সাদা জীবনের কালো কথায় আজ কেষ্ট মুখোপাধ্যায় এর কথা। আমাদের সবার সেই কেষ্ট দা। যার কথা না বললেই নয় আমার এই আঁকিবুঁকি ব্লগে। শ্রীরামপুর এর প্রাক্তন চেয়ারম্যান সেই কেষ্ট মুখোপাধ্যায়। যাঁর মৃত্যুদিন পালন করা হলো পাঁচ সেপ্টেম্বর। আসলে কিছু কিছু মানুষ থাকেন যারা দল, রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে সবার কাছে জনপ্রিয় হয়ে যান। তিনি মারা যাবার এতদিন পরেও সাধারণ মানুষ, সাংবাদিক, বাজার বিক্রেতা, স্থানীয় ব্যবসায়ী, সবাই যেনো এখনও একডাকে কেষ্টদা বলতে অজ্ঞান। তিনি যা বলবেন সেটাই হবে। সোমেন মিত্রের একনিষ্ঠ শিষ্য। কংগ্রেসের ডাকা বুকো সৈনিক হিসেবে কেষ্টদার নাম জানে কলকাতার নেতারাও একডাকে। রাজনীতির ময়দানে এমন লোকের দরকার আছে খুব।
সাদা পাজামা আর পাঞ্জাবী পরে মুখে হাসি নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন তিনি। রাজনীতির নানা ঘটনায় আর দুর্ঘটনায় তখন কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এসে নতুন দল করছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সারা জীবন কংগ্রেস করা মানুষটা কেমন করে ওই তাঁর আসল দলের মায়া আর মমতাকে কাটিয়ে হাত ছেড়ে মমতার ঘাসফুলে নাম লেখালেন কে জানে। তৃণমুলের তখন এত রমরমা অবস্থা নেই।
কংগ্রেসের হাত ছেড়ে নতুন দলকে প্রতিষ্ঠা করা বেশ কঠিন ব্যাপার ছিলো। কিন্তু সেই কঠিন পরিস্থিতিতেও সিপিএমের নানা চাপ আর কংগ্রেসের দলের ভিতরের প্যাঁচের রাজনীতিকে সামলে দক্ষ সংগঠক হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। কেষ্ট দা হুগলীর গ্রাম শহর সব জায়গায় ছড়িয়ে দিলেন নতুন দল ঘাসের উপর জোড়া ফুল আমরা হলাম তৃণমূল এর নাম। হাত ছেড়ে নতুন দলে এসে বুঝিয়ে দিলেন তিনি যেদিকে থাকবেন পাল্লা ভারী থাকবে সেদিকেই।
আকবর আলী খোন্দকার আর কেষ্ট মুখোপাধ্যায় এর জুটি সেই সময় হুগলী জেলার বিভিন্ন এলাকায় প্রান্তে বেশ সাড়া ফেলে দিলো। তখন সবে জেলার নতুন যুব নেতা হয়েছে দিলীপ যাদব হাতে মাইক নিয়ে বলতে শুরু করেছেন আমরা তৃণমূল। আমরা হলাম ঘাসের ওপর জোড়া ফুল। শ্রীরামপুরের এক সভায় তখন এই ভাবেই তরতাজা ছেলেদের তুলে এনে মঞ্চে দাঁড় করিয়ে তৈরি করছেন দলের নতুন প্রজন্মকে তিনি এইভাবেই যা আজ গল্প কথা মনে বলে মনে হবে। যারা তাদের পর ভবিষ্যতে দলকে টেনে নিয়ে যাবেন। এটাই ছিল তাঁর পরিকল্পনা। অন্যদিকে চুঁচুড়াতে সেই সময় তপন দাশগুপ্ত মাটি কামড়ে পরে আছেন।
যাই হোক কেষ্টদার এই বিশেষ প্রয়াণের দিনে বড়ো বেশি করে মনে যায় তাঁর কিছু কথা। ওই যে যেদিন
আকবর দা যেদিন জয় পেলেন সংসদে গেলেন সেদিন তো একাই সব সামলে দিয়েছিলেন তিনি তাঁর চেনা মুখ নিয়ে। যেদিন আকবর দা বিধানসভার দরজার চৌকাঠে পা দিলেন সিপিএম কে সামলে দিয়ে হারিয়ে দিলেন সেটাও কম বড়ো কথা নয়। একটা নতুন দলকে ধীরে ধীরে গড়ে তুললেন কেষ্ট দা হুগলী জেলায়। যেটা হয়তো আজকের দলের নেতারা কর্মীরা জানেননা অনেকেই। কত সংগ্রাম লড়াই করে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এই ঘাস ফুলের দল জেলায় জেলায়। সব জায়গাতে একজন করে এমন মানুষ থাকেন যারা নিঃশব্দে কাজ করে যান দলের মধ্যে চুপি চুপি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও কেষ্টদাকে খুব সম্মান করতেন। কেষ্টদাও তাই নতুন দলকে চ্যালেঞ্জ নিয়ে তৈরি করতে শুরু করলেন এই দিলীপ যাদব এর মত ছেলেদের সামনে এগিয়ে দিয়ে।যারা আজও দলের ঝান্ডাকে ধরে আছেন প্রাণপণে।
এত গেলো সেই পুরোনো দিনের কথা এবার সেই চেয়ারম্যান এর গল্পে আসি। সেই সময় ইটিভির বেশ রমরমা বাজার আর দাপট জেলায় আর শহরে। এত টিভির ভীড় নেই। তার ফলে নাজেহাল সব টিভি দেখা সেই সময় এর মানুষজন। সাত সকালেই ফোন এলো এক পুলিশের কাছ থেকে। আরে কি করছেন কি দেখুন পুরসভার ওয়েব সাইট খুললে যে পর্ণগ্রাফির নানান ছবি ফুটে উঠছে। খবর নিন আপনি বলেই ফোন কেটে দিলেন তিনি। আরে সত্যিই তো ঠিক কথা একি দেখছি সকাল সকাল। ক্যামেরা নিয়ে আর ক্যামেরা ম্যান মিন্টেকে নিয়ে হাজির হলাম কেষ্টদার মাহেশ এর বাড়িতে। অফিস ঘরে তখন ভীড়ে ভিড়। আমায় ওপরে ডাকলেন হাসিমুখে বললেন কি যে বলি না আমি ওটা দেখতে বলেছি কেনো এমন হলো। বলে হাসিমুখে বাইট দিলেন। পরদিন সেটা ঠিক হবার পর নিজেই বললেন এসো এবার ভালো হয়েছে কিন্তু কাল যা দেখালে সেটা ঠিক হয়েছে এটাও কিন্তু প্রচার করতে হবে এই টিভিতে। এই ভাবেই হাসিমুখে সব সমালোচনা সহ্য করতে পারতেন তিনি। যা আজকের দিনেব রাজনীতিতে বিরল কিছুটা।
বছর শেষে তিনি নিজে মনে করে সব সাংবাদিকদের নামে ডায়েরী পাঠিয়ে দিতেন পুরসভার তরফ থেকে। আর প্রতি বছর সেই ডায়েরী পল্লী ডাক পত্রিকার অফিসে নিয়ম করে পৌঁছে দিতেন তিনি পুরসভার বড়বাবুকে দিয়ে। পরে বলতেন অভিজিৎ তুমি পেয়েছ তো। একবার প্রচণ্ড ঝড়ের রাতে কত বাড়ী ঘর গরীব মানুষের ত্রিপল উড়ে গেল। আমার বাড়িতে কাজ করা একজন মহিলাকে নিয়ে গেলাম কেষ্টদার কাছে। বললাম একটা কালো ত্রিপল দিলে উপকার হয় দাদা খুব। সঙ্গে সঙ্গে বলে নিজেই ব্যবস্থা করে দিলেন তিনি। এটাই তো তিনি আমাদের কেষ্ট দা।
আজকের যে প্রেস ক্লাব হুগলীর ঘর হয়েছে
শ্রীরামপুরে আর এম এস মাঠের ওপরে। সেটা তো কেষ্টদার জন্যই করা সম্ভব হয়েছে শ্রীরামপুরের সাংবাদিকদের। অন্ততঃ আমাদের সবারই তেমন মনে হয়। তিনি সাহায্য না করলে এত সুন্দর একটা প্রেস ক্লাব তৈরি হতো না। শ্রীরামপুরের পুরসভার এই আর এম এস মার্কেটের দোকান ঘর বন্ধ হয়ে পড়ে আছে কেউ কিনছে না সেই সময় তিনি বলেছিলেন সাংবাদিকদের একটা করে ঘর দিয়ে দাও ওরা কিছু করুক। ব্যবসা বাণিজ্য করুক ওরা। কতদিন আর এই ভাবে খবর করে ক্যাসেট নিয়ে দৌড়বে। সত্যিই এমন ঘরানার এক রাজনৈতিক ব্যক্তি আজকের দিনে পাওয়া সম্ভব নয়। যে মানুষটার প্রয়াণ দিবসে এসব মনে পড়ে যাচ্ছে আমার।
আজ মনে হয় সেই যে আমার বৌভাতের অনুষ্ঠানে মুখার্জী পাড়ার সেই একান্ত আপন বিয়ে বাড়ীতে এসে বউকে আশীর্বাদ করে গেলেন তিনি হাসি মুখে সন্ধ্যা বেলায়। আসলে কেষ্টদারা সব এমন ধরনের হন। খবর পছন্দ না হলেও যে তিনি ব্যক্তিগত সম্পর্ক খারাপ করেননি তিনি কোনোদিন। আর এটাই তাঁকে আজও মনে করিয়ে দেয় বারবার আমাদের সবাইকে। ভোটের সময় সব সাংবাদিকদের সবাইকে রিচার্জ করে দেবার জন্য ব্যবস্থা করে দেন তিনি মনে রেখে। যা নিয়ে খুব বেশি হৈ চৈ হয়নি কোনো দিন
আর সেই যে বার তৃণমূল ছেড়ে অন্য দলের পতাকা হাতে নিয়ে ভোটে লড়তে ময়দানে নামলেন তিনি নিজেই আকবর আলী খোন্দকার এর বিরুদ্ধে। সোমেন মিত্রকে পাশে নিয়ে শ্রীরামপুর এর বটতলার মোড়ে তখন মিছিল করছেন গাড়ীতে উঠে। সেই সময় একটু মান আর অভিমান পর্ব চলছে। দুর থেকে দেখে নিজেই হাত নেড়ে গাড়িতে ডেকে নিলেন আমায়। আর যে প্রচারের গাড়ীতে উঠে সোজা প্রশ্ন করলাম আমি এটা কেনো করলেন দাদা নিজের তৈরি দল ছেড়েদিলেন আপনি। হাসতে হাসতে বললেন দেখো না কি হয় ভোটে। হেরেছিলেন কিন্তু হাসি বন্ধ হয়নি তাঁর কোনোদিন। শত্রু মিত্র সবার মাঝে এইভাবেই আজও বেঁচে আছেন আমাদের সবার প্রিয় কেষ্ট দা। আসলে এই সব রাজনীতির মানুষরা বেশ সুন্দর। যাদের হারিয়ে ফেলে মনে হয় এমন রাজনীতির মানুষদের যে আর দেখি না আমরা আজকাল। যাদের কোনোদিন মৃত্যু হয়না। তাই কেষ্ট মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতি তর্পণ করলাম আমি তাঁর প্রয়াণ দিবসে।
কেষ্টদার প্রয়াণ দিবস - অভিজিৎ বসু।
ছয় সেপ্টেম্বর দু হাজার চব্বিশ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন