সাদা জীবনের কালো কথায় আজ সৌরভের কথা। হ্যাঁ, সেই সৌরভ বন্দোপাধ্যায়। যার সাথে আমার আজ থেকে বহুদিন আগের পরিচয় পর্ব ঘটে প্রায় পঁচিশ বছর হলো। খুব সম্ভবত তরুণ দা ওকে আমার সাথে আলাপ করিয়ে দেয় কোন্নগর এর বইমেলায়। সেই আমি আর সৌরভের সেই সিটিভিএন অফিসে ক্যাসেট পৌঁছে দেওয়া খবরের। ট্রামে করে বড়ো ঢাউস ক্যামেরার ব্যাগ নিয়ে সৌরভ আর আমি কলকাতায় ঘুরে খবর করছি বাস আর ট্রামে চেপে। সেই তাপস রায়, তপন শিকদার, তথাগত রায়, মদন মিত্র, শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় তার সাথে দেখা করে ইন্টারভিউ নিয়ে একটু খবর করা। তারপর সেই সাক্ষাৎকার এডিট করে সিটিভিএন অফিস বিরাটিতে পৌঁছে দেওয়া। আর সেই খবরের ভাষ্যপাঠ করছে বিখ্যাত বিদিশা রায়। যে এক সময় কলকাতার আকাশবাণীতে কাজ করত। পরে ইটিভির কাজেও যোগ দেয় সে। এখন বিদেশে থাকে বিদিশা রায়।
সেই শুরু আমার আর সৌরভের পথ চলা। সেই লাল আর হলুদ এর এক রঙের উজ্জ্বল গেঞ্জি ওর গায়ে। ওর মুখে এক গাল হাসি লেগে আছে সবসময়। ওকে হাজার বকলেও ওর মুখের সেই হাসিটা উবে যায়নি কোনোদিন কোনো সময়। যে কোনো সময় যে কোনো কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে বেড়িয়ে পড়েছি আমরা দুজন রাত দিন যে কোনো সময়। কোনো আগু পিছু না ভেবেই। কোনোদিন বলেনি সে এখন বের হতে পারবে না সে। আর সেই যে লঙ্কাপুরীতে সেই ডিঙ্গি নৌকা করে খবরের সন্ধানে যাওয়া হোক। কিংবা সেই বৌবাজারের সেই তাপস রায় এর বাড়িতে ইন্টারভিউ নিতে যাওয়া হোক। ওর সেই রাজদূত গাড়ি চড়ে হুগলীর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ঘুরে বেড়িয়েছি আমরা। আসলে খবরের নেশায় আমাদের পেয়ে বসেছিল সেই সময়।
সেই ক্যাসেট নিয়ে বিরাটি যাবার দিন শেষ হলো একদিন আমাদের। ঘুরতে ঘুরতে একদিন দুপুর বেলায় ও আমার রিষড়াতে এলো আমায় বাড়িতে পৌছে দিতে। মা বললেন এই দেখ একটা চিঠি এসেছে তোর সাদা খামে করে পোস্টম্যান দিয়েছে। খুলে দেখলাম সেই হায়দরাবাদ থেকে ইটিভির চাকরির নিয়োগপত্র এসেছে আমার। ও বললো দেখো অভিজিৎ দা আমি লাকি কিন্তু। আজ তুমি চিঠি পেলে চাকরির। সেই তিনহাজার তিনশো একচল্লিশ টাকার চাকরি। ট্রেনি রিপোর্টার এর চাকরি জুটলো আমার ইটিভির। নতুন জীবন শুরু হলো। আমার সাথে রইলো সেই সৌরভ। নতুন চ্যানেলের জেলার সাংবাদিক হলাম আমি সৌরভ বন্দোপাধ্যায় হলো ক্যামেরাম্যান। পরে এলো সুব্রত যশ আর মিল্টন সেন আর রানা কর্মকার।
শুরু হলো আমাদের দৌড় আর দৌড়। নতুন চাকরি, নতুন দায়িত্ব আর নতুন এডভেঞ্চারের সাংবাদিক জীবন যাপন শুরু হলো দুজনের। দুহাজার সালের পুরসভার উপনির্বাচন এর ভোট চলে এলো। কি উত্তেজনা আমাদের সবার। সকাল হতেই সৌরভ আর আমি বেরিয়ে পড়লাম ওর সেই মোটর সাইকেল করে উত্তরপাড়া এলাকায় ভোটের ছবি করতে। উত্তরপাড়া এলাকার সেই কোতরং এর স্কুল জিটি রোড এর ওপরে। ভোটের লাইনে বহিরাগত লোকদের ভীড়। সকাল ন়টা বাজে তখন। বেলা বাড়তেই গণ্ডগোলের শুরু। কেনো ভোটের লাইনের ছবি তোলা হচ্ছে ক্যামেরা দিয়ে। সেটা দেখেই একদল সিপিএমের সমর্থক ঝাঁপিয়ে পড়ল আমাদের ওপর। সৌরভ বন্দোপাধ্যায় তখনও ছবি তোলার চেষ্টা করছে কোনো রকমে। আমাকে ওর গাড়ির পেছনে বসে থাকা অবস্থায় চ্যাং দোলা করে রাস্তায় তুলে ফেলে দিলো। এলো পাথাড়ি কিল চড় আর ঘুঁষি। বেধড়ক মার আর তার সাথে খিস্তি। ছবি তোলা হচ্ছে দেখ আজ কি করি মেরেই ফেলব তোকে।
সাংবাদিক পরিচয়ে কাজ করা তখন আমার কেমন জেদ চেপে গেছিলো মার খেয়ে মাটিতে পরেও ভয় পাইনি আমি। তখন সৌরভ একটু দূরে ছিটকে গেছে গাড়ী নিয়ে। যদিও কিছুটা ছবি ধরা আছে ওর ক্যামেরায়। তারপর এই আক্রমণের খবর পেয়ে অন্য সব জেলার সাংবাদিক গৌতম দা, দেবাঞ্জন দা, তরুণ দা, ফাল্গুনী দা, গৌতম ধোলে আর অনেক পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে হাজির হলো। আমায় রাস্তা থেকে উদ্ধার করে সোজা উওরপাড়া স্টেট জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। আর এই খবর পেয়ে হাজির হলো আকবর আলী খোন্দকার আর সেই আজকের উত্তরপাড়ার পুরপ্রধান দিলীপ যাদব।
না এরপরেও শেষ হয়নি নাটক। উত্তরপাড়া হাসপাতালে সেই সময় আনন্দবাজারের চিত্র সাংবাদিক ,পিয়াল হাসপাতালের বেডে আমি শুয়ে আছি স্যালাইন চলছে তার ছবি তুলছে পটপট করে। সেই সময় হাসপাতালের কাঠের সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলো জনা পঞ্চাশ উন্মত্ত যুবক মুখে একটাই কথা কোথায় মালটা আজ ওকে মেরেই ফেলবো ছবি তুলে রাখা হচ্ছে। দ্রুত সেই খবর পেয়ে হাসপাতালে পুলিশ নিয়ে হাজির হলেন এসডিপিও শ্রীরামপুর সুপ্রতিম সরকার। সবে তিনি নতুন কাজে যোগ দিয়েছেন এসডিপিও পদে শ্রীরমপুরে। এসেই সোজা অ্যাকশন নিলেন তিনি কাউকে রেয়াত না করে। তাদের সবাইকেই তাড়া করলেন বহিরাগত লোকদের যারা হাসপাতালের মধ্য ঢুকে পড়েছে। পুলিশের এই রূপ দেখে কিছুটা থমকে গেলো তারা। ধীরে ধীরে সবাই হাসপাতাল ছেড়ে দিয়ে চলে গেলো।
পরে আমায় অ্যাম্বুলেন্স করে এসডিপিও শ্রীরামপুর এর নির্দেশে পুলিশ এসকর্ট করে শ্রীরামপুর ওয়ালস হাসপাতালে আনা হলো। চব্বিশ ঘণ্টা পুলিশ পাহারা বসলো আমার বেডের পাশে। আর সেই সুপ্রতিম সরকার পরে হুগলী জেলার এসপি হয়েছিলেন। সিঙ্গুরের জমি আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠেছে তখন গোটা রাজ্যে। যে সময় বহুবার তাঁর সাথে বাকবিতণ্ডা হয়েছে খবর করা আর ছবি করা নিয়ে কিন্তু কোনো দিন তিনি আমায় সেই সব নিয়ে কিছুই বলেন নি। উল্টে বলেছেন অভিজিৎ ভালো আছেন আপনি। মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ করুন। সেই গল্প অন্য একদিন লিখবো। বদলে যাওয়া পুলিশ এর কাহিনী।
সেই সৌরভের তোলা ছবি আর গৌতম ধোলের তোলা ছবি পোঁছে গেলো কলকাতা ইটিভি আর খাসখবরের অফিসে। সেই রিপোর্টারকে পেটানোর ছবি দেখে হৈ চৈ পড়ে গেলো চারিদিকে। সেই প্রথম বাম আমলে সাংবাদিক পেটানোর ঘটনায় উত্তাল হলো গোটা রাজ্য। আমার খবর নিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই। আমি কেমন আছি সেই কথা জানলেন তিনি আকবর দার কাছে। খবর নিলেন বর্তমান কাগজের সম্পাদক বরুণ সেনগুপ্ত। হাসপাতালে ছুটে এলেন আব্দুল মান্নান। ছুটে এলেন প্রবীর ঘোষাল। আরও কত কংগ্রেসের আর সদ্য গজিয়ে ওঠা দল তৃণমূলের নেতারা দৌড়ে এলেন আমায় দেখতে। ভীড় জমে গেলো হাসপাতালে। কলকাতা প্রেস ক্লাবে মিছিল হলো কালো ব্যাজ পরে। খুব সম্ভবত সুমন চট্টোপাধ্যায় সেই মিছিলে হাঁটলেন। অনেক বিশিষ্ট সাংবাদিক পা মেলালেন এই সাংবাদিক পেটানোর ঘটনার প্রতিবাদে। একদম রাতারাতি বিখ্যাত সাংবাদিক হয়ে গেলাম আমি।
পরদিন হাসপাতালের বেডে শুয়ে জানতে পারলাম আমি আমার কাগজে ছবি বেরিয়েছে। একজন পুলিশ যিনি গার্ড দিচ্ছিলেন আমায় তিনি প্রথম দেখালেন আমায় সেই ছবি। সব কাগজের ছবি দেখে বেশ ভালো লাগলো আমার। সেই সৌরভ আর আমি আমাদের দুজনের এই জুটি বিখ্যাত হয়ে গেলাম হুগলী জেলায়। যেখানেই ঝামেলা, গণ্ডগোল, খুন, রাজনৈতিক সংঘর্ষ সেখানেই হাজির আমরা দুজন দ্রুত। আমার আজও মনে আছে সেই শ্রীরামপুর থেকে রাজদূত মোটর সাইকেল চালিয়ে আমি আর সৌরভ খানাকুল এর গণ্ডগোল কভার করতে গেলাম। বালির ওপর গাড়ির চাকা স্লিপ করে উল্টে গেলাম আমরা দুজন। হাত পা জখম হলো আমার। সেই অবস্থায় গাড়ি চালিয়ে সৌরভ বন্দোপাধ্যায় আমায় নিয়ে সেই খবর কভার করলো নদী পেরিয়ে খানাকুলে। সেই সময় জেলার এস পি ছিলেন গঙ্গেশ্বর সিং, জেলাশাসক ত্রিনাথ সিনহা। আর এসডিপিও আরামবাগ ছিলেন সেই সময় বিখ্যাত সেই পুলিশ অফিসার অজয় নন্দা সাহেব। যদিও এই ভাবে ছবি তোলার সুযোগ নিয়ে আমি নাকি নিজের টিআরপি বাড়াবার চেষ্টা করি বলে শ্রীরামপুরের এক সাপ্তাহিক পত্রিকা পল্লীডাক পত্রিকায় বড়ো করে লেখা হয় একসময়। সেই উত্তরপাড়ায় পুলিশের হাতে চড় খেয়ে প্রতিবাদ করার ঘটনায়। সেই কথা লিখবো একদিন সময় হলে। আজও সেই কাগজ আমি সযত্নে লকারে রেখে দিয়েছি আমি। যা আমার কাছে অমূল্য সম্পদ।
এইভাবেই তো দুজন মিলে খবর করেছি আমরা জেলা জুড়ে। যদিও সেই সময় সৌরভ খবরের জন্য টাকা পেতো স্টোরি কটা হয়েছে সেই হিসেবে মাসে মাসে বিল পেতো সবাই। পরে ও হুগলী জেলার ইটিভির অফিস ক্যামেরাম্যান হয়। মিল্টন সেন পরে আকাশ বাংলা চ্যানেলে কাজে যোগ দিলে ওর জায়গায় কাজে আসে চুঁচুড়া সদর মহকুমাতে সৌরভ হাজরা। সৌরভ বন্দোপাধ্যায় স্টাফ হয় ইটিভির। পরে যদিও সে এবিপি আনন্দ চ্যানেল এলে সেখানে চলে যায় সে হুগলী জেলার দায়িত্ব নিয়ে। কিন্তু সৌরভের সাথে আমার যোগাযোগ ছিল বরাবর। আমার বিয়েতে ওর অনেক সাহায্য করা। আমি ওর মার কাছে গিয়ে কথা বললেই তিনি আমায় বলতেন তোমরা বাবা সাবধানে কাজ করো। যা ঘটনা ঘটেছে তোমার। ওর মা, কাকিমা, ওদের বাড়ির সবাই বেশ চিনে গেছিলেন আমায়। ওর সেই ছোটো রাস্তার পাশের স্টুডিও। সেই স্টুডিওতে সেই কালো বাচ্চা ছেলেটার চুপ করে বসে থাকা। পরে এখন যে বিখ্যাত সাংবাদিক হয়ে গেছে আনন্দবাজার পত্রিকার হুগলী জেলার এখন। সেই ছেলেটা হলো প্রকাশ পাল। সেই সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নানা মেসিনপত্র। কত ভিএইচএস ক্যাসেট নানা রঙের স্মৃতি।
যাকগে আসলে সৌরভের একটা ছবি ফেসবুক এর পর্দায় দেখে এত কিছু কথা মনে পড়ে গেলো আমার আজ। হঠাৎ একদিন শুনলাম ও অসুস্থ হয়ে গেলো। সেরিব্রাল অ্যাটাক হলো ওর। এত দৌড়ে বেড়ানো একজন রিপোর্টার হঠাৎ কেমন করে যেন ঘরবন্দী হয়ে পড়ল অসুস্থ হয়ে। এদিক ওদিক থেকে খবর নিতাম আমি ও কেমন আছে। ওকে ফোন করে খবর নিতে মন সায় দেয়নি আমার কিছুতেই। কি খবর নেবো আমি। ওর সামনে গিয়ে কি করে দাঁড়াবো আমি। তাই বিধান এর থেকে খবর নিতাম আমি ওর। কি যে হলো ওর কে জানে। চিকিৎসা শুরু হলো ওর। বহুদিন পর ব্যাঙ্গালোর চিকিৎসা করতে যাবার সময় ওর সাথে কথা হলো আমার বহুদিন পরে একটু মোবাইলে মেসেজে।
আজ সেই পুরোনো কাগজের একটা ছবি দেখে এত কিছু কথা আমার সাদা জীবনের কালো কথায় লিখে ফেললাম আমি। সত্যিই তো জীবন বড়ো অদ্ভুত। এই দৌড়ে বেড়ানো একটা জীবন কেমন যেন দুম করে স্থবির হয়ে যায়। ওর ঘরে কাটানো জীবন দেখে আমার কেমন কষ্ট হয় আজ। মনে মনে ভাবি একসময় আমরা দুজনেই কেমন জুটি বেঁধে জেলার এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত পর্যন্ত দৌড়ে বেড়াতাম আজ দুজনের জীবনেই কেমন স্থবিরতা নেমে এসেছে। সেই দৌড়ে দুজন মিলে পথিক এর গ্রামে ছুটে চলে যাওয়া ফুরফুরা থেকে সেই বড়গাছিয়ার রাস্তা নিয়ে খবর করা, সেই ভাঙা কাদা রাস্তা সারিয়ে দেওয়া সেই খবর করা, সেই রথের মেলায় রাধারাণীকে নিয়ে খবর করা, সেই শ্রীরামপুর এর ইন্ডিয়া জুট মিলে আন্দোলন এর সময় বৃষ্টির রাতে বেধড়ক লাঠিচার্জ এর ছবি করা, সেই সব পুরোনো দিনের নানা কথাই যে মনে পড়ে যায় আজ এই রাতের বেলায়।
মনে মনে সাধ হয় আমার আবার যদি দুজন মিলে একটিবার ওর সেই পুরোনো রাজদূত মোটর সাইকেল করে খবর করতে বেরিয়ে পড়তে পারতাম এই গ্রাম থেকে অন্য দূরের গ্রামে। আমরা দুজন এক সাথে তাহলে কি মজাই যে হতো কে জানে। সাদা জীবনের কালো কথায় এই এমন একটা দিন যদি আবার ফিরে আসতো তাহলে খুব ভালো লাগতো আমার আর ওর দুজনের। আমি ওকে বলতাম সৌরভ ছবি বেশি করে তুলেছো তো দেখো কম ছবি যেনো না হয় এটা কিন্তু বড়ো প্যাকেজ হবে। সৌরভ বলতো চিন্তা নেই তোমার বহু ছবি আমি তুলেছি। আমরা দুজন আবার সেই ছবির জগতে খবরের জগতে ফিরতে চাই একটিবার।
সৌরভ ও আমি - অভিজিৎ বসু।
বাইশে সেপ্টেম্বর, দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্য ফেসবুক।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন