ড এর মুখ্যমন্ত্রীকে বলেও কোনো কাজ হয়নি যে। তাই তারাও এই বাংলাকে জল ছেড়ে ডুবিয়ে মারার চক্রান্তে সামিল ঠিক ওই কেন্দ্রের সরকারের মতই। তাই আগামী তিনদিন ঝাড়খণ্ড বর্ডার সিল করে দেওয়া হোক যাতে কোনো গাড়ি না আসতে পারে ঝাড়খণ্ড থেকে বাংলায় যাতে ডুবে না যায়।
এর বেশি আর কি বা করতে পারেন তিনি এছাড়া এই জল যন্ত্রণার হাত থেকে বাঁচতে। বাংলার মানুষকে বাঁচাতে চান তিনি সবসময়। তাঁর এই উদ্যোগের তুলনা হয় না যে। আসলে এইভাবেই জল ছাড়া নিয়ে রাজনীতি চলে প্রতি বছর। যাকে নিয়ে এত সমস্যা সেই যে বাংলার দুঃখ দামোদর নদীর কথা জেনে নিই আমরা একটু। যাকে এই নদীকে রাক্ষস বলা হতো এক সময়ে। চীনের যেমন হোয়াং হো নদী ঠিক তেমন বাংলার দামোদর নদী হলো দুঃখের কারণ।
যে নদী ঝাড়খণ্ড আর পশ্চিম বঙ্গ দিয়ে প্রবাহিত একটি নদী। ছোটোনাগপুর মালভূমির নিচু অংশ চুলপাহানি থেকেই সৃষ্টি হয়েছে এই নদীর। যা লাতেহার জেলায় অবস্থিত। প্রায় পাঁচশো বিরানব্বই কিলোমিটার দীর্ঘ এই দামোদর নদী। যার অববাহিকা অঞ্চল হলো প্রায় পঁচিশ হাজার বর্গ কিলোমিটার। দামোদর মানে হলো পেটের চারপাশে দড়ি। দাম সংস্কৃত শব্দ হলো দড়ি আর উদর হলো পেট থেকে উদ্ভূত। বৃষ্টিনির্ভর এই নদী ছোটোনাগপুরের খামারপাট পাহাড়ে উৎপন্ন হয়েছে এটি।
ছোটনাগপুর মালভূমিতে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ হলো প্রায় চৌদ্দশ মিমি। যা জুন মাস থেকে আগস্ট মাসের মধ্যে হয়। আর সেই বৃষ্টিতে পরিপূর্ণ নদীর জল বর্ধমান, হুগলী, মেদিনীপুর জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত করে দেয় প্রতিবার। যাকে আটকানোর কোনো ক্ষমতা নেই কারুর কোনো সরকারের। চুপ করে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার নেই কারুর। দামোদরের বন্যার ইতিহাস অনেক আছে। যে সব বন্যায় ভেসে গেছে সব কিছুই। 1770 সালের বন্যা প্রথম যা লেখা আছে ইতিহাসের পাতায়। এরপর বড়ো বন্যার মধ্য 1855, 1866, 1873-74,1875-76, 1900, 1978 সালের বন্যার জলে ভেসে যায় বহু গ্রাম। তবে দুশো বছরের বন্যার ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যাবে যে 1770,1855, 1913 আর 1943 সালের দামোদরের বন্যা হয় ভয়াবহ।
কিন্তু এই বাংলার দুঃখের নদীকে কি করে তার বন্যার জলের গতি আটকানো যাবে। তৈরি হলো দামোদর বন্যা তদন্ত কমিটি। এই কমিটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি ভ্যালি কর্তৃপক্ষের অনুরূপ একটি সংস্থা গঠনের সুপারিশ করে। এরপর একজন সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ারকে নিয়োগ করা হয়। তিনি 1944 সালে সমগ্র এই দামোদর নদী উপত্যকার বহুমুখী উন্নয়নের পরামর্শ দেন। 1948 সালে দেশ স্বাধীন হবার পরে তৈরি হলো স্বাধীন ভারতের প্রথম বহুমুখী নদী উপত্যকা প্রকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দামোদর উপত্যকা প্রকল্প এটি পরিচালনা করে। এই দামোদর নদী উপত্যকা প্রকল্পের প্রধান স্থপতি হলেন ভারতীয় জ্যোতিপদার্থবিদ মেঘনাদ সাহা। এই গোটা প্রকল্পের মূল পরিকল্পনা করেন তিনি।
সেই যাত্রা শুরু হলো ডিভিসির। যা একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা।1948 সালের সাত জুলাই এই সংস্থা তৈরি হয়। কেন্দ্রীয় সরকার এবং বিহার পরে যে ঝাড়খণ্ড হয় এতে অংশ নেয় ডিভিসি গঠিত হয়। যার সদর দফতর হয় কলকাতায়। যে সংস্থার প্রধান লক্ষ্য ছিল বন্যাকে নিয়ন্ত্রণ করা, সেচের জল সরবরাহ করা, বিদুৎ উৎপাদন করা। এছাড়াও এই দামোদর দিয়ে যাতে বছরভর নৌ চলাচল করে সেই পরিকল্পনা ছিল এই করপোরেশন এর । এই গোটা প্রকল্পে মোট আটটি বাঁধ নির্মাণ এর প্রস্তাব দেন ভুরদুইন। যদিও ডিভিসি মাত্র চারটি বাঁধ করে।
1947 সালের এপ্রিল মাসে এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন নিয়ে কেন্দ্র সরকার, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার এই তিনটি সরকারের মধ্যে কার্যত সম্পূর্ণ একটা চুক্তি হয়। 1948 সালের মার্চ মাসে দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন আইন কেন্দ্রীয় আইন সভা দ্বারা পাস করানো হয়। এই আইনে বলা হয় যে কেন্দ্র ও দুই রাজ্য সরকারকে এই কর্পোরেশন এর কাজে যৌথভাবে অংশগ্রহণ করতে হবে। সেই নিয়ম মেনেই চলছে ডিভিসির সব কাজ কর্ম যৌথ ভাবেই। এত গেলো ইতিহাস আর তার নানা কথা।মায়ের ডাকে যে দামোদরকে সাঁতরে পার হয়েছিলেন সেই ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর। সেই দামোদরকে বেঁধে ফেলা হলো এইভাবেই।
বৃষ্টির পরিমাণ বেড়ে গেলে জল বাড়লে দুই রাজ্যের সরকারকে আগাম জানিয়ে জল ছেড়ে দেয় ডিভিসি সেই যৌথ চুক্তি মেনেই। আর সেই জল ছাড়ার আগাম হিসেব জানিয়ে দেওয়া হয় দুই রাজ্যের সরকারকে সরকারি নিয়ম মেনেই। ঝাড়খন্ড ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সরকারকে। তাহলে জল ছাড়া নিয়ে এত গোঁসা কেনো ঝাড়খণ্ড সরকার এর উপরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এর। তাদের এই জল ছাড়াতে তো কোনো হাত নেই। বৃষ্টির পরিমাণ বাড়লে জলাধার উপচে গেলেই জল ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় ডিভিসি। কারণ একটাই না হলে যে ভেসে যাবে বিস্তীর্ণ এলাকা। তাই নিয়ম মেনেই জল ছাড়তে হয় তাদের।
আর যা নিয়ে ডিভিসির সাথে সমস্ত সম্পর্ক কেটে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু বাস্তবে সত্যিই কি সেটা সম্ভব। যে সম্পর্ক দেশের স্বাধীনতার পরেই তৈরি হয়েছিল নিয়ম মেনে আইন মেনে। সেই এতদিনের সম্পর্ক কে কেটে দেবেন কি করে তিনি। যে যৌথ চুক্তি মেনেই কাজ করে চলেছে এতদিন ধরে ডিভিসি। তাহলে তো কলকাতা থেকে তার সদর দফতরকে সরিয়ে নিয়ে চলে যেতে হয় অন্যত্র। যা এর আগেও একবার এমন কথা শোনা গিয়েছিল যে কলকাতা থেকে হাজারিবাগ চলে যাবে ডিভিসির সদর দফতর। কিন্তু পরে সেটা আর হয়নি।
কিন্তু এই কদিন ধরে একটু বেশি বৃষ্টি হওয়ায় দামোদরের জল বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছে ডিভিসি। তারা জল ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে আর তাতেই ডিভিসির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার হুমকি দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এখন দেখার বিষয় এটাই যে এই এতদিনের এত বছরের সম্পর্ক কি সত্যিই শেষ হয়। না কি শুধুই হুমকি দিয়ে শেষ হয় রাজনীতির মারপ্যাঁচের এই চেনা খেলা।
ডিভোর্সের হুমকি ডিভিসিকে - অভিজিৎ বসু।
উনিশ সেপ্টেম্বর, দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্য ফেসবুক।
অন্যরকম,তথ্যনির্ভর লেখা, ভাল লাগল।
উত্তরমুছুন