আজ শুধু আমার বুটার দিন। হ্যাঁ, আজ যে শুধুই ওর দিন। যে আমার প্রাণের প্রাণ, আমার অস্তিত্ব,আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অংশ জুড়ে আছে ও। আমায় যে শাসন করে আবার ভালোবাসতে পারে। যে চোখ পাকিয়ে বকতে পারে আর বলতে পারে তোমার দ্বারা আর এই কাজ বাজ আর হবে না কিছুই। আর এই কথা শুনে রাগ করলে কেমন যেনো একটু পরে কাছে এসে রাগ ভাঙ্গিয়ে ঠিক কাছে টেনে নিয়ে আবার বলে কি হলো চলো ঘুমিয়ে পরো রাত অনেক হলো যে। যে আমার কন্যা, মেয়ে, দুহিতা, আমার প্রাণ আমার লাইফ লাইন হয়তো আরও কত কি।
সত্যিই বলতে কি এই যে বাবা আর মেয়ের রসায়ন যা বোধহয় বিশ্বের যে কোনো দেশ কাল তার গণ্ডী পেরিয়ে সারা বিশ্বে একটি রসায়নেই তৈরি। যার কোনো নির্দিষ্ট সীমানা নেই। সারা বিশ্বে এই বাবা আর মেয়ের যে অনাবিল আনন্দ আর সুখের অনুভূতির সম্পর্ক সেটা বোধহয় আর কোনো সম্পর্কে এমন করে হয় না। এই রাগ, অভিমান, ঝগড়া, আবার এই ভাব, ভালোবাসা, কাছে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে অভিমান আর রাগকে কমিয়ে দেওয়া এক নিমেষে। কান্নায় ভেঙ্গে পড়লে কেমন করে নিজের বুকে টেনে নিয়ে চোখের জল মুছিয়ে দেওয়া চুপি চুপিচুপি।
সত্যিই বলতে কি প্রথম যখন আমার মেয়ে হয়েছে এই খবর পেলাম মিন্টের মা আমাকে শ্রীরামপুর ওয়ালস হাসপাতালে দাঁড়িয়ে লেবার রুম থেকে বেরিয়ে এসে বললো অভিজিৎ এর মেয়ে হয়েছে। দিনটা ছিল পয়লা বৈশাখ সকাল বেলা। তখন মনটা কি একটু খারাপ হয়ে গেছিল আমার কে জানে হয়তো তাই হয়েছিল বোধ হয়। মনে হয়েছিল কেনো আমি যে খুব করে ছেলে হবে ভেবেছিলাম মনে মনে। তাহলে মেয়ে হলো যে। একটু দুঃখ নিয়েই যে ওকে দেখতে গেলাম আমি ওকে হাসপাতালে। চোখ বুজে আছে আর কেমন কাঁদছে। দেখে কেমন যেনো মনে হলো ছেলে হলো না যে আমার।
বাড়ি এলো হাসপাতাল থেকে তবু যেনো মনের গভীরে একটা দুঃখ ছিল আমার একটু। কিন্তু দিন পনেরো কাটলো এইভাবেই। তারপর ওর রাতে ঘুম না এলে কান্না জুড়ে দিত আর আমি ওকে কোলে নিয়ে কাবা কাবা গান ধরলেই মেয়ের কান্না বন্ধ হাতের দুলুনিতে ঘুমিয়ে পড়ত কেমন করে। কিন্তু বিছানায় শুইয়ে দিলেই আবার ফের ওর কান্না শুরু। সেই বোধহয় শুরু হলো একটু একটু করে আমাদের দুজনের মধ্যে সম্পর্কে রসায়ন বিজ্ঞান এর মধ্যে অনুঘটকের কাজ শুরু হওয়া। আর সেই শুরু তারপর তো ধীরে ধীরে সেই ছোট্ট বুটা আমার সেই কাবা কাবা গান শুনে অভ্যস্ত হয়ে গেলো।
আমার সেই ছোট্টো বুটা হয়ে গেলো আমার জীবনের সুখ দুঃখ আনন্দের একমাত্র শরিক। যে বোধহয় আমায় ঘুমিয়ে থাকলে পেন দিয়ে নির্ভয়ে কপালে লিখে দেয় মজা করে বোকা বাবা বা গাণ্ডু বাপ। আবার কোনোদিন লিখে দেয় রেগে মেগে গোঁফ এঁকে বলে ঘুমিয়ে পড়েছে যে। সত্যিই বলছি এই গভীর গোপন অনুভূতি গুলোর শরিক হতে পেরে বেশ ভালই লাগে আমার এই বয়সেও। মনে হয় সত্যিই সেদিন ফালতু মন খারাপ হয়েছিল আমার ছেলে হয়নি বলে। কন্যা না হলে মেয়ের বাবা না হলে আমি বোধ হয় নিজেই বুঝতে পারতাম না মেয়ের বাবার জীবন কত সুন্দর।
যে ছোটো মেয়েকে ঘিরে সংসার আর সেই সংসার জীবন করতে গিয়ে নানা সুখ আর দুঃখের শরিক হতে হয় বারবার। সেই সাইকেল করে ঘুরতে ঘুরতে ও পিছনে বসে ছবি তোলে আর বলে আর একটু ধীরে চল তো এই ছবিটা তোলা হয়নি আমার। আর মনে মনে ভাবি ভাগ্যিস বুটা আমার জীবনে এসেছিল। তাই তো বোধদয় এত কিছু অনুভূতি এলো আমার এই জীবনের জলছবিতে। কখনও হাসি আবার কখনও কান্না। কখনও আনন্দ কখনও দুঃখ। এই ভাবেই তো ওকে ঘিরেই আবর্তিত এখন আমার গোটা এই বাতিল জীবন।
এই কেমন করে যে সেদিনের সেই অনুঘটক আজ পজিটিভ হয়ে গেছে আমার জীবনে কে জানে। আর যার জন্য সেই মন খারাপ লেগেছিল হাসপাতালে দাঁড়িয়ে ছেলে হয়নি বলে আজ তার জন্য সব সময় কেমন যেন চিন্তা হয় আমার। মনে হয় এই বুঝি ও রাগ করলো আমার ওপর। এই বুঝি অভিমান করলো আমার ওপর। এই বুঝি মুখ বুজে চুপ করে মনে মনে কষ্ট সহ্য করে চুপটি করে বসে থাকবে ঘাড় গুঁজে। আর মনে মনে বু বলে ডাকবে না আর আমায়। এই ভয়ে আমি কেমন যেনো ত্রস্ত হয়ে থাকি সব সময়। আর ভাবি ভাগ্যিস সেদিন ওই ছোট্টো পুচকি মেয়েটা আমার ঘরে এসেছিল। কাবা কাবা গানে ওকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিলাম। না হলে কি আর এইভাবে এলেবেলে এলোমেলো বিন্দাস জীবন নিয়েও এত সুন্দর একটা অকাজের বাবা আর মেয়ের গভীর গোপন ভালোবাসার সম্পর্ক নিয়ে বেঁচে থাকতে পারতাম আমি। বু আর বুটার এই অমলিন সম্পর্ক বেঁচে থাক।
বুটা ও আমি - অভিজিৎ বসু।
বাইশে সেপ্টেম্বর, দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্য ফেসবুক।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন