একুশে জুলাই দু হাজার চব্বিশ। রাত তখন দুটো বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। মোবাইল ফোনে একটা মেসেজ ভেসে এলো, আমি রুবিতে ভর্তি। আমি পাল্টা জিজ্ঞাসা করলাম ফোন করা যাবে তোমায় এখন, বললো না। এত রাতে কি হলো রে বাবা। চিন্তা বাড়তে শুরু করলো আমার। কি করবো কাকে জিজ্ঞাসা করবো কিছুই বুঝতে পারলাম না আমি। একদম কেমন স্থবির হয়ে গেলাম আমি সেই রাতে। কদিন আগেও তো দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে আমাদের দুজনের। কি এমন হলো যে এই রাতদুপুরে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যেতে হলো।
চলমান এই জীবনের রাস্তায় হাঁটতে নেমে কখন যে পাথরে ঠোক্কর খেতে হয় হোঁচট খেতে হয় কে জানে। হ্যাঁ আজ যার কথা আমি আমার এই সাদা জীবনের কালো কথায় লিখবো বলে ঠিক করলাম। সে আর কেউ নয় আমাদের সবার সেই হীরক কর। আমাদের হীরক দা। আর বেশিরভাগ মানুষের কাছে সেই আমাদের সবার কাকা। সেই তার কাছ থেকেই রাত দুপুরে মোবাইল ফোনে এমন মেসেজ পেয়ে কদিন আগে মনটা কেমন উচাটন হয়ে যায় আমার। চেনা মানুষ দূরে চলে গেলেও সম্পর্কের সরু সুতোটা বোধ হয় টিমটিম করে রয়ে যায়।
কবে যে এই দাপুটে আপাত রাগী এই সাংবাদিক এর সাথে আমার আলাপ হয়েছিল সেটা কে জানে। খুব সম্ভবত সেটা পট পরিবর্তনের কাগজের সময়ে হবে। সেই দু নম্বর ছকু খানসামা লেন এ অজিত দার অফিস শিয়ালদহ স্টেশনের কাছে। সেই স্নেহাশীষ সূরের ক্লাস করা কাঠের বেঞ্চে বসে। সেই ফ্রিল্যান্স প্রেস ক্লাব। সেই কাজী গোলাম গাউস সিদ্দিকীর কাছে সাংবাদিকতার পাঠ নেওয়া। সেই ইন্দ্রানী রাহা। সেই তো শুরু আমার জীবনের এই খবরের পাঠশালার খড়ের চালের নিচে বসে পড়া করার।
তারপর সেই বিপিন নেওয়ার জীর হিন্দি কাগজ ছাপতে ছাপতে অফিস এর ছোট্ট একটা কাঠের খাঁচার মত ঘরে এডিটর অনুপম অধিকারী হাত ধরে কাজ পাওয়া। সেই সান্ধ্য দৈনিক কাগজে জেলা সংবাদ দাতা হিসেবে সুযোগ পাওয়া। সেই রতন দার হাতে কপি পড়লে কেমন ভয়ে হাত পা কাঁপতে থাকা।সেই জায়গাতেই সেই অফিসে প্রথম দেখলাম ফটা ফট ফোন ঘুরিয়ে পুলিশকে ফোন করে চমকে দেওয়া এক সাংবাদিককে। বেশ মুগ্ধ হলাম কিছুটা সমীহ আর ভয় পেয়ে দূরে সরে থাকতাম আর কি। এই দাপটে দূরে সরে থাকাই ভালো।
যাই হোক জেলার খবর পাঠিয়ে দেওয়ার সাথে সাথে আমি আর দিব্যেন্দু চক্রবর্তী যে বর্তমানে সে আনন্দবাজার পত্রিকা অফিসে কাজ করে তাদের দুজনের ডাক পড়ল জেলা থেকে কলকাতায় কাজ করার জন্য। ব্যাস হীরক কর এর একদম হাতের মুঠোয় এসে পড়লাম আমরা। একদিকে বকা শোনা আর অন্য দিকে স্নেহ মিশ্রিত ভালোবাসা দিয়ে বকাকে ডাইলুট করে দিয়ে সেই রিপোর্টার এর কাছ থেকে সেরা কাজ বা খবর বের করে নেওয়ার চেষ্টা করা এটাই ছিল সেই সময় এর প্ল্যান তাঁর।
যাই হোক এইভাবেই দিন কেটে গেলো বেশ। এদিক ওদিক ভাসতে ভাসতে হঠাৎ ইটিভির চাকরি করার সুবাদে সেই মেজাজী আর রাজার মত জীবন কাটানো সাংবাদিককে দেখলাম বর্ধমান জেলার ইটিভির অফিসে বসে থাকতে চেয়ারে। সেই পুরোনো দিনের মেজাজে শহর কলকাতা ছেড়ে একটু গ্রামের গন্ধ মেখে আমার বাংলার সোঁদা গন্ধ গায়ে জড়িয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন আমাদের সবার সেই হীরকদা।
ভীড় উপচে পড়া অফিস। সেই ভি এইচ এস ক্যাসেট এর যুগ। সেই বড়ো কালো কামানের মত ক্যামেরা। সেই অসিত দা ক্যামেরাম্যান। আরও কত চেনা সব মুখ। না আজ আর সেই সব নাম মনে নেই আমার বয়স বাড়ছে যে। তারপর বড়ো বিয়ে বাড়ির ক্যাসেট ছেড়ে এলো সেই ছোটো ক্যাসেট এর যুগ। সুন্দর ছিমছাম ক্যামেরা। সেই ছোটো ক্যাসেট ভিটিআর এর মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে ছবি দেখা টিসি দেখে। তারপর বেছে বেছে কিছু ভালো ছবি কেটে সেটা ভিস্যাট সেন্টার দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া। সত্যিই খবরের টিভির সাংবাদিকতার যুগের আদিম যুগের ইতিহাস বলতে পারেন।
আমাদের কলকাতা অফিসে তিন নম্বর চৌরঙ্গী স্কোয়ারের অফিসে বসে আছেন মাথার ওপর আমাদের সবার আশীষ ঘোষ দা। শুভাশীষ দা। অম্বরিশ দা, মৃত্যুঞ্জয় দা। অনির্বাণ চৌধুরী দা আর ও কত বিখ্যাত সাংবাদিক সব। আর কাকার বর্ধমান জেলা জুড়ে সব জায়গা থেকে ক্যাসেট আসছে নানা বাস করে ড্রাইভার এর হাত দিয়ে। বাস এর নম্বর সাদা কাগজে লিখে দিয়ে সাইকেল করে ক্যাসেট আনার কাজ চলছে দ্রুত লয়ে। সেই একতলার সুন্দর সাজানো গোছানো বর্ধমানের এই ইটিভির অফিস আমার বেশ ভালো লাগতো।
সেই যে খানাকুল এর বসন্তপুর থেকে রাজনৈতিক হিংসাতে তিনজন মারা গেলো। নদী পেরিয়ে নৌকা করে সুব্রত যশ আর আমি বর্ধমান ভি স্যাট সেন্টারে ক্যাসেট নিয়ে এলাম বৃষ্টি ভিজে। হীরক কর বসে আছে বললো অভিজিৎ বসু এসে গেছে ওর ছবি আগে পাঠানোর ব্যবস্থা করো তোমরা। হায়দরাবাদ অনেকক্ষণ থেকে এই মারামারির ছবি চাইছে। বিকেল চারটার সময় ছবি গেলো আর পাঁচটার খবরে বর্ধমান ইটিভির অফিসে বসে দেখলাম ছবি দেখানো হয়ে গেলো। কি উত্তেজনা আর কি আনন্দ যে হতো সেই সময়। এটাই তো টিভি চ্যানেলে সাংবাদিকতার ড্রাগের মাতাল করা নেশা। যা আজও রাতের অন্ধকারে আমায় টানে।
হীরক কর খুব খুশি। এইতো কমরেড লড়ে যাও এইভাবেই। সেই সময় থেকেই ধীরে ধীরে ভয় কাটলো একটু একটু করে। আর কিছুটা ভালোবাসা গড়ে উঠলো আর কি দুজনের আইনদুরের সম্পর্কে। দুর থেকে ভালোবাসা, ভয় মিশ্রিত ভালবাসা। দিন বদলে গেলো সেই হীরক কর ক্ষমতা পেলো। সিদ্ধার্থ সরকার এর হাত ধরে। আশীষ ঘোষ নেই সেই সময়। আমাদের জেলার সাংবাদিকদের সব নানা ভাবে কাজ এর মধ্য চাপে রেখে দিতে শুরু করলেন তিনি। কিন্তু আমার সেটা কোনোদিন চাপ বলে মনে হয়নি।
একবার একটু কষ্ট পেলাম আমি ভোটের সময় জেলার অফিসের ঘরে ভোটের ম্যাপ টাঙ্গিয়ে রিহার্সাল চলছে। একটু আমার দাঁড়াতে দেরি হলো ট্রায়াল রানের সময়ে। সেই নির্বাচনে আমার কোনো লাইভ নেওয়া হলো না আর। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা আর ক্ষমতার অধিকারী তখন হীরক কর। মধ্যগগনে তখন অবস্থা তাঁর। যাকগে সাদা জীবনের কালো কথায় এসব না হয় নাই বা আজ লিখলাম। সেদিন জামা প্যান্ট পরে সেজে গুজে সারাদিন দাঁড়িয়ে রইলাম আমি কিন্তু না সব জেলার ভোটের ফল নিয়ে লাইভ হলেও আমার হলো না হুগলী জেলার কোনো লাইভ। হয়তো আমায় দেখতে ভালো নয় বলে আমায় বাদ দেওয়া হলো সেই সময়। সুন্দর মুখের জয় সর্বত্র।
কলকাতা অফিসে সেই সময় বিখ্যাত সব সাংবাদিক এর দল। নবেন্দু গুহ, জয়ন্ত চোধুরী, রবিশঙ্কর দত্ত আছেন। বোধ হয় সৌম্য সিনহা আছেন বড়ো পদ নিয়ে বিরাজ করছেন তিনি। এমন অভিজ্ঞতা তো সিঙ্গুর থেকেও হয়েছে আমার। সিঙ্গুরে অন্দোলনের সময় রাজভবনের বৈঠক শেষে হায়দরাবাদ থেকে ডেস্ক থেকে এক ক্ষমতা সম্পন্ন কর্তা আমায় বলে দিয়েও।আমার ফোন নেওয়া হবে বলে দিয়েও অপেক্ষা করেও সেদিন আর ফোন নিলেন না তিনি। আজকের নিউজ এইট্টিন এর একজন বিখ্যাত সাংবাদিক তিনি। একসময় যাঁদের দুজনের খুব দাপট ছিল হায়দরাবাদ এর আমার বাংলার সংসারে স্বামী আর স্ত্রীর।
যাক এসব নিয়ে আজ আর এই বুড়ো বয়সে আমি নিজে কাকা হয়ে গিয়ে আর ভাবিনা কিছুই। শুধু বৃষ্টি ভেজা রাতে মনটা কেমন ভিজে যায় মাঝে মাঝেই। সেই সিঙ্গুরে মার খাওয়া আমার ক্যামেরাম্যান জ্যোতির্ময় এর। সেই কাকার কলকাতা অফিস থেকে দৌড়ে চলে আসা জেলা অফিসে। আমায় মাথা গরম হয়ে গেছে সেই রক্ত দেখে। আমাকে হাসপাতালে সামাল দেওয়া কত ঘটনা যে ঘটেছে সেই সময় তার শেষ নেই। সেই মদন মিত্র আর পার্থ চট্টোপাধ্যায় আমার বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ করবেন, কেনো তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করা হয়েছে। আমার যুক্তি তখন একটাই নিজেরাই মারধর করে সহানুভূতি দেখাতে আর রাজনীতি করতে শ্রীরামপুর ওয়ালস হাসপাতালে এসে নাটক করা হচ্ছে ফুল দিয়ে। সে যাকগে অনেক কষ্টে দু পক্ষকে শান্ত করেছিলেন হীরক কর আর জয়ন্ত চোধুরী সেই যাত্রায়। আর সেই সব সাংবাদিক জীবনের ঘটনা ঘটার পরেও জেলার সাংবাদিকদের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে কোনোদিন দ্বিধা করেনি দাপুটে এই দাদা হীরক কর। যেটা বোধহয় তার অন্যতম একটি ভালো গুণ।
একদিন শুনলাম সেই হীরক কর ইটিভি ছেড়ে নতুন প্রজন্মের ছেলেদের নিয়ে নতুন একটি চ্যানেল করছেন। ভেবেছিলাম জিজ্ঞাসা করবো আমায় নেবে না তুমি। কিন্তু না, আমার স্বভাব আর নিজে দূরে থাকার কারণে সেদিন জিজ্ঞাসা করা হয়নি হীরক দাকে। সেই তাঁর নতুন চ্যানেলের জেলার টিমেও আমার আর জায়গা হয়নি চ্যানেল টেনে। যেখানে তিনি সর্বময় কর্তা আর একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। সে নিয়ে কোনো ক্ষোভ বিক্ষোভ আর দুঃখ নেই আজ। শুধু মনে হয়েছিল কাজ জেনেও দৌড়ে বেড়ানো একজন জেলার খেটে খাওয়া এই সাংবাদিককে কেনো যে পছন্দ হলো না কে জানে।
হয়তো আমার এই ঠোঁট কাটা কথা এর জন্য দায়ী কিছুটা। আমার এই দাপট যা অনেক বস সেটা কিছুতেই সহ্য করতে পারে না। কে আর বস হলে আশপাশে তার অতীত দিনের কাউকে কাছে রেখে দিতে চায় বলুন। যে তার অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ জানে। যেটা এখন মিডিয়ার প্রধান কাজ হয়ে গেছে। যাকগে জীবন চলে যায় এইভাবেই জীবন কেটে যায় তার নিজের গতিতে। থেকে যায় কিছু ঘটনা, কিছু কথা, আর কিছু ভালো আর কিছু খারাপ অভিজ্ঞতা যা মনের মণিকোঠায় এই রাতদুপুরে পুকুরের কালো জলে মাছের ঘাই মারার মত উঁকি দেয় আর ঘাই মারে। তখন বুকের ভেতর কেমন যেনো চিনচিন করে। বুকের বাম দিকের যন্ত্রটা তার গতি বাড়িয়ে দেয় কেমন করে যেন।
যে কথা হচ্ছিল হাসপাতালে ফোন করলাম পরদিন শুনলাম কি জন্য অসুস্থ হয়ে পড়েছে হীরক দা। এখন চিকিৎসা চলছে ধীরে ধীরে অনেকটা ভালোর পথে। শুনে মনের রাতের উচাটন ভাবটা কেটে গেল কিছুটা। মনে পড়ে গেলো একদিন এমন রাতেই তো কর্মহীন হয়ে রাতের অন্ধকারে ফোন করে সেই দূরে সরে থাকা আর ভয় পাওয়া কাকার কাছেই হাউকাউ করে কেঁদে ফেলেছিলাম আমি। কি করে বাঁচবো, কি করে মেয়েকে পড়াবো সেই কথা ভেবে। সেদিন রাতে এই হীরক কর বলেছিল, ওর কাকা বেঁচে আছে ভাইঝির জন্য। মনের হাজার কষ্ট, যন্ত্রণা একনিমেষে সেদিন উবে গেল। সেই রাতের অন্ধকারে।
জীবন বোধ হয় এইভাবেই শিক্ষা দেয় আমাদের। কেড়ে নিয়ে, আবার ফিরিয়ে দিয়ে যায় এইভাবেই। তাই যেদিন সল্টলেকের সেই এক অফিসের মধ্য বৃষ্টির জলে ভিজে হাওয়াই চটি আর ছাতা নিয়ে হাজির হলাম আমায় দেখে সবাই অবাক হলো। সেদিন দেখা হলো স্নেহাশীষ সুরের সাথে। সেদিন কিন্তু হীরক কর একভাবেই বলে দিলো কমরেড এসে গেছে আর কোনো চিন্তা নেই আমার। ভালো লাগলো সেদিনও এই কথা শুনে। কিন্তু এই হীরক কর এর জন্য যে জেলা থেকে কলকাতা চলে গেলাম আমি ভয়ে।
জেলার ইটিভির অফিস বন্ধ হয়ে গেলো। রিপোর্টারদের আর থাকতে দেওয়া হবে না জেলা অফিসের মধ্যে। কি হবে এই চিন্তায় সেই মির্জা গালিব স্ট্রীটের অফিসে কাজে যোগ দিলাম জেলা থেকে। আজ মনে হয় সেদিন ভয় না পেয়ে যদি জেলায় হুগলী জেলায় থেকে যেতাম আমি হয়তো আজও হুগলী জেলার বেতাজ বাদশা হয়েই কাজ করতাম নিজের মত করেই। সত্যিই আজ মনে হয় কি যে ভয় আর অনিশ্চয়তা গ্রাস করলো আমায় সেদিন কে জানে।এসব ভেবে আর কি হবে এতদিন পরে।
যাক যা হবার ছিল তাই হলো। বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে আমার মনের রাস্তায় আজ বড়ো পিছল আর কাদা জমে গেছে যেনো। সেই রাস্তায় হাঁটতে নেমে বার বার কেমন পা পিছলে পড়ে যাচ্ছি আমি এই রাতদুপুরে। সল্টলেকের সেই নতুন অফিসের বস হয়ে হীরক কর কে দেখে বহুদিন পর আমার বেশ ভালো লাগলো। সেই জমিদারি মেজাজ। সেই পুরোনো দিনের ঝলক। সেই রাতের বেলায় খবর নিয়ে কথা বলা। ঘণ্টার পর ঘন্টা আলোচনা করা দুজনের। সেই হীরক দার মার নামে স্কুলের গল্প করা। বহ্নি কর শবর পাঠশালা। নিজের উদ্যোগে একা লড়ে যাচ্ছে সে নিজেই মার স্মৃতিকে বুকে আগলে রেখে। বাবাকে নিয়ে বোনকে নিয়ে ভাগ্নিকে নিয়ে দিব্যি বেঁচে আছে সে।
কিন্তু আবার হঠাৎ শুনলাম শরীর ভালো নেই হীরক করের। হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যেতে হলো আবার তাকে। এই কথা আর কাউকে বলে নি হীরক দা। কথা হলো আজ বহুদিন পরে। বললো অভিজিৎ আবার ভর্তি হয়ে গেলাম। কেউ জানে না এটা। পূজোর পরে ব্যাঙ্গালোরে যাবো ভালো করে কম পয়সায় চিকিৎসা করতে হবে। তুমি একটু খবর পেলে দিও ব্যাঙ্গালোরে হাসপাতালের খবর। শুনলাম আবার রক্ত দিতে হয়েছে তাকে।
মনটা আবার খারাপ হলো আমার। পুরোনো ফ্ল্যাশ এর ঝলকানিতে মনে পড়ে গেল এত কথা। আরও অনেক কথাই অব্যক্ত রয়ে গেলো হয়তো। অনেক কথাই আমার বলা হলো না কিন্তু আমার সাদা জীবনের কালো কথায় এই আপাত গম্ভীর মুখের দাপুটে সাংবাদিক হলেও কেমন ঋজু হয়ে সোজা সাপটা জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা একজন সাংবাদিক যাকে ভয় নিয়েও বলা যায় দাদা তুমি একটু দেখো আমায়।
আর এই বয়সেও হাসতে হাসতে জামা জুতো পড়ে সুটেড বুটেড হয়ে হীরক করকে মাঠে নামতে দেখে ভালো লাগে বড়ো। যে অফিসের বেতন না হওয়া ছেলে মেয়েদের নিয়ে দুপুর বেলায় খেতে যায় আজও একসাথে। যে আজও খবরের নেশায় বুঁদ হয়ে ফোন করে বলে অভিজিৎ বসু এই ছবিটা জোগাড় করে দাও লাগবে আমার। আমিও তার কমান্ড পেয়ে আজও এই বুড়ো বয়সে কেমন ঝাঁপিয়ে পড়ে চেষ্টা করি সেটা জোগাড় করতে।
আসলে খবরের নেশায় বুঁদ এই দুই জনের মনের দূরত্ব যাই থাক,মন কষাকষি যাই থাক, অভিমান যাই থাক।খবরের মাঠে তারা একদম কাছের খুব কাছের মানুষ যে। তাই বোধহয় মাঝে মাঝেই রাত বিরেতে ফোন ঘুরিয়ে ফেলি আমি। একটা একটা করে শব্দ মেসেজ লিখে গাল শুনি হীরক দার। চুপ করে মুখ বুজে থাকি। বড়ো ভালো লাগে আমার। মনে মনে বলি চলো আবার আমরা দুজনে একসাথে মাঠে নেমে এই বুড়ো বয়সে দৌড়ে বেড়াই। তুমি দ্রুত সুস্থ হয়ে যাও হীরক কর।
আবার আমি আর তুমি সেই পুরোনো দিনের চেনা খবরের মাঠে দৌড়ে সামিল হবো।
আমরা দুজনে কোপাই এর তীরে একসাথে হেঁটে বেড়াবো হাত ধরে। কাশ ফুলের ঝোপ ঝাড় পেরিয়ে দৌড়ে বেড়াবো এদিক ওদিক। সেই সোনাঝুরির হাট, খোয়াই এর মাঠ, সেই অমর্ত্য সেন এর বাড়ী, সেই রবি ঠাকুরের গান, সেই চেনা টুকরো মুখ এর সারি তোমার চারপাশে ভীড় করবে আবার। আর তুমি আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হেসে বলবে এই তো কমরেড অভিজিৎ বসু হাজির হয়ে গেছে। আমি কিছুটা ভয়, আর কিছুটা ভালোবাসা নিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে থাকবো তোমার পাশে। ফিরে পাবো আমাদের ফেলে আসা অতীতকে।
আমাদের সবার কাকা - অভিজিৎ বসু।
ষোলো সেপ্টেম্বর, দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্য ফেসবুক।
পুরনো অনেক কথাই মনে পড়ে গেল। তখন পুলিশ বীটে দাপুটে সাংবাদিকদের যুগ।
উত্তরমুছুন