সাদা জীবনের কালো কথায় আজ এক জেলার সাংবাদিকের গল্প। যে কলকাতার তথাকথিত কোনো এক চ্যানেলের মাতব্বর সাংবাদিক এর কাছে শিরদাঁড়া সোজা রেখে কাঁচের ঠাণ্ডা ঘরে পা সোজা রেখে দাঁড়িয়ে ঠাণ্ডা মাথায় একটুও ভয়ে না কেঁপে তার টেবিলে সে কিছু বলার আগেই লোগো নামিয়ে আর বুম জমা রেখে কাজ ছেড়ে দিয়ে ঘরে ফেরা এক জেলার অল্প বেতনের এক সাংবাদিকের বেঁচে থাকার গল্প।
যার মনে হয়নি যে এরপর কি হবে তার আর তার পরিবারের। যেমন আমি কাজ ছেড়ে দিয়েছিলাম টোটো চালিয়ে ঘুরবো বলে দুম করে কিছু না ভেবেই এক বড় চ্যানেল থেকে। যেটা সেই সময় বাংলার দু নম্বর চ্যানেল ছিল। বাংলার এক বিখ্যাত জার্নালিস্টকে মুখের ওপর জবাব দিয়ে। যিনি আমায় পরে সেই চ্যানেলে আবার কাজ দেবার নাম করে ইন্টারভিউ বোর্ডে সবার সামনে এই টোটো চালিয়ে ঘুরে বেড়ানোর প্রসঙ্গ তুলে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন সেই কথা আমায় বারবার। যদিও আজ তিনিও সেই চ্যানেলে আর নেই। যাক গে সেই প্রসঙ্গ টেনে আর কি হবে আজ এই এতদিন এত বছর পরে।
লোগো আর এই চ্যানেলের বুম জমা দিতে অফিসে যে ওই জেলার সাংবাদিককে ডাক দেন এক বিখ্যাত বাংলা মিডিয়ার অ্যাসাইনমেন্টের সেই দাপুটে মহিলা।যার নামে বাঘে গরুতে একসাথে জল খায়। রিপোর্টার, ক্যামেরাম্যান সব ভয়ে কাঁপে ঠক ঠক করে। যিনি আমায় একদিন অসুস্থ অবস্থায় বলেছিলেন তুমি কাজ করতে পারছ না অবসর নিয়ে নাও। যাকে অনেক ভরসা করেই বড়ো চ্যানেল থেকে ওই মাতব্বর সাংবাদিক যিনি এক বড়ো চ্যানেলে কাজ হারিয়ে কোনো রকমে এক ছোটো চ্যানেলে কাজে যোগ দেন বড়ো পদে। সেই অ্যাসাইনমেন্টের মহিলা সাংবাদিক কে নিয়ে আসেন অনেক ভরসা করেই সব সামলে দেবে এই আশায়। সব সামলেও দেন তিনি।
আর সেই জেলার ছোটো সাংবাদিক ওই মাতব্বর সাংবাদিক এর টেবিল এর সামনে যে লোগো জমা দিয়ে সাংবাদিক হবার কথা না ভেবে চাকরি ছেড়ে দিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে পারে তাকে আমি কুর্ণিশ আর স্যালুট জানাই। সত্যিই বলছি এর জন্য আমার বেশ গর্ব হয় আজ। হ্যাঁ, সেই কলকাতা টিভির সৌমেন রায়চৌধুরীর কথা বলছি আর কি। কলকাতা টিভি ছেড়ে আমার হাত ধরে যে একটি ছোট স্যাটেলাইট চ্যানেলে কাজে যোগ দেয় হুগলী জেলায় কিছুদিন আগে।
সৌমেন এর সাথে আমার আলাপ কাজের আর খবরের সুত্রেই। সেই খবর এখন চ্যানেলের সৌমেন রায় চৌধুরী। সেই কবে থেকে যে ও বাংলা মিডিয়াতে ঘুরে ঘুরে কাজ করছে কে জানে। তারপর কিছুদিন ইটিভিতে হুগলী জেলায় আমার ক্যামেরাম্যান এর কাজ করেছে সে আমার সাথেও। কিন্তু রিপোর্টার হয়ে কাজ করা একজন কেনো জেলার অন্য এক রিপোর্টার এর সাথে ক্যামেরার কাজ করবে সেটা নিয়ে ওর মনেও যেমন একটা খুঁত খুঁত ভাব ছিল সেটা জেলার অন্য সাংবাদিকরাও তাকে কিছুটা বুঝিয়ে ছিল সেই সময়। আর তাই এর মাঝেই কলকাতা টিভিতে নতুন কাজের সুযোগ তৈরি হলে ও চলে যায় সেখানে রিপোর্টার হয়ে জেলার রিপোর্টার। অফিস, ক্যামেরা, বেশ ভালো লাগতো ওকে দেখে আমার সেই সময়। যেটা ওর কাজের প্রতি নিষ্ঠা আর ভালোবাসায় ও সফল ভালো রিপোর্টার হয়ে যায় কিছুদিনের মধ্যে।
ভালো বিনয়ী ছেলে। রাফ এন্ড টাফ নয় বেশ হাসিখুশি একটা ছেলে আমার মত খারাপ নয় আর কি। কিন্তু ওকে আমি বেশ পছন্দই করি আজও। তার এই কিছু পোস্ট দেখে মনে পড়ে গেলো কিছু কথা। কতদিন যে আমি ওর মোটর সাইকেল করে দৌড়ে খবর করে ক্যাসেট নিয়ে এসে ছবি ধরিয়েছি তার ঠিক নেই। আমার মেয়েকে ছোটো বেলা থেকেই ওর বউ বাংলা পড়াতে আসতো বাড়ীতে। একটা পারিবারিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছিল ধীরে ধীরে আমাদের দুই পরিবারের মধ্যে। ও কোনোদিন মুখ ফুটে কাউকে বলতে পারেনি নিজের দুঃখ আর কষ্টের কথা। আর তাই বোধহয় ধীরে ধীরে পিছিয়ে পড়েছে ও এই মিডিয়ার ফিল্ড থেকে।
কিন্তু নিজের মাথা উঁচু করে আর শিরদাঁড়া সোজা রেখে দোকান চালিয়ে গেছে ও নিজেই নিজের কলজের জোরে লজ্জা না পেয়ে। কলকাতা টিভির অফিস ছেড়ে চলে এসেছিল এই নতুন চ্যানেলে একটু কাজ করবে বলে দুটো টাকা আয় হবে এই আশায়। আমিও সেটা ভেবেই কিছু লোকের কাজের ব্যবস্থা করেছিলাম। কিন্তু না সেটা বোধহয় কিছুটা হলেও বুঝতে পারল সৌমেন নিজেই আমি চাকরি ছেড়ে চলে আসার পর যে তাকেও আর কেউ পছন্দ করছে না ওই চ্যানেলে। কারন একটাই আমার নিজের লোক বলে।
অভিজিৎ বসুর লোককে ডেকে পাঠাও তাকে রগড়ে আর একটু ধুয়ে দেখি ভয় পায় কি না। হাত জোড় করে বলে কি না পা ধরে যে দাদা আমি আপনার দাস আমি আপনার ভক্ত। কিন্তু না, সেই বিখ্যাত দাদা কিছু বলার আগেই ঠক করে লোগো নামিয়ে দিয়ে চলে আসা। চোখে চোখ রেখে কথা বলা। আজ এতদিন পর এই ঘটনার কথা লিখতে বসে বেশ মজা লাগছে আমার। বুকের পাটা লাগে এটা করতে। এমন থাপ্পড় মারা একজন শিরদাঁড়া সোজা রেখে চলা এই ছোটো সাংবাদিক এর আজ কাজ নেই ঠিক আমার মতই। আমার মত সেও হয়তো টোটো চালকের কাজ না করে কঠিন লড়াই করেই বেঁচে আছে। কিন্তু এটা ঠিক কথা যে অন্য বাকিদের মত সমঝোতা করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে না সে।
না, হুগলী জেলার এই মাটি শক্ত মাটি। এই মাটি হলো আন্দোলন এর মাটি। তাই কোনো সমঝোতা করতে পারেনি সে। তাই আমি যেমন কোনো সমঝোতা না করে কারুর পা না ধরেই কোনো মাতব্বরদের তেল না দিয়ে বেঁচে আছি এই পাঁচ বছর ধরে টোটো চালকের কাজ করছি বলে। ঠিক তেমনি করেই সৌমেন ও বেঁচে আছে আজ কষ্ট করেই। তাতে ওর কোনো লজ্জা নেই। অপমান নেই। ঘৃণা নেই। ভয় নেই।
আছে শুধু এটাই যে বেঁচে থাকার জন্য এক একজনকে নানা উপায় অবলম্বন করতে হয়। সেই অবলম্বন এক একজনের এক এক রকমের। জীবনের দর্শন এক একজনের এক এক রকমের হয়। মা মাটির আর মানুষকে সাথে নিয়ে জীবন যাপন নাকি ক্ষমতার দম্ভ অহংকার আর মাতব্বর এর জীবন যাপন। ক্ষমতার অধিকারী হয়ে জোর করে কাউকে ভয় দেখিয়ে তার পেটের ভাত জোগাড় বন্ধ করে দেওয়া। নাকি একটু ভালো ব্যবহার করে তাদের না বের করে দিয়ে কাজের সুযোগ করে দেওয়া যাতে তারাও দুটো ভাত খেতে পায়। যে যেমন করে যেমন ভাবে জীবন যাপন করতে ভালোবাসে।
আজ এই ভোরবেলায় মনে পড়ে গেলো আমার সৌমেন এর কথা। ওর হাসি মুখের কথা। ওর ভগবানের প্রতি অগাধ বিশ্বাস আর আস্থার কথা। যে বিশ্বাস আর আস্থা নিয়েই ও এতবড় একটা রিস্ক নিয়ে জীবনে চলতে পারলো। ভালো থাকিস ভাই। কাউকে ভয় না পেয়ে জীবনে এই চলার যে শিক্ষা। তাকে সঙ্গে করে বাকি জীবনটা আমি আর তুই না হয় রাস্তায় ঘুরে ঘুরে কাটিয়ে দেবো বাকি জীবন। দুর থেকে দেখবো আমাদের ছেড়ে আসা পেশায় টিকে থাকা সেই সব বন্ধুদের যাদের ভয় নিয়ে বেঁচে থাকতে হয় প্রতিদিন প্রতি মুহূর্ত। যাদের শিরদাঁড়া ঝুঁকিয়ে প্রতি মুহূর্তে সমঝোতা করে চলতে হয় হাতজোড় করে। আমি তুই না হয় ওদের মতো না বেঁচে একটু নিজের মত করে বাঁচি ক্ষতি কি।
সৌমেন ও আমি - অভিজিৎ বসু।
তেইশ সেপ্টেম্বর দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্য ফেসবুক।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন