আমার সাদা জীবনের কালো কথায় আজ শুধু সেই আমাদের সবার বড় দাদার কথা। হ্যাঁ, দেওঘর সৎসঙ্গ আশ্রমের সেই বড় দাদা। পরম পূজ্যপাদ সেই অশোক দার কথা। ওপর থেকে দেখলে যাঁকে প্রথমেই মনে হয় কি রাগী মানুষ ভয়ে হাত পা কেঁপে যায়। কিন্তু কাছে গেলে একদম অন্য একজন মাটির মানুষ। আজ বহুদিন পর আমার সেই আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়া বড়দাদার কথা মনে পড়ে গেল। জীবনের পরতে পরতে জড়িয়ে থাকেন, লুকিয়ে থাকেন এমন কিছু মানুষ তাঁদের কথা ভোলা যায়না কিছুতেই। আর আজ তাই এই রাতের বেলায় মনে পড়ে গেলো তাঁর কথা।
সবে তখন আমি গ্র্যাজুয়েশন পাশ করে বাবা মার সাথে দেওঘর সৎসঙ্গ আশ্রমে গেছি। মাঝেই মাঝেই সেখানে যেতাম ছোটো বেলা থেকেই। সালটা উনিশশো উননব্বই সাল হবে। আমার বয়স তখন সবে ঊনিশ বা কুড়ি বছর হবে। এরপর কি করবো কি পড়বো সেটা জানতে গেছি দাদার কাছে ভয়ে ভয়ে। ছোটো বেলায় সৎসঙ্গ আশ্রমের দীক্ষা নিয়েছি আমি বারো বছর বয়সে। তাই কি করবো সেটা জানতেই দাদার কাছে যাওয়া। সকাল বেলায় প্রার্থনা হলো তারপর দাদা বসে আছেন তাঁর নিজের বসার জায়গায়। আশপাশে আছেন ড সুভাষ বন্দোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ব বিদ্যালয়ের কলা ও বাণিজ্য বিভাগের সচিব, আছেন সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, আছেন আলোচনা পত্রিকার বার্তা সম্পাদক বিপ্লব কুমার গুপ্ত যিনি আজ আর নেই। আছেন বিখ্যাত অধ্যাপক গৌতম চক্রবর্তী, আছেন সঞ্জীব মন্ডল দা, সব নামজাদা লোকের ভীড়।
কিছুটা সঙ্কোচ আর ভয় নিয়ে আমি নিজেই বললাম গ্র্যাজুয়েশন করেছি এরপর কি করবো আমি দাদা। তুই সাংবাদিকতা পড়। বুঝলি ওটা ভালো করে পড় তুই। বুঝিনি আমি কি বললেন তিনি সেদিন। আজ দীর্ঘ এতদিন পর এই রাত দুপুরে ঘুম আসছে না যখন চিন্তায় মগ্ন হয়ে সংসারের চিন্তায়। তখন মনে হয় দাদা বোধহয় সেদিন বুঝতে পেরেছিলেন এর দ্বারা এটা ছাড়া আর কিছুই হবে না। তাই সেই হাজার হাজার মানুষের উপচে পড়া ভিড়ের মাঝে বলে দিলেন তুই সাংবাদিকতা পড়। হয়তো খুব ভালো জায়গা থেকে পড়তে পারিনি আমি। ছোটো জায়গা থেকে পড়ে পাশ করলাম। আর তারপরে ভেসে গেলাম সেই খবরের স্রোতে। আজও জোয়ার আর ভাঁটার টানে ভেসে চলেছি আমি সেই খবরের টানেই কেমন করে।
আসলে আমার মনে হয় বোধহয় এই একটু সাধারণ মানুষের থেকে উচ্চ মার্গের মানুষ যাঁরা বোধহয় কিছুটা বুঝতে পারেন আমাদের অন্তরের গভীরে অন্তঃস্থলের আসল কথা। আমরা কি পারি আর কি পারি না সেই কথা। আর তাই তাঁরা আমাদের সেই মনের কথা বুঝেই কিছুটা অবাক করে বলে দেন কি করা উচিত আর কি উচিৎ নয়। আমিও বেশ ফূর্তি নিয়ে সাংবাদিকতার পাঠশালায় যোগ দিলাম দাদার কথা মনে রেখে।
আজ দাদা নেই কিন্তু কেনো জানিনা সেদিনের তাঁর সেই হাসিমুখে বলা কথা গুলো খুব মনে পড়ে যাচ্ছে আমার। সেই বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে দেখা। সেই পান খেয়ে বসে থাকা চৌকির ওপর। সেই একদৃষ্টিতে গভীর ভাবে কাউকে বুঝতে না দিয়ে তার মনের সব দুঃখ কষ্ট জ্বালাকে শুষে নেওয়া। কত মধুর স্বরে কথা বলে ভয় পাওয়া ভাবকে কাটিয়ে দেওয়া। আর সব থেকে বড়ো হলো একটা জীবনকে সৎ ও মননশীল করে গড়ে তোলা। যে জীবনের মধ্য এই ভালো আর খারাপ বোধকে এনে দেওয়া। কোনটা করা ঠিক হবে আর কোনটা বেঠিক সেই বিচারবুদ্ধি এনে দেওয়া।
আর তাই বোধ হয় এতদিন পরেও কেমন করে নিজের কাছে নিজেকে অপরাধী মনে হয় না আমার। মনে হয় না কেনো এই সাংবাদিকতার পেশায় দীর্ঘ তিরিশ বছরের বেশি কাটিয়ে দিয়ে সুযোগ আর সুবিধা আদায় করে নিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা একটা শিল্প। যে শিল্পকে নিজের আয়ত্বে আনতে পারলাম না আমি কিছুতেই। হয়তো তার জন্য আমি অন্যদের থেকে অনেকটা পিছিয়ে পড়লাম।
কিন্তু একটা ভালো বোধ, একটা সৎ বোধ, একটা বিশ্বাস তৈরি করে দিয়েছিলেন তিনি সেই আমার কাঁচা বয়সে। যার ফল আজও আমি পাচ্ছি এই এতদিন, এত বছর পরেও। তাই বোধহয় নিজের সেই শিরদাঁড়ার জোরেই বেঁচে আছি আমি এই এতদিন ধরেই হাজার কষ্ট করেও। আজ সৎসঙ্গের সেই সব মানুষজন অনেকেই নেই সংঘে। যাঁরা শিক্ষা দিয়ে গেছেন আমাদের নানা ভাবে, নানা রূপে যে কি করে হাজার প্রলোভন থাকা সত্ত্বেও কি করে আদ্যন্ত সৎ থাকা যায়। দুর্নীতির পাঁকে নিমজ্জিত না হয়ে ।
দীক্ষা, ধর্ম, অনুশাসন, প্রবৃত্তি পরায়ণতা, প্রার্থনা, নাম ধ্যান, কীর্তন গান, নিরামিষ খাবার খাওয়া এগুলোর মধ্যে সবথেকে বড়ো বিষয় হলো একজন মানুষ তার জীবনের গঠনকে মজবুত করে তৈরি করবে ছোটকাল থেকেই। একজনকে ভালোবেসে, একজনকে মেনে। যিনি এই সেই বড়ো দাদার মতোই। কখনও বকা দেবেন, কখনও ভালোবাসবেন, কখনও কাছে টেনে নিয়ে বোঝাবেন ভুল করলে। আর বলে দেবেন জীবনের কোন পথে চললে ঠিক করে চলতে পারা যাবে।
সেই কাজটাই বোধহয় আজ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আগে সেই আমার বড়দাদা করেছিলেন। যাঁর সাথে আমার কোনো রক্তের সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু যে আত্মার সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল একদিন সেই ভালোবাসার সম্পর্ক আজ এতদিন পর অনেক কিছুই মনে করিয়ে দিলো। কাজের চাপে আর বহুদিন যাওয়া হয়নি আমার দেওঘরে সৎসঙ্গ আশ্রমে। এখন বদলে গেছে অনেক কিছুই আশ্রমে। আর তাই আমি সেই দাদার কথা শুনে আজও বেঁচে আছি। সেই খবরকে ভালোবেসে খবরের টানেই। আমার প্রনাম নেবেন দাদা।
আমাদের বড়ো দাদা - অভিজিৎ বসু।
নয় সেপ্টেম্বর, দু হাজার চব্বিশ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন