সাদা জীবনের কালো কথায় আজ শুধু বউনির কথা। যে বউনি নিয়ে কোনোদিন আমায় জীবনে ভাবতেই হয়নি সেই তার কথা। এখন তো আমি মাঝেই মাঝেই শুনি কি, বউনি হলো নাকি আজ। আসলে এই কথাটা শোনার অভ্যাস আমার ছিল না কোনোদিনই। এই পোড়া জীবনে বউনি হলো, নাকি হলো না সেটা নিয়ে তেমন করে ভাবতেই হয়নি কোনোদিন আমায়। কিন্তু আজ সেটাই একটা বড় ফ্যাক্টর হয়ে গেছে আমার এই জীবনে বর্তমানে।
যেনো জীবন যুদ্ধে জেতার আসল মাপকাঠি হলো এই বউনি হওয়া। আর জীবন যুদ্ধে হেরে যাওয়া হলো বউনি না হওয়া। সত্যিই শিরদাঁড়া সোজা রেখে চলতে গিয়ে যে আরও কত কঠিন পরীক্ষার সন্মুখীন হতে হবে আমায় কে জানে। আসলে এই লড়াই করে বাঁচার মধ্যে একটা কষ্ট আছে সত্যিই। এরজন্য আমার পরিবার অনেক কষ্ট ভোগ করছে এটাও ঠিক। কিন্তু দিনের শেষে কিছুটা মাতব্বরি আর আনন্দও আছে মনে হয় আমার। না হলে কি আর এই ভাবে হেসে,খেলে, কষ্ট করে জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়। শুধু কারুর পা ধরে বেঁচে থাকব না বলে। সত্যিই বিচিত্র আমার এই এক রোখা জীবন। যাকে বদলাতে পারলাম না আমি কিছুতেই।
আমি খবরের পিছু ধাওয়া করে বেঁচে থাকা একজন মানুষ। যে মানুষ হয়ে আমি খবরের বউনি করেছি সাতসকালে মর্নিং শিফট এর অফিসে গিয়ে। রাতভোর পড়ে থাকা যে খবর কেউ বউনি করেনি কোনো চ্যানেল। সেই খবরকে বোকা বাক্সের পর্দায় টেনে এনে বউনি করে। অন্যদের গোল দিয়ে মজা পেয়েছি আর আনন্দ করেছি সকালের ফাঁকা অফিসে বসে একা একাই।
এই বউনির একটা আলাদা অনুভূতি ছিল আমার কাছে। বেলা হলেই বাবু বিবিদের ধীরে সুস্থে অফিস এসে পিঠ চাপড়ে দিলে কেমন যেনো নিজেকে অন্য গ্রহের জীব বলে মনে হতো আমার সেই সময়। মনে হতো তাহলে সকালের বউনিটা ঠিকই করেছি আমি। সেতো নিজের ট্রাক এন্ড ফিল্ডে বউনি করা সাত সকালে। নিজের চেনা সংসারে বউনি করা সেটা। যে বউনি হবে বলেই ব্যাট হাতে মাঠে নামতাম আমি এক সময়, খবরের মাঠে।
কিন্তু এখন যে বউনির কথা শুনি আমি আর ভাবি সত্যিই তো এমন করে ভাবিনি আমি কোনোদিন জীবনে এই বউনি নিয়ে। যদিও এসব ভাবতেই হয় আজকাল মাঝে মাঝেই। খোলা আকাশের নিচে বসে হিসেব করতে হয় আমাকে। আজকের দিনটা ঠিক কেমন গেলো বউনির দিন, না কি শুধুই নিষ্ফলা আর নির্জলা একটা সাদামাটা দিন গেলো।
সত্যিই কি গেরো বলুন তো এটা। দিনের মাঝেও কেমন যেনো একটা ফারাক রেখে এগিয়ে চলা অন্য সব জীবনের সাথে। ব্যাট হাতে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি বল কোনদিকে আসছে ধেয়ে। কিন্তু না ব্যাটে বলে সংযোগ হয়না যে কিছুতেই। সময় কেটে যায় কিন্তু আমার স্কোর বোর্ড সচল হয়না কিছুতেই। আমি পড়ে থাকি সেই শুন্য রানেই। দিনের শেষে শুকনো মুখে ড্রেসিং রুমে ফিরে আসা।
আচ্ছা ওই যে রামপুরহাট বর্ধমান প্যাসেঞ্জার ট্রেনের সেই বৃদ্ধা। যে বাদামচাক নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ান আধময়লা শাড়ি পরে ধীর পায়ে। যাঁর পায়ের হাওয়াই চটির দু রকম রঙ দেখে নিজের অতীত দিনের কথা মনে পড়ে যায় আমার। ট্রেনের এই কামরা ওই কামরায় ঘুরে বেড়ান ছুটে চলা ট্রেনের ভিতর দিয়ে ধীর পেয়ে হেঁটে। সেটা দেখে আমি ভাবি নিশ্চয়ই এতক্ষণে ওনার বউনি হয়েই গেছে। কিন্তু হঠাৎ করেই তাকে জিজ্ঞাসা করতে পারিনা যে আমি কিছুতেই কি বউনি হলো কি। তাহলে কি আর এমন করে ঘুরে বেড়াতেন তিনি।
আর যে ওই ট্রেনের কামরায় একাই গান গেয়ে পায়ে ঘুঙুর বাজিয়ে আপন মনে নেচে যায় আনন্দে দু হাত তুলে উদ্বাহু হয়ে। তার ওই হৃদয়ের মাঝে ধরে রাখেন অনেক কিছুই তাকে কি আমরা কেউ জিজ্ঞাসা করি যে বউনি হয়েছে কি না। বরং সে বউনির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার জন্য আমাদের কাছে হাত বাড়িয়ে দিলে। মুখ ঘুরিয়ে মোবাইলের স্ক্রীনে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখি আমরা বেশিরভাগ মানুষ। জীবনের এই সব নানা বউনির টুকরো টুকরো ছবির মাঝে টুক করে চুপিসারে ঢুকে পড়েছে আমার এই সাদামাটা জীবনটাও। যে জীবনে কালো দাগ না থাকলেও বউনির দাগ পড়েছে শুনে খুশি হয় অনেকেই। হাসি ফোটে আমার বুটার মুখেও।
হুগলী জেলার এক সাংবাদিকের কথায় এতদিন তো দাদা আপনি চারপাশে ঘাড় ঘুরিয়ে কিছুই দেখতে পাননি। খবরের পিছনে ছুটে বেড়িয়েছেন। এখন দেখুন কেমন লাগে আপনার এসব। ঠিক কথাই বলেছেন ওই বিখ্যাত সাংবাদিক আমায়। ওই যে ভোর হলেই যে তিন চাকার গাড়িতে উঠে হ্যান্ডেলে চাপ দিয়ে ছুটে চলে যে পাড়ার টোটো চালক চেনা অভয়। তাকেও কি কেউ জিজ্ঞাসা করে বউনি হয়েছে কি না। সকাল থেকে তার পকেটে দশ বিশ টাকার আয় হয়েছে কি না। তাহলে আমায় যে কেনো এমন করে জিজ্ঞাসা করে আকুল হয়ে লোকজন কে জানে। হয়তো ভালোবেসেই করে। বা বউনির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলাম কি না সেটা জানতে চায়। কিছুটা নিছক কৌতুহল বশেই।
জীবনের এই বউনি করা আর না করার কোনো ফারাক যে আমি এতদিনেও ঠিক বুঝতে পারলাম না যে। তাই বোধহয় অবুঝের মতই আমি বলে বসি। কি আর আসে যায় বউনি হলো কি না হলো সেটা নিয়ে। জীবনের এই বউনি করার সংসারে সংগোপনে নাম লিখিয়ে কেমন যেনো আমায় ব্রাত্য মনে হয়। মনে হয় এদের সবার মাঝেই আমি যে বড়ই বেমানান এক জীব। যে জীব বউনির বিজ্ঞান নিয়ে খুব বেশি ভাবিত নয়। যতটা ভাবিত সে তার চারপাশের এই সব মানুষদের উদ্বিগ্ন মুখ আর মুখের অবয়ব দেখে। তাদের হাসি আর কান্না দেখে। তাদের জীবনের নানা গল্প শুনে।
কিন্তু না, দিনের শেষে যখন আমি ঘরে ফিরে আসি দ্রুত হাতে জিনিস পত্র গুছিয়ে ঘরে ফেরার জন্য তোড়জোড় করি সেই সময় কোথা থেকে যে কেউ এগিয়ে আসে আচমকাই বউনি হয়ে যায় আমার হিসেব ছাড়া কোনো কোনো দিন। কেমন যেনো একটা ভার নেমে যায় আমার বুক থেকে। বউনি হলো কেউ জিজ্ঞাসা করলে হাসি মুখে বলতে পারবো হ্যাঁ হলো এটাই বড় কথা হয়ে যায়।
আবার কোনোদিন সারাদিন অপেক্ষার পরেও কেমন যেন শুকনো মুখে ঘরে ফিরে আসা।খাতা খোলে না যে একদম। হাজার মুখের ভীড়ে নিষ্ফলা দিনের মধ্যেই বেঁচে থাকার চেষ্টা করা আর কি। মন্দিরের ঘণ্টার আওয়াজ, মন্দিরে ধূপের গন্ধ, পূজার ডালা হাতে সব নানা ধরনের মানুষের আকুল আর্তি মার কাছে।
এসবের মাঝেই তো লুকিয়ে থাকে পাওয়া আর না পাওয়ার নানা করুণ কাহিনী। সারাদিন অপেক্ষার পরে শূন্য হাতে ঘরে ফিরে আসা। জীবনের পরতে পরতে জড়িয়ে থাকে এমন কিছু নানা করুন অভিজ্ঞতা। যা সাদা জীবনে কালো কথার পর্দায় লেখা হয় রাতের অন্ধকারে আঁকাবাঁকা অক্ষরে আমার এই আঁকিবুঁকি ব্লগে।
আর ঘরে ফেরার সময় দেখি সেই হলুদ বসন্ত বৌরী কেমন করে তাকিয়ে দেখে লুকিয়ে লুকিয়ে আমায় আড়চোখে গাছের আড়াল থেকে। আর আমি মনে মনে তাকে বলি এইত বউনি হলো আমার আজ। তাহলে আর অমন করে কেনো দেখা আমায়। কিছুটা লজ্জায় মুখ লুকিয়ে ফেলে সে গাছের পাতার ভীড়ে।
সাইকেলে প্যাডেলে পা দিয়ে আমি এগোতে থাকি ধীরে ধীরে। দূরে রেলপথের ধূসর মাঠের মাঝে লাল সূর্যের সোনা মাখা আলো মাঠ ঘাট জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে। আমার সারা শরীর জুড়ে পড়ন্ত রোদের লাল আভা ছড়িয়ে পড়েছে। আকাশে ভেসে বেড়ানো এদিক ওদিক সাদা মেঘের আড়ালে লুকিয়ে আছে পূজোর সোঁদা মন কেমন করা গন্ধ। দূরে মাঠের মাঝে কাশ ফুলের তোড়া দেখে মনে পড়ে যায় ভাদ্রের শেষে শরৎ আসছে।
আর এসব দেখে মনটা ভরে যায় আমার। ভালো হয়ে যায় শুন্য হাতে ঘরে ফেরা আমার বিধুর ভারী সিসের মত তামাটে ঘষা মনটা। মনে হয় বেচা কেনার এই জীবনে কেউ সফল হয় আর কেউ বিফল। এসবের মাঝেই তো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দিগন্তের কোণে ঢলে পড়া সূর্যের লাল আভা। সবুজ মাঠের ধারে চুপি চুপি কাশফুলের কেমন করে সংগোপনে বেড়ে ওঠা। আকাশে মেঘের ভেলায় ভেসে আসা পূজোর সোঁদা গন্ধের মন কেমন করা অনুভূতির শিহরণ।
আর সেই সময় চেনা সাইকেলের টিং টিং বাজনা বাজিয়ে আমি দ্রুত ঘরে ফিরি। পথ,ঘাট, মাঠ, প্রান্তর পেরিয়ে দ্রুত আরও দ্রুত ঘরে ফিরি আমি। আর আমার পিছনে তাড়া করে বেড়ায় বউনি নামক এক অজানা অচেনা পথের পথিক।
বউনি - অভিজিৎ বসু।
তেসরা সেপ্টেম্বর, দু হাজার চব্বিশ।
চমৎকার লেখা।
উত্তরমুছুনজীবনকে এভাবে দেখা,মনে দাগ কেটে যায়।
উত্তরমুছুন