জাস্টিস চাই ছেলের জন্য। ছেলের মৃত্যুর বিচার চাইতে অনশনে বসলেন বাবা। পরপর দুদিন অনশনে বসলেন তিনি। আসলে পেটের জন্য নিজের রাজ্যে পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে বাইরে হরিয়ানায় কাজ করতে গিয়ে যে এইভাবে মরতে হবে ছেলেটাকে সেটা কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবেননি তিনি। হ্যাঁ, তাই চারিদিকে যখন জাস্টিস এর দাবিতে সোচ্চার সরব সবাই তখন ছেলের মৃত্যুর বিচার চাইতে তিনিও আজ পথে নেমেছেন একা একাই। গলায় বিচার চাই এর দাবি ঝুলিয়ে শুকনো মুখে বসে আছেন তিনি এই বৃষ্টির মধ্যে বহরমপুরের রাস্তায়।
হ্যাঁ, আবার গো মাংস খাওয়ার অভিযোগে বাংলার এক পরিযায়ী শ্রমিককে পিটিয়ে হত্যা করার অভিযোগ উঠলো ফের হরিয়ানায়। পশ্চিমবঙ্গের এক যুবক দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলার যুবক যে কাজ করতে গেলো হরিয়ানায়। তিনি আসলে ধর্মে মুসলমান। শুধু গরু খাওয়ার সন্দেহে তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হলো এই দু হাজার চব্বিশ সালে।
এর আগেও তো এমন নজির স্থাপন করেছে আমার এই দ্রুত এগিয়ে চলা আচ্ছে দিন এর দেশ। যে দেশ জুড়ে শুধুই উন্নয়নের জোয়ার বইছে দ্রুত গতিতে। যে দেশে শুধুই মন্দিরে ঘণ্টা ধ্বনি শোনা যায় বেশ জোরে জোরে। আজানের ধ্বনির আওয়াজ যেনো কিছুটা ম্রিয়মান হয়ে গেছে। এর আগেও এমন ঘটনা ঘটেছে কিন্তু কোনো হুঁশ ফেরেনি কারুর। না কেন্দ্র সরকারের, না রাজ্যের সরকারের।
কিন্তু আবার সেই ঘটনা হলো বাংলার পরিযায়ী শ্রমিক বাইশ বছরের সাবিরকে পিটিয়ে মারা হলো। যারা মারল তাকে সেই গো রক্ষক গোষ্ঠীর সদস্য তাদের আবার দেশের প্রতি প্রেম আর ধর্মভাব খুব প্রবল। গত সাতাশে আগষ্ট এই ঘটনা ঘটলো। মাত্র বাইশ বছরের সাবিরকে শুধু গোমাংস খাওয়ার অভিযোগে পিটিয়ে মেরে ফেলা হলো সবার সামনে। আবর্জনা কুড়িয়ে সংসার চালাতেন সাবির। দু বছরের একটি ছোটো মেয়ে আছে তার। না, কেউ কোনো প্রতিবাদ জানায়নি কেনো এমন হলো বলে চিৎকার করেনি। এই আপাত সভ্য দেশে আজও এমন ঘটনা ঘটে যায় কেমন নিশ্চিন্তে আর নির্ভয়ে আর নিরাপদে।
অভিযুক্তরা খালি প্লাস্টিকের বোতল বিক্রির ভান করে সাবির মালিক এবং তাঁর বন্ধু আসিরুদ্দিনকে একটি দোকানে ডেকেছিল। তারপর চলে তাদের উপর গণ পিটুনি। আকলাখের পর সাবির মালিক। এই ঘটনায় পুলিশ বেশ কয়েক জনকে মোট সাতজনকে গ্রেফতার করেছে। পুলিশের মতে অভিযুক্তদের সঙ্গে গো রক্ষক গোষ্ঠীর সম্পর্ক আছে। গোটা ঘটনার তদন্ত হচ্ছে।
সাবিরের মৃত্যুর আগে একদল গ্রামের যুবক পুলিশকে খবর দিয়ে ডেকে নিয়ে যায় গ্রামে। তাদের অভিযোগ ওই সাবির এর পরিবারে গরুর মাংস রান্না করে খাওয়া হচ্ছে। পুলিশ সেই মাংস বাজেয়াপ্ত করে পরীক্ষার জন্য পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু অভিযুক্তরা নিজের হাতে আইন তুলে নিয়ে তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলে। ভাবলেও কেমন যেন ভয়ে গা শিউরে ওঠে।
একবার ভাবুন তো আপনি পেটের টানে এই রাজ্য ছেড়ে স্বাধীন দেশের আর এক জায়গায় গিয়ে কিছু কাজ করে পেট বাঁচানোর চেষ্টা করছেন আর কিছু মানুষ আপনাকে পিটিয়ে মেরে ফেলছে। যাদের বিরুদ্ধে একটাই শুধু অভিযোগ বাড়িতে তারা গো মাংস রান্না করে খায়। সেটা সত্যি না ভুল তার প্রমাণ, বিচার তো অনেক পরে হবে। সেই কথা শুধু শুনে তাকে সন্দেহ করে বাড়ী থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলা হলো এই অপরাধে। তার বাড়ির লোক খবর পেলো তার ঘরের লোক মরে পড়ে আছে একটি নালার মধ্য। ভাবা যায় এমন ঘটনাও ঘটে এই পোড়া দেশে।
সামনেই হরিয়ানায় নির্বাচন। আর নির্বাচন মানেই ক্ষমতা দখল করে আগামী পাঁচ বছরের জন্য নিজেদের সরকারকে নির্বাচিত করে রাজ্যকে সুশাসন দেবার দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে অঙ্গীকার করা মানুষের কাছে। যাতে যে কোনো উপায়ে ধর্মীয় মেরুকরণ করেই হোক বা যে কোনো উপায়ে হোক নিজের দলের ঝান্ডা ক্ষমতা দখল করে প্রতিষ্ঠা করা যায়। সেটা করতে গিয়ে এমন দু একটা ঘটনা ঘটে গেলে কি আর করা যাবে। ভোটের রাজনীতিতে এমন দু একটা সাবির এর মৃত্যু হলে ক্ষতি কি।
যদিও এই ঘটনার কথা জানতে পেরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাবিরের বাড়িতে ফোন করে কথা বলেন চাকরির সুযোগ করে দেন তিনি তাঁর পরিবারের সদস্যকে। তৃণমূলের অভিযোগ বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকদের নিশানা করা হচ্ছে। ওড়িশাতেও এমন ঘটনা ঘটেছে। তাই তৃণমূল এর বিচার চেয়েছে। বিচার চেয়ে সাবিরের বৃদ্ধ বাবাও পথে বসে পড়েছেন। এপিডিআর এর তরফে রনজিৎ শূরের কথায় ধর্মের মেরুকরণের প্রভাব কি আর কাটানো যায়। অল্প কিছু টাকা দিয়ে কি আর জীবন ফিরে আসে। তারা এই ঘটনার বিচার চেয়ে পথে নেমেছেন তাই। বহরমপুরের রাস্তায় দু দিনের অবস্থান আর প্রতিবাদে সামিল হয়েছে গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতি।
আমরা তো সেই আকলাখের কথাও জানি। সেই উত্তরপ্রদেশের বিসারা গ্রামে মহম্মদ আকলাখ এর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল সে গরুর মাংস খেয়েছে। যার জন্য তাকে পাথর দিয়ে থেঁতলে মারা হয়। তার ছোটো ছেলেও মার খায় কোনো রকমে পালিয়ে বেঁচে যায় সে। উত্তর প্রদেশের রাজনীতির ময়দানের নেতা অখিলেশ যাদব সরাসরি এই ঘটনার জন্য দেশের প্রধানমন্ত্রীর দিকে আঙুল তোলেন। যদিও বিজেপি একে এই অভিযোগ উড়িয়ে দেয়। তা মানতে নারাজ যে তাদের জন্য এমন ঘটনা ঘটে গেছে। আর এই দু পক্ষের চাপান উতরে মারা যায় পঞ্চাশ বছরের আকলাখ। সত্যিই বড়ো লজ্জা হয় এই ঘটনার পর।
কিছুদিন হৈ চৈ পড়ে যায় সারা দেশ জুড়ে, তারপর সবাই ভুলে যায় এই নৃশংস ঘটনার কথা। সেই ঘটনার পরেও কোনো টনক নড়েনা কারুর কে জানে। এরপর আবার সাবির মালিক এর ঘটনা ঘটে যায়। আসলে এই সব ভাবলে বড়ো লজ্জা হয় আজকাল। স্বাধীনতার এত বছর পরেও কেমন যেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বলেও একে অপরের বিরুদ্ধে এই যে সন্দেহ করা। আর সেই সন্দেহের চোখে দেখে তাকে মেরে ফেলা এটা বোধহয় ঠিক নয়। তবু কে আর কার কথা শোনে সন্দেহ যে বড়ো বিষম বস্তু।
সাবির মালিকরা বাইরে কাজে যায় আবার মারাও যায় তারা। যে মৃত্যু নিয়ে হৈ চৈ প্রতিবাদ খুব একটা হয়না চোখেও পড়ে না আমাদের। তবু মনে হয় এই দু হাজার চব্বিশ সালে দ্রুত গতিতে ছুটে চলা আমাদের স্বপ্নের বন্দে ভারত এক্সপ্রেসের মত এই দেশে সাবির, আকলাখের মৃত্যু আমাদের যেনো কেমন চুপ করিয়ে দেয়। আমি ভাবি আমরা কি সত্যিই দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছি না ক্রমেই পিছিয়ে যাচ্ছি কে জানে।
জাস্টিস চায় সাবির - অভিজিৎ বসু।
সতেরো সেপ্টেম্বর দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্য ফেসবুক।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন